হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী

হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী

আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ভাষা। এর শব্দ ও সাহিত্য ভান্ডার অপরিসীম। যেকোন উৎকৃষ্ট ভাষার একটি প্রধান সম্পদ হল প্রবাদ ইংরাজিতে যাকে বলে proverb। বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকেই অনেক প্রবাদ লোকমুখে বা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এরকমই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল “হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী”। প্রবাদটির সাধারণ অর্থ নির্বোধ রাজার জ্ঞানহীন মন্ত্রী। অর্থাৎ সোজা বাংলায় দাঁড়ায় নির্বোধ লোকের পরামর্শে চলা নির্বোধ লোক৷ কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকের পরামর্শে কাজ করে কোনও মানুষ যদি হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠে তখন প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়৷ প্রবাদটির উৎস সম্পর্কে কিছু কাহিনী, কিংবদন্তি এবং ইতিহাস রয়েছে৷

সুবলচন্দ্র মিত্র তাঁর সরল বাংলা অভিধানে রঙ্গপুর ভুক্তিতে জানিয়েছেন, “ভবচন্দ্র ও তাহার মন্ত্রী গবচন্দ্র নামে নির্বুদ্ধিতার অবতারস্বরূপে অদ্যাপি জনশ্রুতি জাগাইয়া রাখিয়াছে৷” মন্টেগোমেরি মার্টিনের ১৮৩৮ সালে লেখা ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে রংপুরের রাজা ভবচন্দ্রের কথা আছে৷ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রকাশিত বঙ্গদর্শন পত্রিকাতে কামরূপ-রংপুর প্রসঙ্গে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী নিয়ে প্রচলিত বেশ কিছু হাস্যরসাত্মক কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। তাই প্রবাদটির উৎসস্থল রংপুর ধরা যেতে পারে।

কামরূপ রাজ্যে ধর্মপালের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ থেকে ক্রোশখানেক দূরে রাণী মীনাবতীর গড় ছিল৷ রাণী মীনাবতী হলেন ধর্মপালের ভাতৃজায়া৷ তাঁর পুত্রের নাম ছিল গোপীচন্দ্র৷ গোপীচন্দ্রের রাজা হওয়া নিয়ে ধর্মপালের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাঁধে মীনাবতীর সঙ্গে। মীনাবতী প্রবল প্রতাপের সঙ্গে ধর্মপালের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং ধর্মপালকে পরাভূত করে গোপীচন্দ্রকে সিংহাসনে বসান। গোপীচন্দ্র সিংহাসনে বসেন কিন্তু মীনাবতী তাঁকে রাজ্য শাসন করার অধিকার থেকে সরিয়ে রাখার সমস্ত চেষ্টা চালালেন৷ নামমাত্র রাজা হিসেবে থেকে গেলেন গোপীচন্দ্র। পুত্রকে ভুলাবার জন্য তিনি শত মহিষী এনে দেন অথচ পুত্র তাতে ভোলে না৷ তখন পুত্রকে তিনি ধর্মে মতি দেন তারপর গোপীচন্দ্র যোগধর্ম অবলম্বন করে বনে গমন করেন৷ গোপীচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র ভবচন্দ্র রাজা হন৷ হবচন্দ্র রাজা ও গবচন্দ্র পাত্রের যে কাহিনী গুলি পাওয়া যায় অনুমান করা হয় এই সেই হবচন্দ্র। গল্পে শোনা যায়, পাছে বুদ্ধি বের হয়ে যায় তাই গবচন্দ্র কান নাক বন্ধ করে রাখতেন, এমনকি ভয়ে সিন্দুকে লুকিয়ে থাকতেন৷ রাজার কোন প্রয়োজন হলে সিন্দুক থেকে তিনি বেরিয়ে এসে নাক কান খুলে বুদ্ধি দিতেন৷

