ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলা হল আসারাম বাপু ধর্ষণ মামলা (Asaram Bapu Rape Case)। স্বঘোষিত ধর্মগুরু আসারাম বাপুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের দুইটি অভিযোগ ওঠে যার ফলস্বরূপ আদালত বিচারে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান দেয়। আসারামের গুজরাটের সুরাট এবং রাজস্থানের যোধপুরের আশ্রমে এই দুটি ঘটনা ঘটেছিল৷ শুধু আসারাম বাপু নয়, তাঁর ছেলেও সুরাট ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল এবং বাবার মতোই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তিপ্রাপ্ত হন।
২০১৮ সালে নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে স্বঘোষিত ধর্মগুরু আসারাম বাপুকে যোধপুরের তপশিলি জাতি ও উপজাতি কোর্ট পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা-সহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেছিল। এখন আসল ঘটনাটির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
২০১৩ সালে আসারাম বাপুর উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরের আশ্রম থেকে একজন নাবালিকা শিষ্যাকে অশুভ শক্তি থেকে তাঁকে মুক্ত করার জন্য যোধপুরের মানাই গ্রামে অবস্থিত তাঁর আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন আসারাম বাপু। সেখানেই ১৫ আগস্ট ১৬ বছর বয়সী সেই নাবালিকা শিষ্যাকে আসারাম যৌন নিপীড়ন করেন বলে অভিযোগ। মেয়েটির বাবা ও মাও ছিলেন আসারামের শিষ্য। মেয়ের মুখ থেকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা শোনার পরে তাঁরা দিল্লি পুলিশে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। এরপরে মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয় অভিযোগের সত্যতা যাচাই করবার জন্য। সেই পরীক্ষাতে মেয়েটির শরীরে যৌন নিপীড়নের চিহ্ন পাওয়া গেলে আসারাম বাপুর নামে মামলা দায়ের করা হয়।
৩১ আগস্টের মধ্যে আসারাম জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিল্লিতে হাজির না হলে দিল্লি পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির জামিন-অযোগ্য ধারায় একাধিক মামলা করে। অবশেষে যোধপুর পুলিশ তাঁকে তাঁর আশ্রম থেকে ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে এবং যোধপুরেই বন্দী করে রাখে। আসারামকে ভারতীয় দন্ডবিধির ধারা ৩৪২ (অন্যায়ভাবে আটকে রাখা), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৫০৬ (ফৌজদারী ভয় দেখানো) এবং ৫০৯ (যে-কোনো মহিলার শালীনতার অবমাননা)-এর অধীনে এবং সেইসঙ্গে যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের, নাবালক-নাবালিকাদের সুরক্ষা আইনের (POCSO) ধারা ৮ এবং জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের ২৩ এবং ২৬ ধারার অধীনে অভিযুক্ত করা হয়। শুরু হয় আসারাম বাপু ধর্ষণ মামলা। গ্রেপ্তারের আগে অবশ্য তিনি মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ভারতীয় জনতা পার্টির কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি অশোক সিংঘল এবং প্রবীণ তোগাডিয়া এই গ্রেপ্তারকে হিন্দু ধর্মীয় অনুভূতির উপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেন। আসারাম শুরু থেকেই কিন্তু ধর্ষিতার অভিযোগকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন এবং নিজের যৌন অক্ষমতার কথা বলেন। যদিও এই অক্ষমতার অজুহাতটি শেষ পর্যন্ত মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছিল।
আসারামের জেলে থাকাকালীন অবস্থায় সুরাটের এক মহিলা এবং তাঁর বোন, আসারাম ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। আশ্রমের প্রাক্তন শিষ্যা বড় বোন অভিযোগ করেন যে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে আমেদাবাদের মোতেরা আশ্রমে থাকাকালীন আসারাম বাপু তাঁকে বারংবার ধর্ষণ করেছিলেন। অন্যদিকে ছোট বোনটিও বলেন যে, ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আসারামের ছেলের দ্বারা তিনি ধর্ষিত হন। এই দুই বোন আসারামের স্ত্রী ও মেয়ে-সহ আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছিলেন আসারামের এই কুকর্মে তাঁকে সহায়তা করার জন্য। ২০১৯ সালে আসারামের ছেলে নারায়ণ সাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়।
এই মামলার সাক্ষী এবং ধর্ষিতার পরিবারকে ২০১৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অনেক হুমকি এবং বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, এমনকি এই মামলার সাথে জড়িত অনেক সাক্ষীকে হত্যাও করা হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে দায়রা বিচারক মনোজকুমার ব্যাস, যিনি মামলার শুনানি শুনেছিলেন, আসারামকে জামিন না দেওয়ার জন্য প্রাণনাশের হুমকি শুনতে হয়েছিল তাঁকে। একজন প্রাক্তন ভক্ত এবং আসারামের ভিডিওগ্রাফারকে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করে। ত্রিবেদী কমিশনের সামনে জবানবন্দী দেওয়ার পর আসারামের এক আশ্রম সচিবকে গুলি করে হত্যা করে আততায়ীরা। আসারামের ব্যক্তিগত চিকিৎসক রাহুল সাচান, যিনি যোধপুর মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাঁকে ছুরিকাঘাত করা হয়। মামলার আরেক সাক্ষী কৃপাল সিংও খুন হয়ে যান। যোধপুর কান্ড এবং সুরাট কান্ডেরও আরেকজন সাক্ষী, আসারামের প্রাক্তন এক ব্যক্তিগত সচিবকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালত চলাকালীন আসারামের এক অনুগত শিষ্য ছুরিকাঘাত করেছিলেন। ভুক্তভোগীর মতে আসারাম নিজেই নাকি সেই ছুরি মেরেছিলেন। তবে এই দাবির ভিত্তি নিয়ে সংশয় আছে। এরকমই আরেকজন প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিবকে, যিনি সুরাট এবং যোধপুর দুটি ঘটনারই সাক্ষী ছিলেন তাঁকে ২০১৫ সালের মে মাসে হত্যার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। অন্যদিকে সুরাটের মামলায় দুই সাক্ষীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পিঠে ও মুখে ছুরিকাঘাত করা হয় ছোট বোনটির স্বামীকে। এই সুরাট ধর্ষণ মামলার সাক্ষী একজন প্রাক্তন রাঁধুনিকে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আসারাম মামলার তিনজন মূল সাক্ষীকে হত্যার জন্য কার্তিক হালদার ওরফে রাজু দুলালচাঁদকে গ্রেপ্তার করা হয়। যোধপুর কান্ডের নাবালিকার পিতাকেও হুমকি দেওয়া হয় এক সপ্তাহের মধ্যে কেসটি তুলে নেওয়ার জন্য।
স্বাস্থ্যের সমস্যার উল্লেখ করে আসারাম একাধিকবার রাজস্থান হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আবেদন করেছিলেন কিন্তু রাম জেঠমালানি, সুব্রমনিয়াম স্বামী প্রমুখের মতো বিশিষ্ট আইনজীবীরা তাঁর মামলা নিলেও, প্রত্যেকবার জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আদালত। ধর্ষণকারীর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন পুনম চাঁদ সোলাঙ্কি (পি সি সোলাঙ্কি)। পুনম চাঁদ পস্কো(POSCO) আইন সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। বিনা সাম্মানিকে সম্পূর্ণ নিজস্ব তাগিদে ধর্ষিত নাবালিকার হয়ে এই হাই প্রোফাইল কেসটি লড়েছিলেন তিনি। কেস চলাকালীন একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন যেমন, তেমনি আবার কেসটি ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য কোটি টাকার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিপুল টাকার প্রলোভন বা প্রাণনাশের আশঙ্কা কোন কিছুই তাঁকে একজন অসহায় নাবালিকার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারেনি। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট আসারামের জামিন খারিজ করে, সেইসঙ্গে ভুয়ো চিকিৎসা নথি পেশ করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে নতুন এফআইআর করার নির্দেশ দেয়। অর্থহীন পিটিশন দাখিলের জন্য তাঁকে ১ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে, আসারামের পক্ষে উপস্থিত হয় আইনজীবী সিদ্ধার্থ লুথরা এবং সৌরভ অজয় গুপ্ত সুপ্রিম কোর্টকে বলেছিলেন যে, গুজরাটের মামলায় ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে, ১৪ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ করাও বাকি ছিল। ফলে আদালত মামলাটিকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করে। রাজস্থান হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল যোধপুর কেন্দ্রীয় কারাগার প্রাঙ্গনে যোধপুর ধর্ষণ মামলায় ট্রায়াল কোর্টের রায় ঘোষণার জন্য রাজ্য পুলিশের একটি আবেদন মঞ্জুর করে এবং কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করার নির্দেশ দেয়।
অবশেষে যোধপুর ধর্ষণকান্ডে মূল অভিযুক্ত হিসেবে ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল আসারাম বাপুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানার সাজা ঘোষণা করে যোধপুরের তপশিলি জাতি ও উপজাতি আদালত। আসারামের দুই সহযোগীকেও কুড়ি বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিনি এবং অন্যান্য সহ-অভিযুক্তরা রাজস্থান হাইকোর্টে সাজা স্থগিত করার জন্য আপিল করেন৷ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সহ-অভিযুক্তদের একজনের সাজা স্থগিত করে আদালত। এই মামলায় পিসি সোলাঙ্কি নিপীড়িতার পক্ষে প্রসিকিউটর হিসেবে লড়েছিলেন।
২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি গুজরাটের গান্ধীনগরের একটি দায়রা আদালতের অতিরিক্ত বিচারক ডি কে সোনি সুরাট ধর্ষণকান্ডে মূল অভিযুক্ত আসারাম বাপুকে ভারতীয় দন্ডবিধির ধারা ৩৭৬(২) এবং ৩৭৭-এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেন। পাশাপাশি ধর্ষিতাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ারও নির্দেশ দেয় আদালত। মূলত পাবলিক প্রসিকিউটর আরসি কোডেকর একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আহ্বান জানানোর পরই অতিরিক্ত দায়রা আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে।
সম্প্রতি (২০২৩ সালে ২৩ মে) ওটিটি প্ল্যাটফর্ম-এ আসারাম বাপু ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত সিনেমা ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’ মুক্তি পেয়েছে যেখানে মনোজ বাজপেয়ী পি সি সোলাঙ্কির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।