অনিতা দেশাই

অনিতা দেশাই

অনিতা দেশাই (Anita Desai) একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক যিনি বিখ্যাত ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর উপন্যাসের জন্য। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর পরিচিতির বাইরেও তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র মানবিক বিদ্যার (Humanities) এমারিতা জন.ই বুর্চার্ড অধ্যাপক। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ থেকে আজ অবধি যে কজন ভারতীয় লেখক লেখিকা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করে গোটা পৃথিবীর পাঠককুলের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কুড়িয়েছেন অনিতা দেশাই তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁর কাহিনীর প্রেক্ষাপট বা চরিত্র অনেকাংশেই ভারতীয় হলেও, তাঁর লেখনশৈলী মনে করিয়ে দেয় টি এস এলিয়ট বা পরবর্তীকালের ভার্জিনিয়া উলফের মতো প্রবাদপ্রতিম লেখকদের কথা। জীবনের বেশির ভাগ সময়টা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কাটালেও অনিতা দেশাই তাই একই সাথে ভারতীয় এবং বিশ্বনাগরিক। ইংরেজি ভাষার উপর তাঁর দখল, চারপাশের পরিস্থিতির বিষয়ে তাঁর অদ্ভুত সংবেদনশীলতা, গোটা বিশ্বের প্রেক্ষিতে সেই সব ঘটনার তাৎপর্য বিশ্লেষণ দেশ বিদেশ থেকে তাঁকে এনে দিয়েছে, খ্যাতি, সম্মান এবং ভালোবাসা। আর কে নারায়ন বা মুল্ক রাজ আনন্দের সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তৈরি করেছেন নিজস্ব এক ঘরানা।

১৯৩৭ সালের ২৪ জুন ভারতবর্ষের মুসৌরি শহরে অনিতা দেশাইয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ডি এন মজুমদার এবং মায়ের নাম অ্যাঁতোয়ানেত নাইম মজুমদার। পেশায় ব্যবসায়ী ডি এন মজুমদারের সাথে অ্যাঁতোয়ানেত নাইমের পরিচয় হয় জার্মানির বার্লিনে, বিশ্বযুদ্ধের আগে। তাঁরা এমন একটি সময় বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন, যখন ভারতীয় পুরুষদের সাথে ইউরোপীয় মহিলাদের বিবাহ খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিলনা। পরবর্তীকালে তাঁরা সংসার শুরু করেন দিল্লীতে। পুরনো দিল্লীর হিন্দু মুসলমান মিশ্রিত পরিবেশে বড় দুই বোন এবং দাদার সাথে বড় হন অনিতা দেশাই। ১৯৫৮ সালে তিনি এক কম্পিউটার সফটওয়্যার কোম্পানির অধিকর্তা অশ্বিন দেশাইকে বিবাহ করেন এবং তাঁদের দুই পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা কিরণ দেশাই ঔপন্যাসিক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। ২০০৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য ইনহেরিটেন্স অফ লস; এর জন্য তিনি ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেন। অনিতার স্বামী অশ্বিন দেশাইও পরবর্তী জীবনে “বিট্যুইন ইটার্নিটিঃ আইডিয়াস অফ লাইফ অ্যান্ড দ্য কসমস” (Between eternity: Ideas Of life and the cosmos)নামের একটি বই লেখেন। বাড়ির মধ্যে মায়ের সাথে জার্মান ও প্রতিবেশীদের সাথে মূলত হিন্দিতে কথা বলতে অভ্যস্ত অনিতা ছোটবেলার থেকেই এক অদ্ভুত সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। তাঁর মা’র কাছে তিনি শুনে এসেছেন জার্মান রূপকথার গল্প, জার্মান ভাষায় ক্রিসমাসের গান, আবার তাঁর বাবার কাছে শুনেছেন পূর্ব বাংলার রূপকথা, সেই দেশের স্মৃতিকথা। বাবা মা দুজনের দু’দেশের গল্পই কোথাও গিয়ে দেশভাগের, মাতৃভূমি ছেড়ে আসার যন্ত্রণায় একাকার হয়ে যেত। এই যন্ত্রণা, শিকড়ের অভাব, অস্তিত্বের লড়াই পরবর্তীকালে কোনোভাবে ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর প্রায় সব কাহিনীতেই।

