চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage) একজন ব্রিটিশ বহুমুখী প্রতিভা যিনি কম্পিউটারের জনক হিসেবে তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি একাধারে গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, আবিষ্কারক ও যন্ত্রবিদ ছিলেন৷
১৭৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর লন্ডনে চার্লস ব্যাবেজের জন্ম হয়৷ তাঁর জন্মস্থানটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে৷ অক্সফোর্ড ডিক্সনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি অনুযায়ী — ইংল্যান্ডের লন্ডন, ওয়ালওয়ার্থ রোডে ৪৪ ক্রসবি রো’তে জন্ম হয় ব্যাবেজের। লারকম স্ট্রিট এবং ওয়াল ওয়ার্থ রোডের সংযোগস্থলে একটি নীল রঙের ফলক তৈরী করা হয়েছে ব্যাবেজের জন্মসালটিকে সম্মান জানিয়ে৷
ব্যাবেজের পরিবার ১৮০৮ সালে টেগেন মাউথের পুরোনো রোডেন্স মাউথের বাড়িতে উঠে এলে ব্যাবেজ দক্ষিণ ডিভনের টোটনেসে কিং এডওয়ার্ড সিক্স গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি স্কুল ত্যাগ করে গৃহ শিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন শুরু করেন৷ পরবর্তীকালে ব্যাবেজ রেফারেন্ড স্টিফেন ফ্রিম্যানের অধীনে মিডফিলস ও এনফিল্ড বেকার স্টিটে তিরিশজন শিক্ষার্থীর সাথে হলমউড একাডেমিতে ভর্তি হন৷ এই একাডেমির নিজস্ব একটি গ্রন্থাগারে থাকা গণিত সংক্রান্ত বই পড়তে পড়তে ব্যাবেজের গণিতের প্রতি ভালবাসা জন্মে যায়৷ চার্লস ব্যাবেজ একাডেমি ছেড়ে দেওয়ার পরেও আরো দুজন শিক্ষকের সাথে পড়াশুনোর জন্য যোগাযোগ রেখেছিলেন৷ এঁদের মধ্যে ছিলেন কেমব্রিজের কাছেই থাকা একজন ধর্মযাজক। এরপর চার্লস ব্যাবেজ কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তির আগেই সমসাময়িক গণিতের বেশ কিছু অধ্যায় নিজে থেকেই অধ্যায়ন করে নেন তিনি।কলেজ জীবনে চার্লস ব্যাবেজ বেশ অনেকগুলি কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৮১২ সালে তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে অ্যানালিটিক্যাল সোসাইটি গঠন করেন। এছাড়াও অলৌকিক ঘটনার তদন্তের জন্য ‘দ্য গোস্ট ক্লাব’ এর মতো অন্যান্য সমিতির সদস্যও ছিলেন। ব্যাবেজ ১৮১২ সালে কেমব্রিজের পিটারহাউসে শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হলেও তিনি অনার্স নিয়ে স্নাতক পাশ করেননি। বদলে ১৮১৪ সালে পরীক্ষা ছাড়াই একটি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
চার্লস ব্যাবেজের কর্মজীবন শুরু হয় খ্যাতির মধ্যে দিয়েই। ব্যাবেজ ১৮১৫ সালে জ্যোতির্বিদ্যার ওপর রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে বক্তৃতা দেন এবং ১৮১৬ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। এই বছরেই হেইলিবারি কলেজের শিক্ষক পদে তিনি আবেদন করেও শেষ পর্যন্ত চাকরি পাননি। ব্যাবেজ ১৮১৯ সালে প্যারিস এবং সোসাইটি অফ আর্কুইয়েল পরিদর্শন করেন এবং শীর্ষস্থানীয় ফরাসি গণিতবিদ এবং পদার্থবিদের সাথে বৈঠকও করেন। এরপর তিনি পিয়ের সাইমন ল্যাপ্লেসের পরামর্শে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার জন্য আবেদন করলেও শেষ অবধি তা অধরাই থেকে যায়। ব্যাবেজ জন হার্শেলের সাথে ১৮২৫ সালে প্রকাশিত আরগো’র আবর্তনের(Arago’s rotations) ওপর কাজ করেছিলেন। এপ্রসঙ্গে তাঁদের ব্যাখ্যাগুলিকে মাইকেল ফ্যারাডে পরে বিশদে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
ব্যাবেজের জীবনের সেরা কৃতিত্ব হল তিনিই প্রথম কম্পিউটারের প্রাথমিক রূপ তৈরী করেন৷ ব্যাবেজ ১৮২০ সালে ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’ নামে ছয় চাকার একটি গণকযন্ত্রের মডেল তৈরি করেন। এরপর ব্যাবেজ আরও বড় ও জটিল গণকযন্ত্র অ্যালালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরি করেন যেটি ছিল আধুনিক কম্পিউটারের আদি অবস্থা। এই যন্ত্রের মধ্যে থাকা পাঞ্চকার্ডগুলির সাহায্যে কোনও গণনা সম্পাদন করা হত। এই যন্ত্রটি এমন ভাবে তৈরি করেছিলেন তিনি যেখানে ইনপুট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল ও সেই সাথে একটি মেমরি ইউনিটও ছিল। ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যাডা লাভলেস অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন।
ব্যাবেজের কৃতিত্বের গুরুত্ব সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্রিটেনের গবেষকরা ২০১১ সালে ব্যাবেজের অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন তৈরির জন্য ‘প্ল্যান ২৮’ নামে প্রস্তাব করেন। এটির মেমরি ৬৭৫ বাইটের মতন হবে এবং প্রায় ৭ হার্জের ঘড়ির গতিতে চলবে। ব্যাবেজের কৃতিত্ব ও জীবন কাহিনী নিয়ে ২০০৮ সালে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি হয় যার নাম ‘ব্যাবেজ’। এছাড়া ভিডিও গেম, অ্যানিমেশন, বিবিসি সিরিজ তৈরি হয়েছে। ব্যাবেজের মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ লন্ডনের দ্য সায়েন্স মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। তাঁকে নাইটহুড দেওয়া হলে তিনি নিতে অস্বীকার করেন। ব্যাবেজ বিশেষ সম্মান রয়্যাল গুয়েলপিক অর্ডার এবং রয়্যাল সোসাইটির ফেলো অর্জন করেছিলেন। তাঁর সমস্ত অসম্পূর্ণ কীর্তি লন্ডনের ‘সায়েন্স মিউজিয়ামে’ ১৯৯১ সালে অনুরাগীদের জন্য প্রদর্শন করা হয়েছে।
চার্লস ব্যাবেজের ১৮৭১ সালে ১৮ অক্টোবর, ৭৯ বয়সে মৃত্যু হয়৷ তাঁর সমাধি আছে লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সমাধিলয়ে।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.britannica.com/
- https://www.computerhistory.org/
- http://www.bbc.co.uk/
- http://www.charlesbabbage.net/
- https://www.anandabazar.com/
