অবনী লেখারা

অবনী লেখারা

মাত্র নয় বছর আগে ২০১২ সালে এক গাড়ি-দূর্ঘটনায় তাঁর দুটি পা অক্ষম হয়ে পড়ে। দশ বছর বয়সী সেই বালিকা তখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। জীবন তাঁর থেকে কেড়ে নিল তাঁর চলার দুটি পা আর একইসঙ্গে স্বাভাবিক এক মানুষের পরিচয়ের থেকে পঙ্গুত্বের, অক্ষমতার গ্লানিময় পরিচয়কেই আপন করে নিতে হল তাঁকে। ছোট্টো কিশোরীর জীবনের স্বপ্ন ধূসর হয়ে এল। সব রঙ নিভে গেলেও গল্প সাজাচ্ছিল মেয়েটি। দমে যায়নি সে, জীবন থেকে পালিয়ে যায়নি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অক্ষম হয়ে পড়লেও তাঁর প্রাণ ছিল, এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে তাঁর অস্তিস্ত্বের অনির্বাণ দীপ জ্বলছিল তখনও। প্রাণ আছে, তাই আশা আছে। আশা আছে, তাই পিছনে ফেরা নয় – সামনে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মানসিকতায় সেই কিশোরী আজ ভারতকে এনে দিল স্বর্ণপদকের গৌরব। অক্ষমতা কোনো মানুষেরই পরিচয় হতে পারে না, কারণ মানুষের আসল জোর লুকিয়ে থাকে মনে। আর সেই মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়েই উনিশ বছরের কিশোরী অবনী লেখারা আজ প্যারালিম্পিক শ্যুটিংয়ে জিতে নিল স্বর্ণপদক। প্রথম ভারতীয় স্বর্ণপদকজয়ী প্যারালিম্পিয়ান হিসেবে আভানি লেখারা হয়ে উঠলেন অনুপ্রেরণার অপর এক নাম।

২০০১ সালের ৮ নভেম্বর রাজস্থানে জন্ম হয় অবনীর। দশ বছরের একটি মেয়ের জীবনে তখনও কত অভিজ্ঞতা অর্জন বাকি, জীবনকে উপভোগ করা বাকি আর সেই সময়েই ঘটে গেল মর্মান্তিক সেই ঘটনা। স্কুলের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন অবনী। গাড়িতে তাঁর বাবা-মা, ভাই আর ভাইঝিও ছিলেন। কে জানত কোন বিপদ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে আছে! একটি সাঙ্ঘাতিক দুর্ঘটনায় গাড়িটি তিনবার উলটে পাশের একটি চাষজমিতে আছড়ে পড়ে। গাড়ির ভিতরে মাটি-বালি ঢুকে যায়, কাঁচ ভেঙে যায়। অল্প অল্প জ্ঞান থাকলেও চোখ খুলতে পারছিলেন না অবনী। যখন সম্পূর্ণভাবে চেতনা ফিরলো শিরদাঁড়ায় প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করেন তিনি আর বুঝতে পারলেন যেন তাঁর দুটি পায়ে কোনো সাড় নেই। দুর্ঘটনায় আহত তাঁদের সকলকেই তৎক্ষণাৎ নিকটবর্তী যোধপুরের এসএমএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকদের একটি দল অবনীকে পরীক্ষা করে জানান তাঁর পা দুটি দিয়ে তাঁর আর পাহাড় চড়া হবে না, ভাইয়ের সঙ্গে অবসরে খেলা হবে না, স্বপ্নের জন্য দৌড়োতেও পারবেন না হয়তো তিনি আর। ভেঙে পড়েছিলেন অবনী, সেইসঙ্গে পরিবারের সকলেই।

