বেসবল খেলা

বেসবল খেলা

সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয় আউটডোর খেলাগুলির মধ্যে অন্যতম হল বেসবল (Baseball)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় খেলা এই বেসবল একটি দলগত খেলা। নয়জন খেলোয়াড়ের দুটি দলের মধ্যে এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতই এখানেও ব্যাট ও বলের ব্যবহার হয়, তবে বেসবলের ব্যাটের আকার একটু ভিন্ন। উত্তর আমেরিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং পূর্ব এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ করিয়া ও তাইওয়ান ইত্যাদি অঞ্চলে বেসবল খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়।

বলা হয় আনুমানিক উনিশ শতকেই এই বেসবল খেলার জন্ম হয়। তবে এ কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইতিহাস বলছে ঐ সময় প্রথম সংগঠিত বেসবল ক্লাব গঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু খেলার সূত্রপাত ঘটেছিল অনেক আগেই। ১৮৪৫ সালে জনৈক ব্রিটিশ আলেকজান্ডার কার্টরাইট প্রথম এই বেসবল খেলার নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করেছিলেন। তবে মনে করা হয় যে এই বেসবল খেলাটি মূলত গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডে প্রচলিত ‘রাউন্ডারস’ নামের এক ধরনের খেলা থেকেই বিবর্তিত হয়ে এসেছে। আমেরিকান বেসবল-ঐতিহাসিক ডেভিড ব্লকও একই মনোভাব পোষণ করেন। ব্লক দেখিয়েছেন ১৭৪৯ সালে সারেতে প্রথম বেসবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে নাকি প্রিন্স অফ ওয়েলস অংশ নিয়েছিলেন। মূলত ইংরেজ অভিবাসীরাই এই খেলার রূপটিকে কানাডায় প্রচলিত করে। ১৮৩০ সাল নাগাদ সমগ্র উত্তর আমেরিকা জুড়ে নানা ধরনের ব্যাট ও বলের খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল যেগুলিকে বেসবলের আদি রূপ হিসেবে মনে করা যায়। ১৮৩৮ সালের ৪ জুন কানাডার অন্টারিওর বিচভিলে প্রথম বেসবল খেলার ইতিহাস নথিবদ্ধ রয়েছে। এর অনেক পরে ১৮৫৮ সালে কয়েকজন অপেশাদার খেলোয়াড় একত্রিত হয়ে প্রথম একটি বেসবল লীগ গড়ে তোলে যার নাম দেওয়া হয় ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বেসবল প্লেয়ার্স’। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই স্থাপিত হয় ‘আমেরিকান লীগ অফ বেসবল’ যার ১৯০১ সাল থেকে নিয়মিত খেলা শুরু হয়। এর মধ্যে আফ্রো-আমেরিকানরা যখন বেসবল খেলতে শুরু করল, তখন তাঁদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হল নিগ্রো লীগ। এরপরে বিশ শতকের প্রারম্ভ পর্যন্ত ছোট-বড় নানা রকম লীগ তৈরি হয়েছিল আমেরিকায়। তখনও পর্যন্ত বেসবল খেলা মূলত অনেক কৌশলের উপর নির্ভরশীল ছিল। ধীরে ধীরে এই নিয়মগুলিও বদলাতে থাকে। সমগ্র বিশ শতক জুড়ে ‘হোম-রান’ (Hitting Home Runs) নেওয়া এই বেসবল খেলার নিয়মের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড় বেব রুথ এই হোম-রানের পদ্ধতিটিকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলেন। এমনকি তাঁর জন্যেই উত্তর আমেরিকায় বেসবল অত্যন্ত বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী লীগগুলি আমেরিকান বেসবলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। এর আগে যদিও ১৯৩৭ সালে স্থাপিত হয়েছে নিগ্রো আমেরিকান লীগ এবং ১৯৩৯ সালে পেনসিলভানিয়ায় লিটল লীগ বেসবল স্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে আমেরিকার বাইরেও এই খেলা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৮৭৮ সালে প্রথম আমেরিকার বাইরে কিউবাতে আনুষ্ঠানিক বেসবল লীগ স্থাপিত হয় এবং ১৯১২ সালে ডোমিনিকান রিপাবলিক প্রথম তাদের দ্বীপের মধ্যে একটি বেসবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। ক্রমে নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মেক্সিকো, পুয়ের্তো রিকো-তেও এই বেসবল খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে বেসবল খেলার খ্যাতি বাড়তে থাকে, বহু লীগ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৯২ সাল থেকে অলিম্পিক গেমসে বেসবল অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে ২০১২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক থেকে বেসবলকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলায় প্রতি দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকলেও, বেসবল খেলায় প্রতি দলে মোট ৯ জন করে খেলোয়াড় থাকেন। খেলার মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিপক্ষ দলের চেয়ে বেশি রান করা এবং তবেই বেসবল ম্যাচ জেতা যায়। এক্ষেত্রে মোট ৯টি ইনিংসে বিভাজিত হয় খেলাটি যেখানে প্রতি ইনিংসেই প্রতিটি দল যথাক্রমে ব্যাটিং ও ফিল্ডিং করে। প্রতিটি ইনিংস আবার ‘টপ’ ও ‘বটম’ এই দুই ভাগে বিভক্ত থাকে। টপ হল যখন বিপক্ষ দল ব্যাট করে আর বটম হল যখন নিজের দল ব্যাট করে। বেসবল খেলার জন্য সমস্ত মাঠটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হয় ৯০ মিটার এবং তা কিছুটা রম্বসাকৃতির হয়। এই মাঠের চার কোনায় চারটি বেস থাকে যা স্পর্শ করে রান নেয় খেলোয়াড়েরা। ব্যাট করে যে দল, তাদের ‘অফেন্স’ এবং অন্য দলকে ‘ডিফেন্স’ বলা হয়। ডিফেন্স দলের যিনি বল করেন তাকে বলা হয় ‘পিচার’ (Pitcher) আর অফেন্স দলের যিনি ব্যাট করেন তাকে বলা হয় ‘হিটার’ (Hitter)। ক্রিকেটের মতই এখানে পিচারের ছোঁড়া বলে আঘাত করেন হিটার। বলে আঘাত করার পর হিটাররা চারটি বেসের যে কোনও একটিতে থামতে পারবে হোম-রান নেওয়ার সময়। এখন ডিফেন্স দল যদি অফেন্স দলের তিনজন হিটারকে আউট করে দেয়, তবে একটি ইনিংস শেষ হয়। অর্থাৎ ইনিংস শেষ করার জন্য তিনজন হিটারকে আউট করা দরকার। মূলত ব্যাট, বল, গ্লাভস ও হেলমেট এই চারটি সরঞ্জাম নিয়ে বেসবল খেলা হয়। পেশাদার বেসবলের আকার গড়ে ৪২ ইঞ্চি হয়ে থাকে এবং বলের রঙ হয় সাদা। ব্যাটের ওজন যেমন হয়ে থাকে ৯৬৩ থেকে ১০২১ গ্রাম, অন্যদিকে বলের ওজন হয় ১৪১.৭৫ থেকে ১৪৮.৮৩ গ্রাম। পুরো খেলায় ব্যাটিং, পিচিং এবং ফিল্ডিং করতে হয় খেলোয়াড়দের। খেলার নিয়ম অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট লাইন আপ মেনে অফেন্স দল তাদের হিটারদের মাঠে নামায়। এক্ষেত্রে হিটার যদি টানা তিনবার বলে আঘাত করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি স্ট্রাইক বা আউট হন। মাঠে নামেন নতুন হিটার। বিভিন্নভাবে পিচাররা বল ছুঁড়ে থাকেন। স্লোয়ার, স্লিম কাট, সিম স্ক্রু ইত্যাদি নানাভাবে একজন পিচার বল ছোঁড়েন যাতে হিটার পরাস্ত হয়। ফিল্ডিং-এর ক্ষেত্রে ক্রিকেটের মত একজন পিচার থাকে হিটারের ঠিক পিছনে বল ধরার জন্য, অন্যদিকে বাকি সাতজন মাঠের বিভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। আক্রমণাত্মক (Offensive) এবং রক্ষণাত্মক (Defensive) দুই ধরনের ফিল্ডিং-ই বেসবলে লক্ষ্য করা যায়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভারতেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর সেনাদের কাছ থেকে মণিপুরের মানুষেরা প্রথম এই খেলাটি শিখেছিল। ১৯৮৩ সালে গড়ে ওঠে ‘দ্য অ্যামেচার বেসবল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’ এবং ১৯৮৫ সালে নয়া দিল্লিতে ভারতের প্রথম জাতীয় বেসবল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হয়। পরে ভারতীয় বেসবল ফেডারেশন আন্তর্জাতিক বেসবল ফেডারেশন এবং এশিয়ার বেসবল ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়। ২০০৬ সালে এমএলবি ইন্টারন্যাশনাল ভারতে প্রশিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে দক্ষ প্রশিক্ষক পাঠায় এবং ভারতের একটি নিজস্ব বেসবল দল গঠন করতে উৎসাহ দেয়। ভারতেরও একটি জাতীয় ফুটবল দল আছে এবং সেই দলের দুই কৃতী খেলোয়াড় রিঙ্কু সিং এবং দীনেশ প্যাটেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেজর লীগের মর্যাদা পেয়েছে। তবে ভারতের ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের মত বেসবল খেলা ততটাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত।      

আপনার মতামত জানান