পৃথিবীর সব বিখ্যাত এবং সফল অভিযাত্রীদের তালিকায় নিঃসন্দেহে উপর দিকে স্থান করে নেওয়ার যোগ্য হলেন পর্তুগীজ অভিযাত্রী ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান (Ferdinand Magellan)। সমুদ্র পথে প্রথম পৃথিবী প্রদক্ষণকারী হিসেবে তিনি ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। চার্চ বলেছিল পৃথিবীর আকৃতি চ্যাপটা কিন্তু ম্যাগেলান তাঁর অভিযানের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন যে আসলে তা গোলাকার। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার একটি পথ আবিষ্কার করেন তিনি যা ম্যাগেলান প্রণালী নামে পরিচিত। এই আন্তঃমহাসাগরীয় রুট বাণিজ্যের পথকে প্রশস্ত করেছিল। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় ব্যক্তি ছিলেন যিনি প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে এশিয়ায় যাত্রা করেছিলেন। মশলা দ্বীপপুঞ্জে তাঁর অভিযান স্মরণীয় হয়ে আছে। তবে সমুদ্রযাত্রার সময়তেই ম্যাগেলান এক যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। তাঁর সমুদ্রযাত্রা প্রমাণ করেছিল যে, পূর্বে পৃথিবীকে যত বড় বলে মনে করা হয়েছিল, পৃথিবী সেই তুলনায় আরও অনেক বড়।
ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের জন্মস্থান এবং জন্মকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবে আনুমানিক ১৪৮০ সালে পর্তুগালের উত্তরদিকে কোনো এক স্থানে ম্যাগেলানের জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তাঁর জন্মস্থান হিসেবে মূলত যে স্থানগুলির নাম উঠে আসে তা হল, পোর্তোর নিকটবর্তী ভিলা নোভা দে গাইয়া এবং ভিলা রিয়ালের সাব্রোসা। একটি পর্তুগীজ অভিজাত পরিবারেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। ম্যাগেলানের পিতা পেদ্রো দে ম্যাগালহেস শহরের মেয়র ছিলেন এবং পর্তুগীজ অভিজাত সম্প্রদায়ের ছোটখাটো একজন সদস্য ছিলেন। ম্যাগেলানের মায়ের নাম আলদা ডি মেজকুইটা। তাঁর ভাইবোনেদের নাম হল, আইরেস দি ম্যাগালহেস, দিয়েগো দি সোসা, ইসাবেল দি ম্যাগালহেস, দুয়ার্তে দি সোসা এবং জেনেব্রা দি ম্যাগালহেস।
ম্যাগেলানের যখন দশ বছর বয়স, তখন তিনি সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর বাবা অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ১২ বছর বয়সে ম্যাগেলান এবং তাঁর ভাই দিয়েগো রানি লিওনোরার দরবারে ‘পেজ বয়’ হিসেবে কাজে নিযুক্ত হতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে ম্যাগেলান পর্তুগালের প্রথম ম্যানুয়েলের অধীনেও এই কাজ করেছিলেন। দরবারে লিওনোরার স্কুল অব পেজের একজন তরুণ সদস্য হিসাবে মানচিত্র নির্মাণ বা কার্টোগ্রাফি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং নৌচালনার শিক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তীতে অভিযানে প্রভূত সাহায্য করেছিল।
এই সমস্ত শিক্ষালাভের সময় ভ্রমণের প্রতি ম্যাগেলানের আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। ১৫০৫ সালে ভারত ও আফ্রিকা অভিযানে ডন ফ্রান্সিসকো ডি আলমেদার অধীনে একটি নৌঅভিযানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করেছিলেন তিনি। ১৫০৫ সালের ২৫ মার্চ ম্যাগেলান লিসবন থেকে যাত্রা করেন। এই অভিযানের ইতিহাসে তাঁর নাম না পাওয়া গেলেও জানা যায় যে, ম্যাগেলান গোয়া, কোচিন এবং কুইলনে সাত কিংবা আট বছর অতিবাহিত করেছিলেন। এই সময়কালের মধ্যেই ১৫০৬ সালে কান্নানোরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে ১৫০৯ সালে দিউয়ের যুদ্ধে দারুণ পরাক্রম দেখিয়েছিলেন৷ এই শেষোক্ত যুদ্ধটিতে পর্তুগিজরা আরব সাগরে মিশরীয় জাহাজ ধ্বংস করেছিল। ১৫১০ সালে ম্যাগেলান গোয়া এবং ১৫১১ সালে আফনসো দে আলবুকার্কের অধীনে মালাক্কা বিজয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এই মালাক্কা অভিযানে মালাক্কার এনরিককে তিনি ক্রীতদাস হিসেবে অধিগ্রহণ করেছিলেন, যে পরবর্তীতে ম্যাগেলানের অভিযানের একজন অংশ ছিল। ম্যাগেলান সম্ভবত ১৫১২ সালে পর্তুগালে ফিরে এসেছিলেন। এরপর মরক্কোর আজেমমুর আক্রমণকারী বাহিনীতে ক্রাউনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। সেই মরক্কো অভিযানে যুদ্ধে ম্যাগেলান হাঁটুতে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন যার ফলে বাকি জীবন তাঁকে খুঁড়িয়ে চলতে হয়েছিল। মরক্কো বিজয়ের পরেও কিছুদিন সেখানে ছিলেন তিনি। তাঁর বিরূদ্ধে মুরদের সঙ্গে ব্যবসা করবার অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলেও ১৫১৪ সালের পর তিনি আর কোনও চাকরির প্রস্তাব পাননি। অবশ্য ১৫১৫ সালে পর্তুগিজ জাহাজের ক্রু সদস্যের চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন।
