যন্ত্রসভ্যতার প্রভূত উন্নতির পিছনে যেসমস্ত বিশ্ববন্দিত অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারের অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অধিবাসী ফার্দিনান্দ পোর্শে(Ferdinand Porsche)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত পোর্শে অটোমোবাইল কোম্পানিকে যান্ত্রিক বিপ্লবের এক অগ্রপথিক বলা চলে। যেসমস্ত বিখ্যাত গাড়ির নির্মাতা হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, লোহনার-পোর্শে, ফোক্সওয়াগন বিটল, মার্সিডিজ বেঞ্জ এসএস/এসএসকে, ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়তেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। নাৎসিদলের হয়ে কাজ করেছিলেন এবং স্বয়ংক্রিয় বন্দুক, উন্নতমানের যুদ্ধের ট্যাঙ্ক ইত্যাদি অস্ত্র নির্মানেও তাঁর অবদান ছিল। রেসিং-এর গাড়ি যেমন তৈরি করেন তিনি, তেমনই বিমানের ইঞ্জিন তৈরির জন্যও পেয়েছিলেন উপযুক্ত সম্মান। মরণোত্তর কার ইঞ্জিনিয়ার অব দ্য সেঞ্চুরি ( Car Engineer of the Century) সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে।
১৮৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র) অংশ, উত্তর বোহেমিয়ার ম্যাফাসডর্ফে ফার্দিনান্দ পোর্শের জন্ম হয়। তাঁর বাবার অ্যান্টন পোর্শে একটি প্লাম্বিং ওয়ার্কশপের মালিক ছিলেন এবং পাশাপাশি তিনি মোটরগাড়ির বাহ্যিক কোনো সমস্যার যেমন দুর্ঘটনায় দুমড়ে যাওয়া বা রঙচটা, জং ধরা, ইত্যাদি সারাইয়ের (প্যানেল-বিটার) একজন দক্ষ কারিগর ছিলেন। ফার্দিনান্দের মা ছিলেন আনা পোর্শে (পূর্বে এহরলিচ)। মোট পাঁচ সন্তানের মধ্যে ফার্দিনান্দ তাঁর পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন।
প্রযুক্তিগত নানা বিষয়ের প্রতি খুব ছোট থেকেই প্রবল আগ্রহী ছিলেন তিনি। এমনকি খুব অল্প বয়সেই বিদ্যুৎ বিষয়ে তাঁর কৌতুহল ছিল ভীষণ। মাত্র তেরো বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বাড়িতে একটি ডোরবেল স্থাপন করেছিলেন এবং ষোলো বছর বয়সে সেখানে বৈদ্যুতিক আলোও সংযুক্ত করেন। ম্যাফাসডর্ফে তাঁদের বাড়িতেই প্রথম বিদ্যুৎ এসেছিল ফার্দিনান্দের দৌলতে।
বিদ্যুতের প্রতি তাঁর ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সত্ত্বেও একজন কলমিস্ত্রী হিসেবে শিক্ষানবিশী সমাপ্ত করেন ফার্দিনান্দ। দিনের বেলায় বাবার মেকানিক্যাল দোকানে সাহায্য করার পরে রাত্রিবেলা রেইচেনবার্গের ইম্পেরিয়াল পলিটেকনিক্যাল স্কুলে ক্লাস করতে থাকেন তিনি। এরই মধ্যে ভিয়েনার বিদ্যুৎ কোম্পানি ‘বেলা এগার অ্যান্ড কোং’-এ (বর্তমানে ব্রাউন বোভেরি) চাকরি পেয়ে যান ফার্দিনান্দ এবং ১৮৯৩ সালে চলে যান সেখানে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। সেই ভিয়েনায় কাজ করবার সময় তিনি একজন পার্টটাইম ছাত্র হিসেবে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে প্রবেশ করেন পড়াশুনার জন্য। কাজের পরে অবসর পেলেই সেখানে চলে যেতেন অধ্যয়ন করতে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা ছাড়া পোর্শে কোন আনুষ্ঠানিক ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা সম্পন্ন করেননি।
