গুরু নানক

গুরু নানক

পৃথিবীর সমস্ত ধর্মমতগুলির মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় শিখ ধর্মের প্রবর্তক হলেন গুরু নানক (Guru Nanak)। তিনি শিখ ধর্মের দশজন গুরুর মধ্যে সর্বপ্রথম গুরু।

১৪৬৯ সালের ১৫ এপ্রিল বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাব প্রদেশের রাই ভোয় কি তালভাণ্ডি গ্রামে গুরু নানকের জন্ম হয়।এই গ্রামের নাম বর্তমানে নানকানা সাহিব। অন্য একটি মত অনুসারে, তাঁর জন্ম হয়েছিল কার্তিক মাসে যার পাঞ্জাবি নাম ‘কত্তাক’। তাঁর বাবার নাম ছিল কল্যাণ চাঁদ দাস বেদী, তবে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন মেহতা কালু নামে। কালু ছিলেন স্থানীয় অঞ্চলের ফসলের রাজস্বের ‘পাটোয়ারী’ বা হিসাব রক্ষাকারী। নানকের মা ছিলেন তৃপ্তা। নানকের একটি পাঁচ বছরের বড় দিদি ছিলেন, তাঁর নাম ছিল নানাকি। পরবর্তীকালে মূলচাঁদ নামে এক ব্যক্তির মেয়ে সুলাখানির সঙ্গে নানকের বিয়ে হয়। নানক ও সুলাখানির দুটি পুত্রসন্তান ছিল, তাঁদের নাম ছিল শ্রীচাঁদ ও লক্ষ্মীচাঁদ। ছোটোবেলা থেকেই নানকের মনে আধ্যাত্মিক ভাব দেখা যায়। সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের মতো তিনি খেলাধূলা না করে নির্জন জায়গায় একা একা চুপচাপ বসে থাকতেন। তালভাণ্ডি গ্রামে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধুরা যাতায়াত করতেন। পাঁচ বছর বয়স থেকেই নানক সেই সব সাধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে থাকেন। তিনি সাধুদের কাছ থেকে জন্ম, মৃত্যু, মোক্ষলাভ প্রভৃতি বিষয়ে নানারকম কঠিন আলোচনা মন দিয়ে শুনতেন।

