ডার্ক এনার্জি

ডার্ক এনার্জি ।। তমোশক্তি

এই বিরাট বিপুল মহাবিশ্বে যে কত লক্ষ লক্ষ ছায়াপথ রয়েছে আর তার মধ্যে কয়েক কোটি গ্রহ, উপগ্রহ কিংবা আরও কোনও মহাজাগতিক পদার্থ রয়েছে তার পরিমাণের ধারণা করাও শক্ত। বলা হয় মহাসমুদ্রে যেমন হিমশৈলের চূড়াটুকু যত ক্ষুদ্র দেখা যায়, তার নীচে অতল সাগরের গভীরে লুকিয়ে থাকে হিমশৈলের বাকি বিপুল অংশ। ঠিক সেভাবেই বিজ্ঞানীদের মতে এই বিপুল অসীম মহাবিশ্বে উপস্থিত উপাদানগুলির মোট ভরশক্তির মাত্র ৫ শতাংশই এখনও পর্যন্ত দৃশ্যমান হিসেবে আবিষ্কার করা গিয়েছে। বাকি ৯৫ শতাংশ রয়ে গিয়েছে আজও রহস্যের অতল অন্ধকারে। এই গুপ্ত ভরশক্তি নিয়েই বহু বহু সময় ধরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। সেই গবেষণা থেকেই উঠে এসেছে ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থ (Dark Matter) এবং ডার্ক এনার্জি তথা তমোশক্তির (Dark Energy) বিষয়টি। অজানা, অচেনা অনাবিষ্কৃত এই ডার্ক এনার্জি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে আজও সন্দেহের মেঘ কাটেনি।

বিগ ব্যাং তত্ত্বে বলা হয় যে আজ থেকে ১৩৮০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সমস্ত ভর একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘সিঙ্গুলারিটি’ (Singularity)। পরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের কারণে এই ঘনীভূত বা কেন্দ্রীভূত ভরশক্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মহাবিশ্বের এই বিস্ফোরণকেই বিগ ব্যাং বলা হয়। তারপর ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী এডুইন হাব্‌লের হাব্‌ল টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা গেল এই মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। এই সম্প্রসারণের জন্য নিশ্চিতভাবে কোনও ভর-শক্তি দায়ী আর সেই ভর-শক্তিকেই বলা হল ডার্ক এনার্জি এবং ডার্ক ম্যাটার। ১৯৯৮ সাল নাগাদ কয়েকজন বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন যে একটি বিশেষ সুপারনোভা পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার গতিবেগও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা বুঝতে পারলেন যে মহাবিশ্বের ত্বরণ ঘটছে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ফলে তার গতি কমার পরিবর্তে বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখানেই বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন রাখলেন যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের আড়ালে নিহিত কোনও শক্তি নিশ্চিত রয়েছে। আর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস খুঁজতেই ডার্ক এনার্জির ধারণা তৈরি হয়। ডার্ক ম্যাটারের সঙ্গে ডার্ক এনার্জির অনেকাংশে অমিল রয়েছে, ফলে দুটি বিষয় একেবারেই সমগোত্রীয় নয়। সহজ করে বলতে হলে, ডার্ক ম্যাটার একটি আকর্ষণমূলক বল যা পদার্থকে নিজের কেন্দ্রের দিকে টানে আর অন্যদিকে ডার্ক এনার্জি হল একপ্রকার বিকর্ষণমূলক বল যা পদার্থকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। এই মহাবিশ্বের গুপ্ত ভর-শক্তির পরিমাণ যেখানে ৯৫ শতাংশ, তার মধ্যে ডার্ক এনার্জির পরিমাণ ৬৮ শতাংশ। বিজ্ঞানের ভাষায় ডার্ক এনার্জি হল শূন্যস্থানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে মহাবিশ্বে শূন্যস্থান বলে কিছুই হয় না। পরবর্তীকালে তাঁর মহাকর্ষ সূত্রে যে মহাজাগতিক ধ্রুবকের (Cosmological Constant) কথা বলা হয়, তা থেকে জানা যায় প্রতিটি শূন্যস্থানের নিজস্ব শক্তি রয়েছে। যত বেশি পরিমাণে স্পেস বা শূন্যস্থান তৈরি হবে, তত বেশি পরিমাণে এই স্থানের গুপ্ত অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি গোচরে আসবে। মহাকর্ষীয় বলের ঠিক বিপরীত এই ডার্ক এনার্জি দুটি বস্তুকে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের মধ্যে আরও শূন্যস্থান তৈরি করে। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার কারণে মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জির পরিমাণও বাড়ছে যার ফলে ছায়াপথগুলি আরও বেশি পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করে একে অপরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এই কারণেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি কমার বদলে ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

‘কোয়ান্টাম থিওরি অফ ম্যাটার’ (Quantum Theory of Matter) অনুযায়ী, মহাবিশ্বে শূন্য স্থান কতগুলি অস্থায়ী কণায় পূর্ণ থাকে যা অনবরত তৈরি হয় এবং অদৃশ্য হয়। পদার্থবিজ্ঞানীরা এই শূন্যস্থানের শক্তি নির্ণয় করার চেষ্টা করলে দেখা যায় তাদের প্রাপ্ত উত্তর আসল উত্তরের প্রায় ১০১২০ গুণ বেশি দাঁড়ায় যা এক কথায় অকল্পনীয় প্রমাদ। এই ডার্ক এনার্জিকে অনেকে আবার ‘ডায়নামিক এনার্জি ফ্লুইড’ বা ফিল্ড (Dynamic Energy Fluid) বলে দাবি করছেন। এটিও শূন্যস্থানকে পূর্ণ করে রাখে, কিন্তু মহাবিশ্বের সম্প্রসারণে সাধারণ পদার্থের একেবারে বিপরীতধর্মী প্রভাব ফেলে। অনেকেই একে গ্রিক দার্শনিকদের পঞ্চম উপাদানটির ন্যায় ‘কুইন্টেসেন্স’ (Quintessence) নামে চিহ্নিত করেছেন। এই কুইন্টেসেন্সের সঙ্গে আবার আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বটির মহাজাগতিক ধ্রুবকের অমিল লক্ষ্য করা যায়। ফলে আদপে ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি ঠিক কীরূপ তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা আজ পর্যন্ত কোনও স্থির সত্যে এসে উপনীত হয়নি।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

বিজ্ঞানীরা এই ডার্ক এনার্জিকে তাই প্রকৃতির পঞ্চম মৌলিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা কিনা মহাবিশ্বকে তরলের মত পূর্ণ করে। ১৯৮০ সালে বিজ্ঞানী অ্যালান গুথ এবং অ্যালেক্সি স্টারবিনস্কি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে একটি নেতিবাচক চাপ ক্ষেত্রে (Negetive Pressure Field) এই ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের একেবারে প্রাথমিক দশায় মহাজাগতিক স্ফীতিকে ত্বরান্বিত করে। তবে এখনও পর্যন্ত এই ডার্ক এনার্জি আর স্ফীতির মধ্যে কোনও সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

আপনার মতামত জানান