নিজের উজ্জ্বল প্রতিভার সাহায্যে বেলা এগার কোম্পানিতে একজন কর্মী থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক পদে উন্নীত হন তিনি। পাঁচবছর বেলা এগার কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সময়েই ১৮৯৭ সালে সেখানে ফার্দিনান্দ প্রথম বৈদ্যুতিক হুইল-হাব মোটর তৈরি করেন। এই যানটির ধারণার প্রথম উদ্ভাবক ছিলেন অবশ্য ওয়েলিংটন অ্যাডামস। সেবছরেই অথবা ১৯৯৮ সালে, ভিয়েনায় জেকব লোহনার অ্যান্ড কোং-এ নতুন প্রতিষ্ঠিত ‘ইলেকট্রিক কার ডিপার্টমেন্ট’-এ যোগদান করেন। সেখানে তিনি লোহনার-পোর্শে ডিজাইন করেন, এটি মূলত পোর্শে হুইল-হাব ইঞ্জিন দ্বারা চালিত একটি নন-ট্রান্সমিশন যান। এগনার-লোহনার গাড়িটি দুটি বৈদ্যুতিক মোটর এবং ব্যাটারির সাহায্যে চলত। পিছনের চাকায় আরও দুটি মোটর বসিয়ে পোর্শে সেটিকে ফোর হুইল-ড্রাইভ করে তোলেন। এটি বিশ্বের প্রথম ফোর হুইল-ড্রাইভ কার। ১৯০০ সালে প্যারিস ওয়ার্ল্ড এগজিবিশনে এটি প্রদর্শিত হয় এবং চমকে দেয় বিশ্বকে। এই গাড়ি রেসিংয়েও পরীক্ষা করেছিলেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। সেসময়, ১৯০০ সালে ই. ডব্লিউ. হার্ট নামে একজন ইংরেজ একটি যুগপৎ বৈদ্যুতিক চার-মোটর সম্বলিত এবং পেট্রোল চালিত গাড়ির অর্ডার দিয়েছিলেন লোহনার কোম্পানিকে। ১৯০১ সালে পোর্শে তাঁর লোহনার-পোর্শে মিক্সটে হাইব্রিড গাড়িটির সঙ্গে পরিচয় করান সকলের। এটিই প্রথম পেট্রোলিয়াম-ইলেকট্রিক হাইব্রিড গাড়ি। ফার্দিনান্দ ১৯০১ সালেই এক্সেলবার্গ র্যালি জিতেছিলেন একটি ফ্রন্ট-হুইল ড্রাইভ হাইব্রিড চালিয়ে।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯০৩ সালে ফার্দিনান্দ পোর্শের সঙ্গে বিবাহ হয় অ্যালোসিয়া জোহানা কায়েসের। তাঁদের দুটি সন্তানের মধ্যে কন্যা সন্তানটির নাম লুইস এবং পুত্রের নাম ফার্দিনান্দ অ্যান্টন আর্নস্ট (ফেরি)।
১৯০২ সালে সামরিক চাকরিতে যোগ দেন ফার্দিনান্দ। তিনি অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের চালকের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে এই ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে সেরাজেভোতে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় এবং এই ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। লোহনারে আট বছর কাটানোর পর ১৯০৬ সালে পোর্শে উইনার নিউস্ট্যাডের অস্ট্রো-ডেমলারে টেকনিক্যাল ম্যানেজারের পদে যোগ দেন। তখন অস্ট্রে-ডেমলারের প্রধান ডিজাইনার ছিলেন তিনিই৷ পোর্শের সবচেয়ে পরিচিত অস্ট্রো-ডেমলার গাড়িটি ১৯১০ সালে ডিজাইন করেছিলেন ফার্দিনান্দ ‘প্রিন্স-হেনরিক-ফাহর্ট’ নামক মোটর প্রতিযোগিতার জন্য। সেবছর ফার্দিনান্দই সেই প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছিলেন। ১৯১২-১৩ সালে নির্মিত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান ইলেকট্রিক ট্রেনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন ফার্দিনান্দ। এক্ষেত্রে তিনি অস্ট্রিয়ান কর্নেল-জেনারেল অটোকার ল্যান্ডওয়ের ভন প্রাগেনিউ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯১৬ সালে পোর্শে অস্ট্রে-ডেমলার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। সেবছরই ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট লাভ করেন। পোর্শে ক্রমান্বয়ে রেসিং-এর গাড়ি ডিজাইন করছিলেন তখন। ১৯২২ সালে তাঁর ডিজাইন করা রেসিং গাড়ি ‘সাশা’, ৫৩টি রেসের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করেছিল। উল্লেখ্য যে, টেকনিক্যাল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করার সময় পোর্শে উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন বিমানের ইঞ্জিন এবং বড় ট্র্যাক্টিভ মেশিনের পাশাপাশি ফায়ার ইঞ্জিন, ট্রলি বাস এবং হাইব্রিড পেট্রোল-ইলেকট্রিক ড্রাইভ-সহ অসংখ্য ডিজাইন তৈরি করেন। মতপার্থক্যের কারণে ১৯২৩ সালে পোর্শে অস্ট্রো-ডেমলার কোম্পানি ত্যাগ করেন।
কিছুমাস পরে জার্মানির স্টুটগার্টের ডেমলার মটোরেন গেসেলশ্যাফ্ট টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করবার জন্য পোর্শেকে নিয়োগ করেন। ১৯২৪ সালে স্টুটগার্টের ডেমলার মটোরেন গেসেলশ্যাফ্টে থাকাকালীন টারগা ফ্লোরিও রেসে মার্সিডিজ পিপি-এর সাহায্যে জয়লাভের পরে স্টুটগার্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে আরেকটি সম্মানসূচক ডক্টরেট পান এবং পরে তাঁকে অধ্যাপকের সম্মানসূচক উপাধি দেওয়া হয়। মটোরেন গেসেলশ্যাফ্টে থাকাকালীন বেশকিছু রেসিং কার ডিজাইন করেন তিনি। সেখানেই মার্সিডিজ বেঞ্জ এসএসকে নির্মাণের নেপথ্যের মূল কান্ডারি ছিলেন পোর্শে। সেই গাড়িটি ১৯২০-এর দশকে মোটর প্রতিযোগিতায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯২৬ সালে ডেমলার মটোরেন গ্যাসেলশ্যাফ্ট এবং বেঞ্জ অ্যান্ড সিয়ে একীভূত হয়ে ডেমলার-বেঞ্জে পরিণত হয়। পোর্শে একটি ছোট আকারের ও হালকা ওজনের মার্সিডিজ বেঞ্জের ধারণা উপস্থাপিত করলে ডেমলার-বেঞ্জ বোর্ডে তা সমর্থনলাভে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ পোর্শে ১৯২৯ সালে এই কোম্পানি ত্যাগ করে চলে যান স্টেয়ার অটোমোবাইলে। সেসময় ভয়ানক মানসিক হতাশাবোধ তাঁকে গ্রাস করেছিল৷
১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি স্টুটগার্টের কেন্দ্রে ক্রোনেনস্ট্রাস ২৪-এ পোর্শের নিজস্ব অফিসের জন্য ভাড়ার চুক্তি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকমাস পরে, ২৫ এপ্রিল তারিখে কোম্পানিটি নিবন্ধিত (Registered) হয়েছিল। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর ১০ আগস্ট টরশন বার সাসপেনসন একটি পেটেন্টের জন্য নিবন্ধিত হয়েছিল। এই কোম্পানিই অটোমোবাইল জগতে পোর্শের নামকে চিরস্মরণীয় করে দেয়। কিছু প্রাক্তন সহকর্মীকেও তিনি নিয়োগ করেছিলেন তাঁর কোম্পানিতে। ১৯৩২ সালে ১৬ সিলিন্ডারের একটি গ্র্যান্ড প্রিক্স রেসিং কারের জন্য ওয়ান্ডারারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন পোর্শে। ব্যবসা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিজস্ব ডিজাইনেও কাজ করার পরিকল্পনা করেন তিনি। জীবন বীমার ঋণ নিয়ে পর্যন্ত প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিলেন। অবশেষে আর্থিক দুরাবস্থা এবং গাড়ি কমিশনের অভাবের কারণে পোর্শে রেসিং কার নির্মাণের জন্য একটি সহায়ক কোম্পানি ‘হাই পারফরম্যান্স ইঞ্জিন লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে পরীক্ষামূলক পি ওয়াগেন প্রজেক্ট রেসিং কার ডিজাইন করা হয়েছিল। ১৯৩২ সালে অটো ইউনিয়ন জিএমবিএইচ গঠিত হয়। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, ব্যারন ক্লাউস ভন ওর্টজেন একটি শোপিস প্রজেক্ট চেয়েছিলেন, তাই সহযোগী পরিচালক অ্যাডলফ রোজেনবার্গারের পীড়াপীড়িতে, ভন ওর্টজেন পোর্শের সাথে দেখা করেছিলেন।
ইতিমধ্যে ১৯৩৩ সালে বার্লিন মোটর শো-তে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার জাতিকে মোটোরাইজ করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, প্রত্যেক জার্মানের কাছে ভবিষ্যতে একটি গাড়ি অথবা ট্রাক্টর থাকবে, এই তাঁর উদ্দেশ্য। দুটি নতুন প্রোগ্রাম উন্মোচনের কথাও জানান তিনি। একটি হল, ‘পিপলস কার’ এবং একটি রাষ্ট্র-পরিচালিত মোটর রেসিং প্রোগ্রাম, যা-কিনা ‘হাই স্পীড জার্মান অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি’র উন্নয়নে সহায়তা করবে। ১৯৩৪ সালে পোর্শে হিটলারের থেকে একটি জনগনের গাড়ি ডিজাইন করবার চুক্তি পেয়েছিলেন। প্রথম দুটি প্রোটোটাইপ ১৯৩৫ সালে সম্পন্ন হয়। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯-এর মধ্যে আরও কয়েকটি প্রাক-প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়েছিল। অবশেষে এই চুক্তির ফলস্বরূপই জন্ম হয়েছিল ভোলক্সওয়াগনের। ১৯৩৬ সালে নিজের ভাগ্নে এবং প্রাইভেট সেক্রেটারি ঘিসলাইন কাইসের সঙ্গে পোর্শে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। আসলে ভোলক্সওয়াগেন প্ল্যান্টের জন্য তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমেরিকান অটোমোবাইল উৎপাদন অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন তিনি।
