ভোলা

ভোলা জেলা

বাংলাদেশ ৬৪টি জেলাতে বিভক্ত। বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশ কে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল ভোলা ( Bhola) ।

বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল ভোলা জেলা। এই জেলার আগের নাম ছিল  দক্ষিণ শাহবাজপুর। বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা হল ভোলা। জেলা প্রশাসন এই জেলাকে কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেছে। এছাড়াও ভোলা জেলা নারকেল, মোষের দুধের দইয়ের জন্যও বিখ্যাত।

ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে এই জেলার উত্তরে বরিশাল জেলা ও মেঘনা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী ঘিরে রয়েছে সমগ্র জেলাটিকে।  ভোলা জেলা যেহেতু একটি দ্বীপ জেলা এই জেলার চারদিক জলে বেষ্টিত। এই জেলায় মূলত দুটি নদীর অবস্থান লক্ষ্য করা যায়- মেঘনা ও তেঁতুলিয়া। ভোলার পূর্ব ও উত্তর দিক বরাবর মেঘনা এবং পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া প্রবাহিত। ভোলার দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থান করছে। মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও বঙ্গোপসাগরের উপকুলে গড়ে ওঠা প্রায় ৯০ মাইল দৈর্ঘ্য ও ২৫ মাইল প্রস্থ বিশিষ্ট এই ভূখন্ডের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো যেদিকে চোখ যায় সব দিকে কেবলই সমতল ভূমি। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভোলা প্রায় ৩,৪০৩.৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার বিচারে ভোলা জেলা সমগ্র বাংলাদেশে তেত্রিশতম জনবহুল জেলা। এই জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭,৭৬,৭৯৫ জন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৫২২ জন। ভোলা বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাচীন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। ১৮৪৫ সালে নোয়াখালী জেলার অধীনে সাব ডিভিশন হিসেবে ভোলা প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছিল। পরবর্তীকালে জেলা হিসেবে ভোলা স্বীকৃতি পায় ১৯৮৪ সালে। ভোলা জেলা মোট ৭টি উপজেলা এবং ৬৮ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।

এই জেলার নাম ভোলা হল কীভাবে সেই ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন জনশ্রুতি ভিড় করেছে। তেমনি একটি জনশ্রুতি অনুসারে আজকে ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবহমান বেতুয়া খালটি একসময় যথেষ্ট প্রশস্ত ছিল। তখন এটি পরিচিত ছিল বেতুয়া নদী নামে। এই নদীতে ভোলা গাজি পাটনি নামে এক বৃদ্ধ মাঝি খেয়া পারাপার করত। এই ভোলা গাজির নামানুসারেই এই জেলার নাম ভোলা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। মজার ব্যাপার হল এই জেলার অন্যান্য উপজেলার নামকরনও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে করা হয়েছে যেমন- দৌলতখাঁ, বোরহানউদ্দিন, তজুমুদ্দি ও লালমোহন। এই জেলার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় একসময় এই অঞ্চলে উৎপাদিত ধান, চাল, সুপুরি, নারকেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একের পর এক বিদেশী শাসক ও পর্তুগীজ জলদস্যুর এখানে আগমন হয়। মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুরা এই দ্বীপটিকে ঘাঁটি বানিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অবাধ লুটপাট চালিয়ে যেত।

এই জেলার কথ্য ভাষার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে শুদ্ধ বাংলা ভাষাই প্রচলিত। এখানে নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভাষা না থাকলেও জেলার পশ্চিমের কিছু এলাকায় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

এই জেলায় প্রচুর পরিমানে ইলিশ চাষ হয় যা এই অঞ্চলের মানুষের চাহিদা পূর্ণ করার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য জেলায় এমনকি বিদেশেও রপ্তানী হয়। এছাড়া এই জেলার চরফ্যাশন, তজুমুদ্দিনসহ অন্যান্য উপজেলায় বাগদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। এখানকার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় প্রাপ্ত গ্যাসীয় জ্বালানী সম্পদকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য এখানে একটি সার কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ভোলার দক্ষিণে চর কুকরী মুকরী, ঢালচর, লতার চর ও চর নিজাম সহ অসংখ্য চর পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নাম করেছে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলা। এখানকার দ্বীপগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেঘভাষান, আইচা, লেতরা, কচ্ছপিয়া,  চরকিশোর, নীল কমল, মায়ারচর, চর ফকিরা, লক্ষ্মীপক্ষী, চরমঙ্গল প্রভৃতি। ভোলা জেলার পর্যটন মানচিত্রে হযরত উজির আলী শাহ্ করণীর (রহঃ) দরগা ও মাজার শরীফ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলায় নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ও অত্যাধুনিক নিজাম হাসিনা মসজিদ। আইফেল টাওয়ারের আদলে নির্মিত জ্যাকব টাওয়ার (Jacob Tower) বা চরফ্যাশন টাওয়ার ভোলা জেলার চরফ্যাশনে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। এছাড়া পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি, জলেশ্বরী রিসর্ট, গলাকাটা মসজিদ, সাহেব বাড়ি রিসর্ট, শামসের গাজীর দিঘী এখানকার উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। 

আপনার মতামত জানান