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এই হবু রাজার গবু মন্ত্রী নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত আছে। এর একটি এখানে উল্লেখ করাই যায় – হবু রাজার রাজ্যে একদিন দুজন পথিক পুকুরের কাছে এসে আশ্রয় নিল। রাত্রে রান্না করার জন্য পুকুরের পাশের জায়গা পরিষ্কার করে উনুনের জন্য মাটি কাটতে আরম্ভ করল। নগরের রক্ষীবর্গ তা দেখে মনে করল যে, যখন পুকুর থাকতেও তার কাছে আবার খানা কাটছে, তখন অবশ্যই এদের অসৎ অভিপ্রায় আছে। রক্ষীগণ পথিক দুজনকে গ্রেপ্তার করে রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজা নিজে এমন গুরুতর সমস্যার কিছু মীমাংসা করতে না পেরে পরম বুদ্ধিমান গবুচন্দ্র মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। মন্ত্রী মহাশয় সিন্ধুকের ভিতর থেকে বের হয়ে নাক কানের ঢাকা খুলে সমস্ত বিষয় দর্পণের মতাে পরিষ্কার দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, “নিশ্চিত এরা চোর! পুকুরটা চুরি করবার জন্য পাড়ের উপর সিঁধ কাটছিল। এদেরকে শূলে দেওয়া উচিত।” রাজা হবুচন্দ্র, মন্ত্রীর বুদ্ধিতে মুগ্ধ হলেন এবং চোরগুলিকে শূলে চাপাতে বললেন। পুকুর চোরেরা শূলে যাবার আগে নিজেদের মধ্যে কিছু পরামর্শ করে হঠাৎ পরস্পর ঠেলাঠেলি, মারামারি আরম্ভ করল। রাজা ও রাজমন্ত্রী এই বিচিত্র কাজ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “ব্যাপার কী?” তখন একজন চোর বলল যে, “হে মহরাজা! দেখুন, দুই শূলের মধ্যে একটি বড়, একটি ছোট। আমরা জ্যোতিষ জানি ও গনণা করে দেখেছি আজ যে বড় শূলটিতে চড়ে মারা যাবে সে পরের জন্মে গোটা পৃথিবীর রাজা হবে আর যে ছোট শূলটিতে মারা যাবে সে হবে রাজার মন্ত্রী। তাই আমি চাই ঐ বড় শূলটিতে চড়ে মরতে ও পরজন্মে রাজা হতে কিন্তু এই হতভাগা আমাকে ঠেলে নিজে বড় শূলে চড়তে চাইছে”। তখন দ্বিতীয় চোর বলল, “ও কে মহারাজ, যে ও রাজচক্রবর্তী হবে আর আমি ওর মন্ত্রী হব! আমি রাজা হব”। সেই সব শুনে রাজা হবুচন্দ্র রেগে গিয়ে বললেন, ‘এত বড় সাহস তোদের! আমি থাকতে তোরা রাজা হবি!” বলে পাহারাদারদের আদেশ দিলেন চোরদেরকে ছেড়ে দিতে এবং তিনি ও মন্ত্রীমশাই পরজন্মে রাজ চক্রবর্তী রাজা ও তার মন্ত্রী হতে শূলে চড়লেন। এই ভাবে তাঁদের ভবলীলা সাঙ্গ হল।

এই ধরনের ছোট ছোট গল্প লোকমুখে প্রচলিত৷ এগুলি ইতিহাস নয় সত্য ঘটনাও নয় কেবল লোকমুখে প্রচলিত কিছু মজার ঘটনা৷ রাজরাজরাদের সম্পর্কে এমন মজার নির্বুদ্ধিতার গল্প লোকমুখে প্রচলিত হয়ে এসেছে৷ এমন রাজাদের হাত ধরেই রাজ্য চলে বলে লোকবিশ্বাস ছিল৷ রাজারাই বোধহয় এমন মূর্খ হয়ে থাকেন এবং তাতে দেশের বিশেষ ক্ষতি নেই৷ এই প্রবাদটির চরিত্রদেরকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা রয়েছে “জুতা আবিষ্কার”।

উদাহরণ – পায়ে ধুলো লাগলে পা না ঢেকে পৃথিবী চামড়া দিয়ে ঢাকতে যাওয়ার পরামর্শ হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী-ই একমাত্র দিতে পারে।

তথ্যসূত্র


  1. প্রবাদের উৎস সন্ধান - সমর পাল, শোভা প্রকাশ / ঢাকা ; ১৬৬ পৃঃ

আপনার মতামত জানান