ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নির্ভীক বাঙালি মহিলাদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং সেই নির্ভীক হৃদয় বাঙালি মহিলা বিপ্লবীদের মধ্যে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন বীণা দাস (Bina Das)। মাস্টারদা সূর্য সেনের দীক্ষায় দীক্ষিত অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন বীণা দাস। বেথুন কলেজে পড়াকালীনই সহপাঠী কমলা দাশগুপ্তের সহায়তায় রিভলবার জোগাড় করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের দিকে তাক করে পরপর পাঁচটি গুলি চালান বীণা। বিচারে ৭ বছর কারাবাসের পরে মুক্তি পেয়েও দেশসেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদও গ্রহণ করেন তিনি এবং কলকাতার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে আবারো ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কারাবন্দী করেছিল। কিন্তু মাত্র ২১ বছর বয়সে জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টার মত দুঃসাহসী কাজের জন্য আজও বীণা দাস বাঙালি তথা আপামর ভারতবাসীর স্মৃতিতে জাগরুক রয়েছেন।
১৯১১ সালের ২৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বাংলার কৃষ্ণনগরে বীণা দাসের জন্ম হয়। তাঁর বাবা বেণীমাধব দাস পেশায় একজন ব্রাহ্ম শিক্ষক হলেও একইসঙ্গে তিনি নানাবিধ সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। বীণার মায়ের নাম ছিল সরলা দেবী। তাঁর বড়ো দিদি কল্যাণী দাস নিজেও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল চট্টগ্রামে। বাবার কাছেই দিদির সঙ্গে একত্রে বসে মহান সমাজ-বিপ্লবীদের কাহিনী শুনতেন বীণা। তাঁর জীবনে বাবা বেণীমাধব দাস এবং বড়মামা বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের গভীর প্রভাব পড়েছিল। বীণার বাবা যখন কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, সেই সময়েই নেতাজী সুভাষচন্দ্র ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলে রাজদ্রোহ প্রচারের অভিযোগে তাঁকে বদলি করে কৃষ্ণনগরে পাঠানো হয়। বিণার মা সরলা দেবী একা হাতে দুঃস্থ নারীদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন ‘পুণ্যাশ্রম’ নামে একটি সংগঠন। ফলে পারিবারিকভাবেই স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রতি বীণার একটা সহজাত আগ্রহ গড়ে ওঠে। দেশে তখন গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছে, বীণার পরিবারেও এই আন্দোলনের আঁচ এসে পড়েছিল। বীণার মেজদাদা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবন্দী হন এবং তাঁর বাবা নিজে হাতে চরকা ও খদ্দর এনে দিতেন বীণাকে। ফলে বাবার আদর্শ তাঁকে অনেকাংশে প্রভাবিত করেছিল। ১৯২১ সাল নাগাদ তাঁদের বাড়িতে পদার্পণ করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং সেখানেই সুভাষের সঙ্গে বীণার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। পরে ১৯৪৭ সালে যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল।
ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল বীণার। মায়ের পাশে বসে বসেই ইংরেজির ফার্স্ট বুক পড়ে শেষ করেছিলেন তিনি। পরে তাঁর বাবা প্রায়ই ‘সিরাজদৌল্লা’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘সাজাহান’ ইত্যাদি নাটকগুলি পড়ে শোনাতেন। এ থেকে বীণার অভিনয় প্রতিভাও বিকশিত হয়েছিল। পরে সেন্ট জনস ডায়োসেশান গার্লস হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হন বীণা। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে তাঁর হাতে আসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’ বইটি যা তখন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। উৎসাহ ও কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে পরীক্ষার আগে আগেই সেই বই পড়ে শেষ করে ফেলেন তিনি। এমনকি বাড়িতে তাঁর মা-বাবাও ঐ বই পড়ে নিজেদের মধ্যে চরিত্রগুলির মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা করতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষার প্রথম পত্রের প্রিয় উপন্যাস বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ‘পথের দাবী’ সম্পর্কেই বর্ণনা করেন বীণা দাস। যদিও সেবারের পরীক্ষায় বাজেয়াপ্ত উপন্যাস নিয়ে লেখার দরুন প্রথম পত্রে তুলনায় অনেক কম নম্বর পেয়েছিলেন তিনি। উচ্চতর শিক্ষার জন্য বীণা দাস ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। কলেজে উঠে বিরাট গ্রন্থাগার পেয়ে বীণার জ্ঞানের তৃষ্ণা যেন আরও অবারিত হল। ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’, ‘কারাকাহিনী’, ‘বাংলায় বিপ্লববাদ’ ইত্যাদি বইও তিনি সেখানেই পরার সুযোগ পান। ১৯২৮ সালে যখন সাইমন কমিশন ভারতে আসে, সেই সময় সাইমন কমিশন বয়কট ও বেথুন কলেজে পিকেটিং করতে সামিল হন বীণা দাস। পিকেটিং করার জন্য কলেজের আবাসিক ছাত্রীদের ক্ষমা চাইতে বলেন অধ্যক্ষ, কিন্তু কেউই ক্ষমা চাইতে রাজি হয় না। ফলে অধ্যক্ষ নিজেই পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যান। এই জয়ে অ্যালবার্ট হলে এক বিরাট সভা আয়োজিত হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী। তারপর থেকেই নিখিল বঙ্গ ছাত্র প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে ওঠে ছাত্রীসংঘ যেখানে দিদি কল্যাণী দাসের সঙ্গে বীণাও যোগ দেন। এই বেথুন কলেজে পড়ার সময়ই সহপাঠী শান্তি দাশগুপ্ত এবং সুহাসিনী দত্তের অনুরোধে ও উৎসাহে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সমিতিতে যোগ দেন বীণা দাস।