ছয় বছর বয়সে নানকের বাবা তাঁকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন, কিন্তু নানকের পড়াশোনার প্রতি কোনো মনোযোগ ছিল না। তাঁর আধ্যাত্মিক বিষয়ে আগ্রহ দেখে পাঠশালার পণ্ডিতমশাই খুশি হয়ে তাঁকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়ে শোনাতেন এবং ধর্ম বিষয়ে নানা আলোচনা করতেন। এই পাঠশালায় নানক নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও অল্প ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। পাঠশালার পড়া শেষ হলে নানকের বাবা নানককে ব্রিজনাথ শর্মা নামে এক পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শিখতে পাঠান। নানক পণ্ডিতমশাইকে আগের মতোই ধর্ম ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক বড় বড় প্রশ্ন করতেন। কিন্তু পণ্ডিত ভাবতেন যে নানক পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার জন্যই এইসব অজুহাত দেখাচ্ছেন। তিনি নানকের বাবাকে বলে দেন যে নানকের একদমই পড়াশোনায় মন নেই। সেই শুনে নানকের বাবা হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি তখন পাঠশালা থেকে নানককে ছাড়িয়ে এনে বাড়ির গরু ও ছাগল চরানোর কাজে পাঠিয়ে দেন। এই কাজটিই নানকের খুব পছন্দ হয়ে যায়। তিনি বাড়ির কাছে ফাঁকা মাঠে প্রতিদিন গরু-ছাগলগুলিকে চরাতে নিয়ে যেতেন। একদিন গরু-ছাগলগুলিকে ছেড়ে দিয়ে নানক গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর সেই সুযোগে নানকের গরুগুলি পাশের একটি ক্ষেতে ঢুকে পড়ে। ক্ষেতের মালিক তা দেখে জমিদারকে নালিশ জানালে জমিদারের পেয়াদা এসে নানককে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই অভিযোগের তদন্ত করতে যখন পেয়াদা সেই জমিতে যায়, তখন দেখা যায় ফসল যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে। এই ঘটনায় সবাই ভীষণ অবাক হয়ে যায়। এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই নানকের ভিতরে থাকা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রথম প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে এই স্থানেই একটি গুরুদ্বার গড়ে ওঠে যার নাম ‘রিয়াম সাহেব’। কিছুদিন পরে আরও একটি ঘটনা ঘটে। সেদিনও নানক গরু-ছাগলগুলিকে ছেড়ে দিয়ে গাছের নিচে ঘুমিয়ে ছিলেন। সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তাঁর মুখে। সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন গ্রামের জমিদার রাইবুলার। তিনি দেখতে পান একটি বিশাল বিষধর গোখরো সাপ রোদ্দুর আড়াল করার জন্য নানকের মাথায় ফণা তুলে ছাতা ধরে আছে। জমিদারের পায়ের শব্দ শুনে সাপটি আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে যায়। এই ঘটনাটি ঘটার পর সবাই বুঝতে পারে নানক কোনো সাধারণ মানুষ নন, তাঁর ভিতরে আধ্যাত্মিক শক্তি আছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের প্রতি নানকের উদাসীনতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাঁর ভগ্নীপতি জয়রাম একটি মুদিখানায় নানকের কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কাজের জন্য নানক নিজের বাড়ি ছেড়ে সুলতানপুরে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। এখানেই নানকের পরিচয় হয় রবাব-বাদক মর্দানার সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁরা দুজনে মিলে ভক্তিমূলক গানের আসর বসাতে শুরু করলেন। যারা সেই আসরে গান শুনতে আসতো, তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাও নানক করতেন। নানক এবং মর্দানা রোজ সূর্যোদয়ের আগে স্নান করতেন। এমনই একদিন স্নান করার সময় নানক দৈববাণী শুনতে পেলেন। সেই অদৃশ্য কণ্ঠ তাঁকে বলেন, “নানক, আমি তোমার সাথে আছি। তোমার মাধ্যমেই আমার নাম বিস্তৃত হবে। যারা তোমাকে অনুসরণ করবে; আমি তাদের রক্ষা করব। দুনিয়ায় আমার প্রার্থনা করো; মানুষকে শেখাও কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়। দুনিয়ার রাস্তাগুলোর দ্বারা কলঙ্কিত হোয়ো না। জীবনে যাতে নাম, দান, স্নান, সেবা এবং প্রার্থনার প্রশংসা থাকে। তুমি যাকে দয়া করবে, আমি তাকে দয়া করব। যে তোমার প্রতি সদয়; আমি তার প্রতি সদয়।” এই দৈববাণী শোনার পর নানক তিনদিন ও তিনরাত নিখোঁজ ছিলেন। সবাই ভেবেছিল যে তিনি স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা গেছেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে চতুর্থ দিন নানক ফিরে এলেন। ফিরে এসে তিনি নিজের সমস্ত সম্পদ দান করে দিলেন সাধু ও ফকিরদের মধ্যে। এর একদিন পর তিনি ঘোষণা করলেন, “কোনো হিন্দু নেই, কোনো মুসলমানও নেই।“ ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে নানক মর্দানাকে সঙ্গে নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য এক দীর্ঘ ‘উদাসিয়া’ বা ভ্রমণে বের হন। তাঁর রচিত একটি শ্লোক থেকে জানা যায় তিনি ‘নৌ-খণ্ড’ বা পৃথিবীর নয়টি অঞ্চলের বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে বিখ্যাত হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের তীর্থস্থানগুলিও ছিল। প্রথম দফায় তিনি গিয়েছিলেন মথুরা, বেনারস, গয়া, বাংলাদেশ এবং আসাম। তারপর কিছুদিন থেকেছিলেন পাঞ্জাবের সুফি স্থানগুলিতে, দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু হয়ে শ্রীলঙ্কা, পশ্চিমে মালাবার, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের মতো অঞ্চল এবং উত্তরে হিমালয় অঞ্চলের লাদাখ অবধি তিনি ভ্রমণ করেছেন। নানকের শেষ দীর্ঘ ভ্রমণ ছিল ইসলাম ধর্মের প্রাণকেন্দ্র মক্কা, মদিনা এবং বাগদাদে। তিনি এই সমস্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেছেন।