পঞ্চদশ শতকে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মশলা। যেহেতু শীতল ইউরোপ মহাদেশে মশলার চাষ করা যায় না, তাই মশলার দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার দ্রুততম সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার সবরকম চেষ্টাই ইউরোপীয়রা করতে থাকে। বিশেষত পর্তুগাল এবং স্পেন এই গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের উপর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ লাভের প্রতিযোগিতায় নামে। ইতিমধ্যে একজন নাবিক হিসেবে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা ম্যাগেলান পশ্চিমদিক দিয়ে মশলা দ্বীপপুঞ্জে (ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত) যাওয়ার অভিযানের জন্য বারবার ম্যানুয়েলের কাছে আবেদন করেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। সম্ভবত মরক্কোর ঘটনাটি নিয়ে কিংবা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ম্যানুয়েলের সঙ্গে ম্যাগেলানের বিবাদ চলছিল, ফলে ম্যাগেলান অভিযানের অর্থায়নের প্রস্তাবকে খারিজ করে দেন ম্যানুয়েল। ১৫১৭ সালে ম্যাগেলান তাঁর পর্তুগিজ নাগরিকত্ব ত্যাগ করে স্পেনের সেভিলে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দিয়েগো বারবোসার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন এবং বারবোসার দ্বিতীয় স্ত্রী-এর কন্যা মারিয়া ক্যালডেরা বিট্রিজ বারবোসাকে বিবাহ করেন। তাঁদের দুই সন্তান রদ্রিগো এবং কার্লোস অল্প বয়সেই মারা যান। ১৫২১ সালে ম্যাগেলানের স্ত্রীয়েরও মৃত্যু হয়েছিল।
সেভিলে গিয়ে ম্যাগেলান স্পেনের রাজা প্রথম চার্লসকে অভিযানের পরিকল্পনার কথা জানান।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৪৯৪ সালে টর্ডেসিলাস চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়া হয় এবং বিভাজন রেখাটি আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখান দিয়ে গিয়েছিল। স্পেন আমেরিকা-সহ লাইনের পশ্চিমদিকের ভূমিগুলি পেয়েছিল এবং পর্তুগালের দিকে ভারত এবং আফ্রিকার পূর্বার্ধ-সহ লাইনের পূর্বদিকের ভূমিগুলি পড়েছিল। এশিয়ায় পৌঁছানোর জন্য স্পেনের প্রয়োজন ছিল একটি নতুন পথ। যেহেতু পর্তুগিজরা ইতিমধ্যেই ভারত এবং এশিয়ার পূর্ব দিকের রুটগুলি বন্ধ করে দিয়েছিল, তাই স্পেনের একজন মহান অভিযাত্রীর প্রয়োজন ছিল যিনি সঠিক পথ খুঁজে বের করতে পারেন। এছাড়াও চার্লস মশলা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছে সেখানকার কিছু অংশ দখল করবার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজা হওয়ার আশাও করেছিলেন। সেই কারণে ম্যাগেলানের এই অভিযানে চার্লস অর্থায়নে রাজি হয়ে যান। ম্যাগেলান দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমমুখী পথে মশলা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানোর প্রস্তাব করেছিলেন, যে-পথে আগে কখনও কেউ যায়নি।
এই অভিযানের জন্য মোট যে-পাঁচটি জাহাজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেগুলি হল – ত্রিনিদাদ, সান আন্তোনিও, সান্তিয়াগো, কনসেপসিয়ন এবং ভিক্টোরিয়া। ১৫১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেভিল থেকে ম্যাগেলান ২৭০জন (এই সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে) লোক নিয়ে তাঁর পশ্চিমমুখী এই অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন।
ম্যাগেলান একজন পর্তুগিজ হয়ে যেহেতু একটি স্প্যানিশ নৌবহরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, সেহেতু অভিযানের প্রথমদিকে তাঁকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। জাহাজে থাকা বেশ কয়েকজন স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রও করেছিল, যদিও তাঁদের কোনো পরিকল্পনাই সফল হয়নি। তবে এই সমুদ্রযাত্রায় শেষ পর্যন্ত কোনও জাহাজই অক্ষত হয়ে ফিরে আসতে পারেনি।