১৯৩০ সালে গান্ধীজির নেতৃত্বে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। ইতিমধ্যে মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনও চলছে। ঐ বছরি আগস্ট মাসে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে চার্লস টেগার্টকে গুলি করে হত্যার প্রচেষ্টায় গ্রেপ্তার হন দীনেশ মজুমদার এবং অনুজা সেন। তার পরের বছর শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিতা হন। এই পরিস্থিতিতে বীণা দাসের গুপ্ত বিপ্লবী দল ভেঙে যায়। বীণাদের দলের নেতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এই সময়ই একদিন যুগান্তর দলের কর্মী কমলা দাশগুপ্তের কাছে গিয়ে তিনি বলেন যে তাঁকে একটা রিভলবারের ব্যবস্থা করে দিলে তিনি কলকাতার তৎকালীন গভর্নরকে গুলি করবেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেই বীণা গভর্নরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। কমলা দাশগুপ্ত প্রথমেই এ ব্যাপারে বীণাকে সম্মতি দেননি। গুরুজনপ্রতিম সুধীর ঘোষের সঙ্গে আলোচনা করে কমলা দাশগুপ্ত ঠিক করেন যে শাসন ও ক্ষমতার মূর্ত প্রতীক গভর্নরকে হত্যার মধ্য দিয়েই তাঁদের আন্দোলন অন্যতর বাঁক নিতে পারে। ফলে পরিকল্পনায় সকলেই সম্মত হলেন। গুলি করে ধরা পড়লে যে ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের পাশাপাশি প্রবল অত্যাচারের কবলে পড়তে হবে তা জেনেও সকলে এই কাজে প্রবৃত্ত হলেন নির্ভীক হৃদয়ে। কমলা দাশগুপ্ত ২৮০ টাকা সংগ্রহ করে সুধীর ঘোষকে দেন রিভলবার সংগ্রহ করার জন্য। চোরাপথে রিভলবার চলে এল হাতে, সুধীর ঘোষ সেই রিভলবার তুলে দেন বীণার হাতে। রিভলবার কীভাবে চালাতে হবে সেই প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন বীণা।
অতঃপর ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরু হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। বীণা আগেভাগেই রিভলবার নিয়ে রামমোহন গ্রন্থাগারে উপস্থিত ছিলেন। যখন জ্যাকসন সাহেব অভিভাষণ পাঠের জন্য উঠে দাঁড়ান, ঠিক তখনই গাউন পরা অবস্থাতেই নিজের আসন থেকে উঠে কয়েক হাত দূর থেকে পরপর পাঁচটি গুলি ছোঁড়েন বীণা দাস। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কারণে গভর্নর বেঁচে যান আর মঞ্চে উপস্থিত হাসান সুরাবর্দী ছুটে এসে বীণার গলা টিপে ধরে তাকে বসিয়ে দিতে চান। বীণাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, আদালতের বিচারে নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় বীণা দাসকে। বীণার সঙ্গে কারা কারা এই পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন তা কখনই পুলিশ জানতে পারেনি। কিন্তু কিছুদিন পরে বিপ্লবী সন্দেহে কমলা দাশগুপ্ত এবং সুধীর ঘোষকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ছয় বছর যাবৎ বন্দী করে রাখে। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে মেদিনীপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয় বীণাকে। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীর সঙ্গে। জেলের অব্যবস্থা ও অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশন শুরু করলে তাঁদের অনশনের সপ্তম দিনে জেল কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেয়। পরে যদিও শান্তি ঘোষ ও বীণা দাসকে হিজলী জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৩৯ সালে দীর্ঘ সাত বছর জেলে কাটিয়ে বীণা দাস মুক্ত হন। তারপর সরাসরি জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। ‘মন্দিরা’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য তিনি তখন কাজ করতেন। তার পাশাপাশি টালিগঞ্জের চালকলের বস্তিতে গিয়ে দরিদ্র শ্রমিকদের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলে কংগ্রেসের গণসংযোগের কাজ করতেন বীণা দাস।
১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি। হাজরা পার্কে এই সংগঠনের হয়ে সভা ডাকলে পুলিশ বে-আইনি সভা ডাকার অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুনরায় কারাবন্দী করে। প্রেসিডেন্সি জেলে এরপর তিন বছর তিনি বন্দী থাকেন। পরে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন তিনি। ঐ সময় অমৃতবাজার পত্রিকার কর্মী ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন বীণা। নোয়াখালির দাঙ্গার পরে সেখানে ত্রাণ দানের জন্য কাজ করেছিলেন বীণা দাস।
নিজের বিপ্লবী জীবনের কথা বীণা দাস লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘শৃঙ্খল ঝঙ্কার’ বইতে।
১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৭৫ বছর বয়সে উত্তরাখণ্ডের হৃষীকেশে বীণা দাসের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- কমলা দাশগুপ্ত, 'রক্তের অক্ষরে', নাভানা, ১৯৫৪, কলকাতা, পৃষ্ঠা - ৫৩-৭০
- কমলা দাশগুপ্ত, 'স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী', বসুধারা প্রকাশনী, ১৯৬০, কলকাতা, পৃষ্ঠা - ১১৯-১২৪
- https://feminisminindia.com/
- https://www.hindustantimes.com/
- https://www.prohor.in/
- https://www.bongodorshon.com/
- https://indianexpress.com/