এভাবে ২০১৫ সালে হঠাৎই একদিন তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে যান একটি তীরন্দাজির রেঞ্জে। নবম শ্রেণির ছাত্রী তখন অবনী। সেই থেকেই তীরন্দাজি শিখতে শুরু করেন অবনী। তারপরই শ্যুটিংয়ে আসা তাঁর। প্রথম দশ মিটার রেঞ্জে গিয়ে পাঁচ কেজি ওজনের রাইফেল তুলতে পারছিলেন না তিনি আর সেই অবনীই দীর্ঘ প্রয়াস, আত্মত্যাগ আর কঠোর পরিশ্রমে দক্ষ শ্যুটার হিসেবে পরিচিত হন। প্রথমদিকে নিছক অবসরযাপন হিসেবেই সপ্তাহে একবার বা দুবার শ্যুটিং রেঞ্জে যেতেন তিনি। কিন্তু বাবার উৎসাহেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে শুরু করেন অবনী। প্রথম শুরু হয় স্কুল-প্রতিযোগিতা দিয়ে। তারপর একে একে রাজস্থানের রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতাগুলিতেও অংশ নিতে থাকেন তিনি। এমনকি কেভি ন্যাশনালস প্রতিযোগিতায় শ্যুটিংয়ে সক্ষম শ্যুটারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে একটি স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন তিনি। বাধা ছিল অনেক। মানসিক জোর, আগ্রহ বজায় রাখা যেমন কঠিন ছিল তার পক্ষে, তেমনিই শ্যুটিং করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের খরচ বহন করাও কঠিন ছিল সেই সময়। সাধারণভাবেই শ্যুটিং একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল স্পোর্টস। কিন্তু লক্ষ্যে অটল ছিলেন অবনী। পরবর্তীকালে ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রক, গো স্পোর্টস, পিসিআই ইত্যাদি সংস্থা তাঁর হয়ে সরঞ্জাম কেনার সমস্ত খরচ বহন করে। নিজের একটা রাইফেল কেনার সামর্থ্যও ছিল না তাঁর, প্রথমদিকে ধার করা রাইফেলে অভ্যাস করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে, একাগ্রভাবে কিছু চাইলে সমস্ত বন্ধ দরজা একদিন ঠিকই আস্তে আস্তে খুলে যায়, আশার আলো প্রকটিত হয়ে ওঠে। তাঁর বাবার দেওয়া অভিনব বিন্দ্রার আত্মজীবনীর বইটিই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ভারতীয় স্বর্ণপদকজয়ী শ্যুটার অভিনব বিন্দ্রা হয়ে ওঠেন অবনী লেখারার অনুপ্রেরণা। সেই থেকেই অলিম্পিকের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন তিনি। বিশ্বাস করতে থাকেন চাইলে তিনিও ভারতের হয়ে একজন মহিলা প্যারালিম্পিয়ান হিসেবে স্বর্ণপদক আনতে পারেন। আর প্রথম মহিলা পদকজয়ী শ্যুটার হওয়ার স্বপ্নই সত্যি হল আজ ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে। এর আগে ২০১৭ সালে আইপিসি প্যারা শ্যুটিং বিশ্বকাপে রৌপ্য পদক জয় করেন অবনী আর তার পরের বছর ২০১৮-তে এশিয়ান প্যারা গেমসে আর২, আর৩, আর৬ ও আর৮ বিভাগে অংশ নেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত! ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ওমেন্স ১০ মিটার রাইফেল স্ট্যাণ্ডিং এসএইচ১ খেলায় ২৪৯.৬ স্কোর করে স্বর্ণপদক জিতে নেন অবনী লেখারা যা নতুন এক বিশ্বরেকর্ড গড়ে দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে প্যারালিম্পিকের ইতিহাসে এটা পঞ্চম স্বর্ণপদক জয়। এসএইচ১ শ্রেণিতে প্যারাপ্লেজিক প্রতিযোগীরা অংশ নেয় যেখানে হাতে রাইফেল ধরেই শ্যুট করতে হয়, কেউ বসে শ্যুট করেন আর কেউ বা দাঁড়িয়ে। হুইলচেয়ারে বসে হাতে পাঁচ কেজি ওজনের রাইফেল ধরে পাখির চোখ বিদ্ধ করে স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার পূর্ণ করলেন অবনী লেখারা। ওয়ার্ল্ড শ্যুটিং প্যারা স্পোর্টস র‍্যাঙ্কিং-এ বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম স্থানে আছেন অবনী লেখারা। এখানেই শেষ নয়, অবনী এরপর ওমেন্স ৫০ মিটার রাইফেল শুটিংয়ে ব্রোঞ্জও জেতেন।

শুধুই শ্যুটিং নয়, পাশাপাশি তাঁর স্বপ্ন আইনচর্চা করার। বি.এ এল.এল.বি পড়ছেন অবনী। প্যারালিম্পিকের মঞ্চে আবারো প্রমাণিত হল কোনো বাধাই স্বপ্নের চেয়ে বড়ো নয়। স্বপ্ন দেখা আর তা পূরণ করার লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে যাওয়াই জীবনের অন্যতর অর্থ খুঁজে এনে দেয়। উনিশ বছর বয়সী কিশোরী অবনী লেখারা আজ ভারতের ইতিহাসে আরেক অনুপ্রেরণাদায়ী প্যারালিম্পিয়ান হয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, জীবন পা কাড়লেও স্বপ্নটুকু কেড়ে নিতে পারেনি যার থেকে।

আপনার মতামত জানান