বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি

বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি

বিশ্ববন্দিত অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার ফার্দিনান্দ পোর্শে ছিলেন বর্তমানের বিখ্যাত পোর্শে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মূল কান্ডারি। বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণ করে তিনি এক যান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বলা চলে। ১৮৯৮ সালে পোর্শে সি.২ ফিটন মডেলের একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুত করেছিলেন এবং এটি যেহেতু তাঁর ডিজাইন করা প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি ছিল, তাই এর নাম দিয়েছিলেন পি ওয়ান (P1)। এই গাড়ি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার রাস্তায়। এই ইলেকট্রিক গাড়িটিকেই পোর্শে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা চলে। এরপর থেকেই ফার্দিনান্দ পোর্শে আরও উন্নততর বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল নির্মাণ করে বাস্তবিকই এক বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন অটোমোবাইলের জগতে। 

ফার্দিনান্দ পোর্শে বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল তৈরি করে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে। আসলে ইলেকট্রিকের সঙ্গে খুব ছোটবেলা থেকেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর। মাত্র তেরো বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বাড়িতে একটি ডোরবেল স্থাপন করেছিলেন এবং ষোলো বছর বয়সে সেখানে বৈদ্যুতিক আলোও সংযুক্ত করেন। ম্যাফাসডর্ফে তাঁদের বাড়িতেই প্রথম বিদ্যুৎ ছিল ফার্দিনান্দের দৌলতে। বিদ্যুতের প্রতি তাঁর ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সত্ত্বেও একজন প্লাম্বার হিসেবে শিক্ষানবিশী সমাপ্ত করেন ফার্দিনান্দ। দিনের বেলায় বাবার মেকানিক্যাল দোকানে সাহায্য করার পরে রাত্রিবেলা রেইচেনবার্গের ইম্পেরিয়াল পলিটেকনিক্যাল স্কুলে ক্লাস করতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে ভিয়েনার বিদ্যুৎ কোম্পানি ‘বেলা এগার অ্যান্ড কোং’-এ (বর্তমানে ব্রাউন বোভেরি) চাকরি পেয়ে যান ফার্দিনান্দ এবং ১৮৯৩ সালে চলে যান সেখানে। এইভাবে কর্মসূত্রে বিদ্যুতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটি অক্ষুণ্ন ছিল। বেলা এগার কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সময়ে ১৮৯৭ সালে সেখানে ফার্দিনান্দ প্রথম বৈদ্যুতিক হুইল-হাব মোটর তৈরি করেন। এই যানটির ধারণার প্রথম উদ্ভাবক ছিলেন অবশ্য ওয়েলিংটন অ্যাডামস। ১৮৯৮ সালে জেকব লোহনার অ্যান্ড কোম্পানিতে যোগদান করেন। সেখানেই সি.২ ফিটন নামেও পরিচিত এগার-লোহনার গাড়িটি পোর্শে ডিজাইন করেছিলেন, তাই পি ওয়ান নামটিও এই গাড়িটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এই গাড়িটি ছিল দেখবার মতো। অনেকটা ঘোড়ার গাড়ির মতো কাঠের কামরাওয়ালা গাড়ি ছিল এটি। এই লোহনার-পোর্শে গাড়িটিই বিশ্বের প্রথম অল-ইলেকট্রিক ফ্রন্ট-হুইল ড্রাইভ গাড়ি। 

১৮৯৮ সালে, ভিয়েনায় জেকব লোহনার অ্যান্ড কোং-এ নতুন প্রতিষ্ঠিত ‘ইলেকট্রিক কার ডিপার্টমেন্ট’-এ যোগদান করেন পোর্শে। সেখানেই পি ওয়ান গাড়িটি ডিজাইন করেন। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের পর লুডভিগ লোহনার বুঝতে পেরেছিলেন যে ঘোড়ার গাড়ির জমানা ফুরিয়ে আসছে। সেকারণেই ফিরে এসে তিনি পোর্শেকে একটি ইলেকট্রিক চালিত গাড়ির পরিকল্পনা করতে বলেন। পোর্শের বয়স তখন ২২ বছর। এরপরই তিনি এগার-লোহনার সি.২ ফিটন মডেলটি ডিজাইন করেছিলেন। এই সি.২ ফিটন মডেলের গাড়িটি অষ্টভুজাকার বৈদ্যুতিক মোটর দ্বারা চালিত হত। গাড়িটি দুটি বৈদ্যুতিক মোটর এবং ব্যাটারির সাহায্যে চলত। সামনের চাকায় কেবল বৈদ্যুতিক মোটর লাগানো ছিল। এর গতি পৌঁছেছিল ৩৪ কিমি প্রতি ঘন্টায়। এই গাড়িটি ৭৯ কিমি পরিসরের মধ্যে তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা চালানো যেত। গাড়িটিতে একটি জটিল গিয়ার সিরিজ ছিল। ১২ স্পীড কন্ট্রোলারের ব্যবস্থা ছিল, যার মধ্যে ছয়টি ফরোয়ার্ড গিয়ারের জন্য, দুটি রিভার্স এবং চারটে গাড়ির ব্রেকের জন্য। এই বৈদ্যুতিক ফিটন গাড়িতে ব্যবহৃত মোটরটি ৩৫০ আরপিএম-এ (350 rpm) ৩ এইচপি (3 hp) তৈরি করতে পারত। এই গাড়িতে আবার ‘ওভারবুস্ট’ ফাংশনের ব্যবস্থাও ছিল। গাড়িটি মূলত ছিল কাঠের তৈরি এবং এর ওজন ছিল ১,৩৫০ কেজি। ব্যাটারির ওজন ছিল ৫০০ কেজির বেশি। চাকাগুলিও কাঠের তৈরি এবং বায়ু ভর্তি টায়ার দিয়ে ঘেরা। গাড়িটিকে একটি ওপেন-এয়ার চেসিস হিসেবে স্টাইল করা হয়েছিল। ১৯০০ সালে প্যারিসের বিশ্ব প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয় গাড়িটি। ১৮৯৮ সালের ২৬ জুন ভিয়েনার রাস্তায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করে এই গাড়ি। ১৮৯৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পোর্শে বার্লিন রেড রোসে একটি সি.২ চালিয়েছিলেন এবং একটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। ১৯০২ সালে হার্নালসের একটি গুদামে এই গাড়িটিকে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। ১৯০৬ সালে এই গাড়িটিকে ভিয়েনা টেকনিক্যাল মিউজিয়ামে দান করা হয়েছিল৷ যদিও এটি বর্তমানে পোর্শে মিউজিয়ামে রয়েছে প্রদর্শনীর জন্য। 


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

১৯০০ সালে পোর্শে বিশ্বের প্রথম কার্যকরী হাইব্রিড গাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। সেটির নাম ছিল সেম্পার ভিভাস। ১৯০১ সালে পোর্শে তাঁর লোহনার-পোর্শে মিক্সটে হাইব্রিড গাড়িটির সঙ্গে পরিচয় করান সকলের। এটিই প্রথম পেট্রোলিয়াম-ইলেকট্রিক হাইব্রিড গাড়ি। এরপর সেই ১৯৩১ সালে নানা উত্থান পতনের পর পোর্শে কোম্পানির গোড়াপত্তন করলেন ফার্দিনান্দ। তখন একেরপর এক বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ করে সত্যি সত্যি এক বিপ্লব এনে ফেললেন অটোমোবাইলের জগতে। কিন্তু প্রথম ডিজাইন করা সেই পি ওয়ান ইলেকট্রিক গাড়িটাই যেন তাঁর ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। 

আপনার মতামত জানান