আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ভাষা, এর শব্দ ও সাহিত্য ভান্ডার অপরিসীম। যেকোনো উৎকৃষ্ট ভাষার একটি প্রধান সম্পদ হল প্রবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে proverb। বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকেই অনেক প্রবাদ লোকমুখে বা সাহিত্যে প্রচলিত আছে। এই রকমই একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হল “কাকতালীয় ব্যাপার”। এই প্রবাদটির অর্থ হল পরস্পর সম্পর্কহীন অথচ একইসাথে সংঘটিত হওয়া ঘটনা। যা দেখে আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতেই পারে প্রথম ঘটনাটির সাথে দ্বিতীয় ঘটনার সমাপতন ঘটেছে। এই প্রবাদটির উল্লেখ গৌতম-সংহিতা নামক দর্শনশাস্ত্রে পাওয়া গিয়েছে। বর্তমান ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এই প্রবাদটির প্রয়োগ করে থাকি।
‘কাকতালীয়’ এই বাগভঙ্গীটির উৎপত্তি প্রধানত ‘কাক’ ও ‘তাল’ এই শব্দদুটির থেকে। কাক ও তালের পরস্পর কোনো সম্বন্ধ না থাকলেও আশ্চর্যজনক ভাবে একই সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাই কাকতালীয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন একটি কাক উড়ে এসে তাল গাছে বসল এবং ঠিক সেই সময়েই গাছ থেকে একটি তাল নিচে পরে গেল। ঘটনা হল কাকটি গাছে না বসলেও তালটি গাছ থেকে নিচে ঝরে পড়ত। কিন্তু কাকের গাছে বসার সময় ও তালের মাটিতে ঝরে পড়ার দৃষ্টান্ত দুটি ঘটনাচক্রে একই সময়ে ঘটায় এটিই কাকতালীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ কার্যকারণহীন যেকোনো ব্যাপারই হল কাকতালীয় ব্যাপার।
কাকতালীয় বিষয়টি আবার দর্শনশাস্ত্রের (philosophy) একটি যুক্তিমূলক অঙ্গ। আবার দর্শনশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ন্যায়শাস্ত্র বা তর্কশাস্ত্র (Logic)। অর্থাৎ যেকোনো বিষয়কে যুক্তির মাধ্যমে সঠিক প্রমাণ করা। প্রাচীনকালে মহর্ষি গৌতম গৌতম-সংহিতা নামে দর্শনশাস্ত্র রচনা করেছিলেন। তারই অংশ হল ন্যায়শাস্ত্র বা তর্কশাস্ত্র। এই ন্যায়শাস্ত্রে অনেকরকম ন্যায় বা যুক্তির উল্লেখ থাকত। এইসব যুক্তি বা ন্যায়ের মধ্যে কাকতালীয় ন্যায় একটি। এই ধরনের ঘটনায় প্রকৃত কারণ না থাকলেও এই ঘটনা ঘটার নেপথ্যে যেকোনো কারণকে উল্লেখ করার যে যুক্তি বা ন্যায় বিশ্লেষণ করা হত সেটাই হল কাকতালীয় ন্যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, কোনো এক গরীব বাবা তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করল। কিন্তু পাত্রপক্ষের চাহিদা মতো পণ দিতে না পারায় বিয়ের দিনেই পাত্রপক্ষ মেয়েটির সাথে বিয়ে ভেঙে দিল। এখানে দেখার বিষয় যে, পাত্রপক্ষের বাড়িতেও কিন্তু বিবাহ উপযুক্তা কন্যা ছিল। তারাও তাদের মেয়ের বিয়ে এক বিত্তশালী পরিবারে পাকা করেছিল। কিন্তু বিত্তশালী পরিবারের চাহিদা মতো পণ দিতে না পারায় তারাও এই পরিবারের সাথে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এখানে দুটো ঘটনার সাথেই স্থান ও কালের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও ঘটনাদুটো কিন্তু একই রকমের। এটি এক প্রকার কাকতালীয় ন্যায়।অন্য আরেকটি উদাহরণ, অনেকদিন ধরে হয়ত কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর কথা খুব মনে হচ্ছে। ক’দিন বাদে দূরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে একই জায়গায় ও একই হোটেলে সেই বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া কাকতালীয় ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছু নয়।
পৃথিবীতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ও মজার কাকতালীয় ঘটনা আছে, তারই একটি হল –
মহান লেখক মার্ক টোয়েনের জন্ম ১৮৩৫ সালে, হ্যালির ধুমকেতু আবির্ভাব হয় সেই দিনেই। ৭৬ বছর পর ঠিক যখন আবার হ্যালির ধুমকেতুর আবির্ভাব হয় ঠিক সেদিনই ১৯১০ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর এক বছর আগে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি হ্যালির ধুমকেতুর সাথে এসেছেন, আশা রাখেন পরের বছর ধুমকেতুর সঙ্গে তিনি চলে যাবেন। হ্যালির ধুমকেতু এই মহান লেখককে আশাহত করেনি! পরের বছরই তার মৃত্যু হয়৷ এই ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক আপেক্ষিকভাবে না থাকলেও ঘটনা পরম্পরায় যা দাঁড়াচ্ছে তাই হল কাকতালীয় ঘটনা।