আগাথা ক্রিস্টি (Agatha Christie) একজন প্রবাদ প্রতিম ইংরেজ মহিলা ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প লেখিকা যিনি বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তাঁর লেখা ৬৬টি গোয়েন্দা উপন্যাস ও ১৪টি ছোটগল্প সংকলনের জন্য। বিশ্ব সাহিত্যে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস রচনার নিরিখে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা গল্প লেখক হিসেবে পরিগণিত হন আগাথা ক্রিস্টি। বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের নিরিখে আগাথা ক্রিস্টি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে নির্বাচিত হন। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী তিনি হলেন বিশ্বের একমাত্র লেখক যাঁর লেখা প্রায় ৫৬টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
১৮৯০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ডেভনে এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে আগাথা ক্রিস্টির জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম –ডেম আগাথা ম্যারি ক্লারিসা ক্রিস্টি। তাঁর বাবার নাম ফ্রেডরিক আলভা মিলার এবং মায়ের নাম ক্লারিসা মার্গারেট। আগাথা তিন ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। জীবদ্দশায় দুবার বিয়ে করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম স্বামীর নাম আর্চিবল্ড ক্রিষ্টি যিনি পেশায় একজন পাইলট ছিলেন। আর্চিবল্ড ক্রিস্টিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিমা ফ্রন্টে পাঠানো হলে মূলত এই সময় থেকেই আগাথা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ওষুধ এবং বিষ নিয়ে জানতে পারেন। ১৯২৮ সালে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু পদবীটি তিনি সারাজীবন বহন করেন। এরপর ১৯৩০ সালে স্যার ম্যাক্স ম্যালাবেন নামের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদকে বিয়ে করেন আগাথা। এই সময়ে সামাজিক স্তরে তাঁর লেডি ম্যালাবেন পরিচিতির সূত্রপাত হয়। তাঁরা একসাথে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে প্রায়শই ঘুরে বেড়াতেন এবং তাঁর এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তিনি তাঁর বেশ কিছু গল্পে ব্যবহারও করেছেন।
১৯০২ সালে আগাথা প্রথম মিস গাইয়ার’স গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু স্কুলের এই শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে মানিয়ে না নিয়ে উঠতে পারায় তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। ১৯০৫ সাল নাগাদ তাঁর মা তাঁকে প্যারিস পাঠিয়ে দেন। তিনি সেখানে একটি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন এবং কণ্ঠ শিল্পী ও পিয়ানো বাদক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। কিন্তু এখানেও তিনি মানিয়ে উঠতে না পারায় এবং আগামী ভবিষ্যতে পিয়ানো বাদক হিসেবে বা কণ্ঠ শিল্পী হিসেবে নিজের প্রতি কোন সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে তিনি পড়া ছেড়ে দেন।
পেশায় ঔপন্যাসিক ব্রিটিশ এই লেখিকার ছদ্মনাম মারি ওয়েস্টমাকট । তাঁর লেখার বিষয় ছিল — হত্যা রহস্য, রোমাঞ্চ, অপরাধ সাহিত্য, রোমান্টিক উপন্যাস ।‘গোল্ডেন এজ অফ ডিটেকটিভ ফিকশন’ নামক সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই লেখিকা। এই লেখিকা।