দিল্লীর কুইন মেরি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াকালীন তাঁর বন্ধু ছিল বই। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির পরিবেশ তাঁকে বইপ্রেমী করে তুলেছিল। সাত বছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু করেন তিনি এবং নয় বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প। ১৯৫৭ সালে নতুন দিল্লীর ‘থট’ (Thought) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ছোট গল্প ‘সার্কাস ক্যাট অ্যালি ক্যাট’। এই ১৯৫৭ সালেই দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত মিরান্ডা হাউস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে স্নাতক হন অনিতা দেশাই। সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে কিশেন প্রসাদ মেমোরিয়াল প্রাইজ পান ইংরেজি সাহিত্যের জন্য। ছোটবেলা থেকেই অনিতাকে সাহিত্যের প্রতি উৎসাহিত করে এসেছেন তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি সাহিত্যকে নিজের বাকি জীবনের সঙ্গী করে নিতে অসুবিধা হয়নি তাঁর।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৫৮ সালে কলকাতায় থাকাকালীন পুরুষোত্তম লাল এবং আরও সাতজন লেখকের সাথে তিনি শুরু করেন রাইটার্স ওয়ার্কশপ প্রকাশনা গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর থেকে পরবর্তী বেশ কিছু বছর ধরে প্রকাশিত হয় এ কে রামানুজন, রাস্কিন বন্ড, আগা শহিদ আলি, মীনা অ্যালেক্সান্ডার, প্রীতিশ নন্দীর মতো লেখকদের প্রথম বই। এই সময়ে ম্যাক্সমুলার ভবনে কর্মরত অবস্থায় কলকাতার তৎকালীন পরিস্থিতি, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন তাঁর মনে ছাপ রেখে যায়। ১৯৬৫ সালে অনিতার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ভয়েসেস ইন দ্য সিটি’তে উঠে আসে সেই অস্থির সময়ের কাহিনী।

সংসারের অন্য পাঁচটা কাজের সাথে সমানতালে চলছিল তাঁর লেখালেখির কাজ। ঘোর সংসারী অনিতা তাঁর স্বামীর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে ক্রমশ শানিত করে তুলছিলেন নিজের লেখনীকে। চারপাশের মানুষ, পরিবেশ, তার শব্দ, গন্ধ, সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের সাবালক হয়ে ওঠা ধরা পড়ছিল তাঁর লেখায়। ১৯৬৩ সালে ওরিয়েন্ট পেপারব্যাক্স থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ক্রাই, দ্য পীকক’ এইরকমই এক শোষিত, অবদমিত নারীর কাহিনী। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘বাই বাই ব্ল্যাকবার্ড’। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘হোয়্যার শ্যাল উই গো দিস সামার’ উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর অদ্ভুত জীবনকাহিনী। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘ফায়ার অন দ্য মাউন্টেন’ তাঁকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। নন্দা কৌল নামের এক নিভৃতচারী বিধবার সাথে তাঁর প্রপৌত্রীর সম্পর্ক নিয়ে লেখা অসাধারণ এই উপন্যাসটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক সমালোচক বলেন, “এমারজেন্সি সময়ের পরে যখন অন্যান্য ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখিকারা সামাজিক বিষয়েই আবদ্ধ থেকেছেন, সেই সময় এই আঙ্গিকের একটি কাহিনী লেখা প্রশংসার দাবি রাখে”। ১৯৭৮ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ও উইনিফ্রেড হলটসবি মেমোরিয়াল পুরস্কার পাওয়া এই উপন্যাসটিকে অনিতা দেশাই নিজের সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস বলে মনে করেন। ১৯৮০ সালে তিনি লেখেন ‘ক্লিয়ার লাইট অফ দ্য ডে’। এই উপন্যাসটিকে তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন অনিতা দেশাই। এই উপন্যাসটি সেই বছর বুকার প্রাইজের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয়। টি এস এলিয়টের বিখ্যাত ‘ফোর কোয়ার্টেটস’ (Four quartets)থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনিতা দেশাই এই উপন্যাসটি স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে গিয়ে চারটি অংশে বিভাজিত করেন; কাহিনীতে অতীত ও বর্তমান একইসাথে এগিয়ে চলে। প্রথম প্রকাশিত হওয়ার চল্লিশ বছর পরেও এই উপন্যাসটি ইংরেজি সাহিত্যের এক যুগান্তকারী কাজ হিসেবে গন্য হয়।

তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলিবাগে সমুদ্রের ধারে ছুটি কাটাতে যেতেন অনিতা। সেই প্রেক্ষাপটেই ১৯৮২ সালে লেখা হয় ছোটদের জন্য তাঁর উপন্যাস ‘ভিলেজ বাই দ্য সি’। হাইনম্যান থেকে প্রকাশিত তাঁর এই উপন্যাস ১৯৮৩ সালে তাঁকে এনে দেয় গার্জেন চিলড্রেনস ফিকশন প্রাইজ। এরপরের বছরেই ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় এক উর্দু কবির শেষজীবনের কাহিনী অবলম্বনে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘ইন কাস্টডি’। এই উপন্যাসটি ১৯৮৪ সালে বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করেই হলিউডের বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশনস এই নামেই একটি ছবি তৈরি করেন। শশি কাপুর, শাবানা আজমি এবং ওম পুরি অভিনীত এই ছবিটি ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করে।

