চেনা বামুনের পৈতা লাগে না

চেনা বামুনের পৈতা লাগে না

আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ভাষা, এর শব্দ ও সাহিত্য ভান্ডার অপরিসীম। যেকোনো উৎকৃষ্ট ভাষার একটি প্রধান সম্পদ হল প্রবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে proverb। বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকেই অনেক প্রবাদ লোকমুখে বা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই রকমই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল “চেনা বামুনের পৈতা লাগে না”। এর অর্থ হল স্বনামখ্যাত ব্যক্তির পরিচিতির প্রয়োজন হয় না। প্রকৃত ব্রাহ্মণ অর্থে উচ্চ ও শিক্ষিত সম্প্রদায়কে বোঝায় এবং পৈতে’র অর্থ পবিত্রতা। কিন্তু উল্লেখিত এই গুণগুলি ছাড়াও কেবলমাত্র লোক দেখানো পৈতা বা সুতা ধারণ করে অনেকেই বামুনের পরিচয় তৈরি করে থাকে।

প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণদের মধ্যে কতকগুলি বিশেষ গুণ বর্তমান ছিল। “যোগস্তপো দমো দানং ব্রতং শৌচং দয়া ঘৃণা। বিদ্যা বিজ্ঞানমাস্তিক্যমেতদ্‌ ব্রাহ্মণলক্ষণং।।” অর্থাৎ, যোগ, তপ, দম (শাসন বা নিয়ন্ত্রণ), দান, ব্রত, শৌচ (পবিত্রতা), দয়া, ঘৃণা, বিদ্যা, বিজ্ঞান, আস্তিক্য (শাস্ত্রে আস্থাশীল) – এই গুণগুলো হল প্রকৃত ব্রাহ্মণের লক্ষণ। তাঁরা বেদ অধ্যয়ন করতেন, বেদের পূজা করতেন। কুলীন ব্রাহ্মণদের লক্ষণ হল “আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনং। নিষ্ঠাবৃত্তিস্তপোদানং নবধা কুললক্ষণম”। অর্থাৎ, সদাচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, শাস্ত্রপাঠ, তপ ও দান – এই নয়টি গুণ কুলীন ব্রাহ্মণের লক্ষণ। এই নয়টি গুণের প্রতীক হল পৈতা বা নয়টি সুতা। পৈতার আরেক নাম নগুণ। কিন্তু বর্তমান সমাজে এই গুণগুলি না থাকলেও ব্রাহ্মণের সন্তানকে উপনয়নের মাধ্যমে পৈতা বা নগুণ ধারণ করানোর প্রথা রয়েছে। কিন্তু প্রাচীনকালে বেদবিদ ব্রাহ্মণরা এইভাবে পৈতা বা যজ্ঞসূত্র ধারণ করতেন না।

নবব্রাহ্মণ্যযুগের আগে অর্থাৎ মোটামুটি ১১৫০ সালের আগে পৈতা বা যজ্ঞসূত্রের এরকম বহুল ব্যবহার ছিল না। দেশের সমাজ গড়তে শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের অবদান ছিল অপরিসীম। সেখানে পৈতা বামুনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এবং ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই তাকে পৈতা প্রদানের প্রথাও ছিল না। যথেষ্ঠ যুক্তি, বিদ্যা, শিক্ষা দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে হত। এমনকি বৈদিক যুগের অনেক সময় পরেও শুধুমাত্র পৈতা কাঁধে ঝুলিয়ে নিজেদের ব্রাহ্মণ প্রমাণ করা খুব একটা সহজ ছিল না। সবসময় গলায় পৈতা ঝুলিয়ে রাখাও সেসময় খুব প্রয়োজন ছিল না এমনকি ঘরে ঘন ঘন পূজা অর্চনার সময় পৈতার অবর্তমানে উত্তরীয় গলায় চাপিয়েও কাজ চালানো যেত। একমাত্র কোনো যজ্ঞঅনুষ্ঠান করার সময় পৈতা ব্যবহার করার নিয়ম ছিল। এই কারণে পৈতার আরেক নাম যজ্ঞসূত্র।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

নবব্রাহ্মণ্য যুগের পর হিন্দু ধর্মের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। বর্তমানে যে কোনো ধর্মকার্যের সময় পৈতা ব্যবহারের নিয়ম চালু হয়েছে। পূর্বে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে অনেক ব্রাহ্মণকেই পৈতা ত্যাগ করতে দেখা গিয়েছিল। এই ধর্মে জ্ঞান বিতরণ ছিল আসল উদ্দেশ্য। পুনরায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবের ফলে পৈতা ঝোলানো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চৈতন্যমহাপ্রভুর সময়কালে পৈতা বিষয়টির এত বাড়াবাড়ি ছিল না। সেই সময়েও শাস্ত্র ও জ্ঞানের মাধ্যমেই নিজেদের পণ্ডিত ব্রাহ্মণ প্রমাণ করতে হত। প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায় চৈতন্যমহাপ্রভু পূর্ববঙ্গে ভ্রমণ করার সময় তার স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীকে তাঁর স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ গলার পৈতে ও পাদুকা জোড়া উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ প্রমাণের জন্য নিমাইকে পৈতে ঝুলিয়ে যাত্রা করতে হয়নি। কারণ তখন শাস্ত্র, জ্ঞান, বিদ্যা, সংস্কৃত জ্ঞান এই সবের যোগ্যতা বিচারে সমাজে ব্রাহ্মণদের স্থান নির্ণয় করা হত। অহরহ এতো পৈতের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সর্বত্র এই সব বিষয়ের খুবই অভাব। তাই অন্তর্নিহিত জ্ঞানের থেকে বাহ্যিক ও লোক দেখানো পন্ডিতদের বেশি প্রাধান্য থাকায় চেনা বামুনের পৈতা লাগে না এই প্রবাদটির প্রয়োগ করা হয়েছে।

উদাহরণ – কোট প্যান্ট টাই লাগিয়ে অনেকেই নিজেকে পন্ডিত বলে জাহির করতে চায়, কিন্তু প্রকৃত পন্ডিতরা বেশ-ভূষা নিয়ে মাথা ঘামান না, কেননা তাঁরা জানেন চেনা বামুনের পৈতা লাগে না।

তথ্যসূত্র


  1. প্রবাদের উৎস সন্ধান - সমর পাল, শোভা প্রকাশ / ঢাকা ; ৬৬-৬৭ পৃঃ

আপনার মতামত জানান