লেখিকা হিসেবে আগাথার উত্থান বেশ নাটকীয়। একটি পারিবারিক আড্ডায় আগাথা একবার বলেন তিনি যা এখনো অবধি যা জ্ঞান অর্জন করেছেন তা দিয়ে তিনি একটি আস্ত গোয়েন্দা উপন্যাস লিখতে পারবেন। তাঁর বোন তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লিখতে বলেন। শুরু হয় আগাথার প্রথম উপন্যাস রচনা। কিন্তু এই উপন্যাস প্রকাশের জন্য তিনি কোনো প্রকাশক খুঁজে পাননি। বেশ কয়েকজন প্রকাশক শুরুতে প্রকাশ করার কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত এ উপন্যাস বাতিল করেন। ১৯২০ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সামান্য কিছু পাঠক সেই লেখার সমাদরও করে। আগাথা কিন্তু অবিচ্ছিন্ন ভাবে একটি গুণগ্রাহী মহল তৈরী করতে সমর্থ হন যেটি পরবর্তীতে তাঁর পাঠকমহলে তৈরিতে সাহায্য করে অনেকটাই। ১৯২৬ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘মার্ডার অব রজার একরয়েড’ এখনও পর্যন্ত যা তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হয়। আগাথা ক্রিস্টি র গোয়েন্দা উপন্যাসগুলি চমকপ্রদ এক একটা ঘটনা দিয়ে শুরু হয় যা পাঠককে শেষ পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় আবদ্ধ করে রাখে। কাহিনী যখন চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌছায় তখন সব রহস্যের ইতি ঘটে। পাঠক হতবিহ্বল হয়ে যায়।আগাথা ক্রিস্টির বিশ্বনন্দিত গোয়েন্দা গল্পের সুপরিচিত নায়ক হারকিউল পয়রয়েট। প্রখর পর্যবেক্ষণশক্তি ও বুদ্ধির জোরে যিনি একের পর এক অপরাধ-রহস্যের সুরাহা করেন।‘ দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’ উপন্যাসে প্রথম আবির্ভাবেই হারকিউল পয়রয়েট সাড়া ফেলেছিলেন। আগাথা ক্রিস্টি তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি ছোটগল্প।
আগাথা ক্রিস্টির রচনাগুলির মধ্যে ধারালাে বুদ্ধির সঙ্গে মিশে আছে নিবিড় মমতা, সুচারু চরিত্র বিশ্লেষণ ও মানব জীবনের ট্রাজিক নিয়তি। তিনি উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, কবিতা এবং দুটি আত্মজীবনী সহ এক শতাধিক রচনা লিখেছিলেন। আগাথা মেরি ওয়েস্টম্যাকট ছদ্মনামে ছয়টি রোমান্টিক উপন্যাসও লিখেছিলেন। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে ভ্রমণকালে তিনি লেখেন ‘মার্ডার অন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে (১৯৩৪), মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া (১৯৩৬) এবং মার্ডার অন নাইল(১৯৩৭)। বাস্তবের কুখ্যাত বা বিখ্যাত মানুষদের ক্রিস্টি লেখায় ঠাঁই দিয়েছেন একাধিক বার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিখ্যাত ব্রিটিশ গুপ্তচর ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ নামে খ্যাত টমাস এডওয়ার্ডসের কর্মজীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে পশ্চিম এশিয়ায়। সেই অভিজ্ঞতার খানিকটা নিয়ে আগাথা ক্রিস্টি লিখলেন ‘সেভেন পিলার্স অব উইসডম’ উপন্যাসে।
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এর তথ্যানুসারে আগাথা ক্রিস্টি বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখক। যেকোনও ধরণের সাহিত্য কর্মের মধ্যে তাঁর বইয়ের বিক্রির একমাত্র তুলনা চলতে পারে শেক্সপীয়ারের সঙ্গে।তাঁর লেখা বইয়ের বিক্রির পরিসংখ্যানটি শুনলে চমকে উঠতে হয় — দুশো কোটি কপির বেশি। একমাত্র বাইবেল বিক্রির সংখ্যাটা তাঁর বইয়ের থেকে বেশি ।সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭১ সালে তাঁকে ‘ অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারের ডেম কমান্ডার’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ইউনেস্কোর বিবৃতি জানা যায় তাঁর বই সব থেকে বেশি সংখ্যক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সর্বমোট ৫৬টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর বই। তাঁর লিখিত নাটক “ দি মাউসট্র্যাপ’ একটানা ১৯৫২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়েছে লন্ডনের ওয়েস্টএন্ড থিয়েটারে।
১৯৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি ৮৫ বছর বয়সে আগাথা ক্রিস্টি র মৃত্যু হয়।
One comment