হিটলার চেকদের অমানবিক ঘোষণা করে ১৯৩৪ সালে পোর্শেকে জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে সত্যি সত্যি চেক নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন পোর্শে। ১৯৩৭ সালে তিনি নাৎসি পার্টিতে যোগদান করেছিলেন। তারই পাশাপাশি নাৎসি জার্মানির আধাসামরিক সংস্থা শুটজস্টাফেলেও (এসএস) যোগ দেন। ১৯৩৮ সালে নিজের কারখানায় এই এসএস-কে নিরাপত্তা কর্মী ও ড্রাইভার হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি৷ পরে এসএস স্টার্মওয়ার্ক ভোলক্সওয়াগেন নামে একটি বিশেষ ইউনিট স্থাপন করেন। বিটল নামে পরিচিত গাড়ির ব্যাপক উৎপাদন অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়।
১৯৪২ সালে যুদ্ধ চলাকালীন পোর্শে নির্মাণ করেছিলেন একটি ভারী ট্যাঙ্ক ভিকে৪৫০১ যা টাইগার (পি) নামেও পরিচিত। ১৯৪৩ সালে স্ব-চালিত বন্দুক সমন্বিত ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী ‘এলিফেন্ট’ বা প্যানজারজেগার টাইগারের ডিজাইন তৈরি করেছিলেন তিনি। এছাড়াও প্যানজার সেভেন মউস-এর মতো ভয়ানক ভারী ট্যাঙ্ক নির্মাণ করেন পোর্শে। ১৯৪৫-এর নভেম্বরে পোর্শেকে ফ্রান্সে ভোলক্সওয়াগেনের নকশা চালিয়ে যেতে এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের অংশ হিসাবে কারখানার সরঞ্জামগুলি সেখানে স্থানান্তরিত করতে বলা হয়েছিল। ফ্রান্সে থাকাকালীন তাঁকে আসন্ন রেনল্ট ৪সিভি-এর ডিজাইন এবং উৎপাদনের বিষয়েও পরামর্শ করতে বলা হয়েছিল। ফলে সেসময় রেনল্টের প্রধানের সঙ্গে গুরুতর বিরোধ হয়েছিল। ফরাসী স্বয়লচালিত শিল্পের আপত্তি ভোলক্সওয়াগেনের প্রকল্পটি শুরুর আগেই থামিয়ে দেয়। ১৯৪৫-এর ১৫ ডিসেম্বর ফরাসী কর্তৃপক্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তি পান পোর্শে। যাই হোক, পোর্শে কোম্পানির প্রথম গাড়ি ছিল পোর্শে ৩৬৫। মাত্র ৪৯টি গাড়ি তৈরি করা হয় এবং উল্লেখ্য যে, এই গাড়ি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি। ১৯৪৯ সালে পোর্শে পরিবার স্টুটগার্টে ফিরে আসে। ১৯৫০ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম স্টুটগার্টের নতুন কারখানায় পোর্শে ৩৬৫ উৎপাদিত হয়েছিল। সেবছর নভেম্বরে পোর্শে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পর প্রথমবারের মতো ওল্ফসবার্গ ভক্সওয়াগেন কারখানা পরিদর্শন করেন।
অটোমোবাইলের জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ফার্দিনান্দ পোর্শে নানাসময়ে বিভিন্ন সম্মানীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি শিল্প ও বিজ্ঞানের জন্য নির্ধারিত জার্মান জাতীয় পুরস্কারের প্রাপক ছিলেন। ১৯২৪ সালে টারগা ফ্লোরিও রেসে সাফল্যের জন্য স্টুটগার্টের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ডক্টর ইঙ্ক নামক সম্মানসূচক উপাধি প্রদান করে তাঁকে। ১৯৪০-এ অধ্যাপকের সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত হন। এছাড়াও ওয়ার মেরিট ক্রস কিংবা এস-এস এহরেনিং-এর মতো খেতাব রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।পোর্শে ১৯৯৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল মোটরস্পোর্টস হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন এবং ১৯৯৯ সালে ‘কার ইঞ্জিনিয়ার অফ দ্য সেঞ্চুরি’ হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন।
১৯৫১ সালের ৩০ জানুয়ারি ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ফার্দিনান্দ পোর্শের মৃত্যু হয়।