ছোটবেলায় বাবা-মা’র দেশত্যাগের দুঃখ অনিতাকে ছুঁয়ে রয়েছে আজীবন। সেই সাথে ইংরেজি সাহিত্যের ব্যাপকতা তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। দেশের সামাজিক বৈচিত্র্য, রাজনৈতিক অসাম্য তাঁকে প্রভাবিত করেনি; তিনি তাঁর গল্পে এই প্রেক্ষাপটগুলিকে ব্যবহার করেছেন একান্ত নির্লিপ্তির সাথে। তাঁকে প্রভাবিত করেছে এই দেশের মধ্যবিত্ত নারীদের ওপর যুগ যুগ ধরে হয়ে আশা শোষণ বা নিপীড়ন। সেই চরিত্রগুলি বারেবারে ফিরে এসেছে তাঁর একাধিক কাহিনীতে। শুধু নারীরাই নয়, পুরুষমানুষের একাকীত্বও হয়ে উঠেছে তাঁর রচনার বিষয় যার উদাহরণ দেখা যায় ‘ইন কাস্টডি’ বা ১৯৮৮ সালে তাঁর লেখা ‘বমগার্টনার্স বোম্বে’ উপন্যাসে। কোথাও গিয়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ, তাঁদের সমস্যা এই উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠে। তাঁর অভূতপূর্ণ শব্দচয়ন, ভাষার ব্যবহার, বিষয়ানুগ আঙ্গিকের ব্যবহার তাঁকে একই সাথে সফল ও সংবেদনশীল কাহিনীকার করে তোলে। তাঁর এই আন্তর্জাতিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৫ সালে রচিত ‘জার্নি টু ইথাকা’ উপন্যাসে যেখানে এক দম্পতি আধ্যাত্মিক মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে পার হয়ে আসে চারটি মহাদেশ, ছুঁয়ে যায় উত্তর ভারত, বোম্বে, কায়রো, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক এবং একটা দীর্ঘ সময়কাল। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘ফাসটিং, ফিসটিং’ তাঁকে এনে দেয় বুকার পুরস্কারের জন্য তাঁর তৃতীয় মনোনয়ন।

এর মধ্যে তাঁর জীবনে ঘটে গেছে একাধিক পরিবর্তন। অধ্যাপক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বেশ কিছু কলেজে। কেমব্রিজের গারটোন কলেজ, আমেরিকার স্মিথ কলেজ, নিউ ইয়র্কের বারুচ কলেজ, ম্যাসাচুসেটস এর মাউন্ট হলিওক কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জন ই বুর্চার্ড প্রফেসর হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনার দায়িত্বপালন করেন। এক মেক্সিকান শিক্ষাবিদের নিজের শিকড়ের সন্ধানে মেক্সিকোয় ফিরে যাওয়া নিয়ে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘দ্য জিগজ্যাগ ওয়ে’ প্রকাশিত হয় এই শতাব্দীর গোড়ায় ২০০৪ সালে। ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আর্টিস্ট অফ ডিসাপিয়ারেন্স’ উপন্যাসটি চারটি নভেলার সমষ্টি। বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং গোটা পৃথিবীর প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে লেখা তাঁর ষোলটি উপন্যাস ছাড়াও তিনি কলম ধরেছেন শিশুদের জন্য, লিখেছেন প্রচুর ছোট গল্প ও প্রবন্ধ যার মধ্যে দিয়ে অন্য এক অনিতা দেশাইয়ের পরিচয় পাওয়া যায়।

অনিতা দেশাই তিনবার বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া ছাড়াও, পেয়েছেন সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার , তারকনাথ দাস এ্যাওয়ার্ড ফর কন্ট্রিবিউশন্স টু ইন্দো-আমেরিকান আন্ডারস্ট্যান্ডিং (১৯৮৯), পদ্মশ্রী সম্মান (১৯৯০), বেন্সন মেডেল অফ রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচার, সাহিত্য অ্যাকাডেমি ফেলোশিপ এবং ২০১৪ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মভূষণ সম্মান। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে ইংরেজি সাহিত্যের জগতে একের পর এক কীর্তি স্থাপন করে চলা এই সাহিত্যিক বর্তমানে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে তাঁর অবসর জীবন যাপন করছেন।

One comment

আপনার মতামত জানান