১৫১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ম্যাগেলানদের নৌবহরটি স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে। পশ্চিমে আটলান্টিক পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে যাত্রা করেন তাঁরা। ডিসেম্বর মাসে রিও ডি জেনিরোতে নোঙর করে তাঁদের নৌবহর। সেখান থেকে ম্যাগেলানরা উপকূল বরাবর দক্ষিণদিকে যাত্রা করেছিলেন। মহাদেশের মধ্যে দিয়ে বা তার আশেপাশে পথের সন্ধান করছিলেন তাঁরা। তিনমাস অনুসন্ধানের পর খারাপ আবহাওয়ার জন্য অভিযান বন্ধ রাখতে বাধ্য হন তাঁরা এবং শীতের অপেক্ষা করবার জন্য সেন্ট জুলিয়ান বন্দরে আশ্রয় নেন। সেখানে পাঁচমাস অবস্থান করেন। সেই বন্দরে অবতরণের পরপরই স্প্যানিশ ক্যাপ্টেন জুয়ান ডি কার্টেজেনো, গাসপার ডি কুয়েসাদা এবং লুইস ডি মেন্ডোজার নেতৃত্বে ম্যাগেলানের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ ঘনিয়ে ওঠে। পাঁচটি জাহাজের তিনটির নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহীদের হাতে চলে গেলেও শেষপর্যন্ত ম্যাগেলান বিদ্রোহ দমনে সফল হন। মেন্ডোজা যুদ্ধে নিহত হন এবং ম্যাগেলান বাকি দুজনের শিরশ্ছেদ করবার আদেশ দেন।
শীতকালে ঝড়ের মুখে পড়ে সান্তিয়াগো জাহাজটি হারিয়ে যায়। তবে অভিযান থামেনি তাঁদের। ১৫২০ সালের অক্টোবরে পুনরায় প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার জন্য তাঁদের অনুসন্ধান শুরু হয়। তিনদিন পর তাঁরা একটি উপসাগর খুঁজে পান যা একটি প্রণালীতে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের। সেই প্রণালীটি ধরেই প্রশান্ত মহাসাগরে যেতে পেরেছিল ম্যাগেলানদের নৌবহর। সেই প্রণালীটি ম্যাগেলান প্রণালী নামে পরিচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, এই মহাসাগরের জল অত্যধিক শান্ত হওয়ায় ম্যাগেলানই এর নাম প্রশান্ত মহাসাগর রেখেছিলেন। ম্যাগেলান প্রণালীতে যাত্রার সময় অবশিষ্ট চারটি জাহাজের মধ্যে সান আন্তোনিও জাহাজটি এই অভিযান ত্যাগ করে পূর্ব স্পেনে ফিরে এসেছিল। ১৫২০ সালের নভেম্বর মাসে ম্যাগেলানরা প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছেছিলেন। ম্যাগেলান পূর্ব ধারণার বশবর্তী হয়ে ভেবেছিলেন যে মশলা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছতে তিন-চারদিন সময় লাগবে, কিন্তু বাস্তবে প্রশান্ত মহাসাগর পেরোতেই তিনমাস কুড়ি দিন সময় লেগেছিল। এই দীর্ঘযাত্রায় তাঁদের খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে যায়, ৩০জনের মৃত্যু হয় এবং অনেকে স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হন।
১৫২১ সালের জানুয়ারি মাসে কাছাকাছি গুয়াম দ্বীপে তাঁরা সামুদ্রিক মাছ এবং পাখি খাওয়ার জন্য থেমেছিলেন। তবে মার্চ মাস পর্যন্তও তাঁদের খাদ্য ও পানীয়ের পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ হয়নি। ২৮ মার্চ তাঁরা ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে অবতরণ করেন এবং সেবু দ্বীপের একজন উপজাতীয় রাজা হুমাবোনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। এরপর ম্যাগেলান ম্যাকটান দ্বীপে সেই রাজার শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি হয়েছিলেন। একটি ছোট বাহিনী নিয়ে ম্যাগেলান ম্যাকটান দ্বীপে গিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে আইল্যান্ডবাসীরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল। ১৫২১ সালের ২৭ এপ্রিল সেই ম্যাকটানের যুদ্ধে ম্যাগেলানের মৃত্যু হয়।
এই অভিযানের অবশিষ্ট দুটি জাহাজ, ত্রিনিদাদ এবং ভিক্টোরিয়া ১৫২১ সালের ৫ নভেম্বর মশলা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া জাহাজটিই সারা বিশ্বে সমুদ্রযাত্রা শেষ করে মশলা বোঝাই করে নিয়ে ১৫২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অবশিষ্ট ১৮জন লোক-সহ স্পেনের সেভিলে ফিরে এসেছিল।
যদিও অভিযানের শেষ পর্যন্ত ম্যাগেলান জীবিত ছিলেন না কিন্তু অভিযানের উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন বলে জাহাজে করে প্রথম বিশ্ব ভ্রমণের কৃতিত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়।