গুরু নানকের শিষ্যদের ‘শিখ’ বলা হয়। ‘শিষ্য’ শব্দটি থেকেই ‘শিখ’ শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ ‘অনুসারী’ বা ‘সমর্থক। শিখধর্ম কঠোরভাবে এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে যিনি নিরাকার। সাধারণভাবে তাঁকে বলা হয় ‘ইক ওমকারা’। শিখধর্মের পাঁচটি সদগুণ হল- সৎ জীবন যাপন করা, অল্পে খুশি থাকা, গরিব-দুঃখীকে দয়া করা, বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা এবং সব মানুষকে ভালোবাসা। গুরু নানক তাঁর প্রচারিত ধর্মে পাঁচটি দোষকে চিহ্নিত করেছেন- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ এবং অহঙ্কার হিসেবে। শিখদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম ‘গ্রন্থসাহিব’। গুরুমুখী ভাষায় রচিত এই গ্রন্থে গুরু নানকের বাণীগুলি সংকলিত আছে। গুরু নানক তাঁর সময়ে ‘লঙ্গর’-এর প্রচলন করেছিলেন। সেখানে সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব লিঙ্গের, সমাজের সর্ব স্তরের মানুষেরা পাশাপাশি বসে আহার করেন। বর্তমানে শিখদের প্রতিটি ধর্মস্থান বা গুরুদ্বারে এই লঙ্গরখানার ব্যবস্থা আছে।

তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি নানক কাটান কর্তারপুরে। শিষ্যদের মধ্যে কর্তারপুরে গুরুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন লেহনা। তিনি ছিলেন একজন ক্ষত্রিয়। লেহনার ভক্তি ও নেতৃত্বের গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে নানক তাকে ‘অঙ্গদ’ উপাধি দিয়েছিলেন। নানকের নিজের এক ছেলে শ্রীচাঁদ সংসারত্যাগী হয়ে যান। অন্যজনের অর্থাৎ লক্ষ্মীচাঁদের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই যোগ্যতার বিচারে নানক অঙ্গদকেই তাঁর অনুপস্থিতিতে শিখদের প্রধান ধর্মগুরুর পদে অভিহিত করেন।

শোনা যায়, তাঁর মৃত্যুর পর মরদেহের সৎকার করা নিয়ে নানকের হিন্দু ও মুসলমান শিষ্যদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে যায়। হিন্দুরা চেয়েছিলেন গুরুর দেহ দাহ করা হোক, অপরদিকে মুসলমানরা চেয়েছিলেন কবর দেওয়া হোক। কিন্তু যখন নানকের দেহের উপর থেকে চাদর সরানো হল, তখন দেখা গেল সেখানে রয়েছে শুধু রাশি রাশি ফুল। হিন্দুরা সেই ফুলের কিছু অংশ নিয়ে গিয়ে দাহ করলেন। বাকি অংশ মুসলমানরা নিয়ে গিয়ে কবর দিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় লাহোর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে জি.টি রোডের ধারে এক প্রকাণ্ড জলাশয়ের পাড়ে গুরু নানক একটি মন্দির গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। এই সময় তিনি এই জলাশয়ের নাম রাখেন ‘অমৃত সায়র’। তার থেকেই পরে এই শহরের নাম হয় ‘অমৃতসর’। গুরু নানকের জীবনকালে তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে শিখ গুরু অর্জুন সিং অমৃত সায়রের ধারে স্বর্ণ মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ধারণা করা হয়, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির বা হরিমন্দিরে প্রতিদিন ১ লক্ষ লোককে খাবার দেওয়া হয়। বিভিন্ন মানুষের দানেই এই লঙ্গর চলে। এই লঙ্গরকে বলে, ‘গুরু কা লঙ্গর’ আর যাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমে এই লঙ্গরগুলো চলে, তাঁদেরকে বলা হয় ‘সেবাদার’।

গুরু নানকের জন্মদিনটি সারা ভারতে ‘গুরু নানক জয়ন্তী’ হিসেবে পালন করা হয়। গুরু নানকের জন্মস্থানে বর্তমানে একটি বিশাল গুরুদ্বার স্থাপিত হয়েছে, যার নাম ‘গুরুদ্বারা জনম আস্থান’।

১৫৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় ৭০ বছর বয়সে গুরু নানকের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান