প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং প্রথম নারী যিনি স্বাধীনতার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

১৯১১ সালের ৫ মে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বর্তমান পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে জন্ম হয় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের। তাঁর বাবার নাম জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মায়ের নাম প্রতিভাদেবী৷ তাঁর বাবা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী ।

ভিডিওতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনী

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারর প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু হয় ডা. খাস্তগীর সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে৷ তিনি শৈশব থেকেই মেধাবী ছাত্রী ছিলেন৷ সেই কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের প্রিয় পাত্রীও ছিলেন তিনি৷ ১৯২৯ সালে তিনি বিদ্যালয়ের পড়াশুনার পাঠ শেষ করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন৷ সাহিত্য চর্চায় তিনি বরাবর উৎসাহী ছিলেন৷ কলেজের পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন৷ কেবল পড়াশোনা নয় পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক কাজকর্মে তিনি উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন৷ উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা আসেন এবং বেথুন কলেজে ভর্তি হন৷ দুই বছর পর দর্শন শাস্ত্র নিয়ে তিনি পাশ করেন। যদিও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়।  বর্তমান সময়ে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়েছে তাঁদের দুজনকে । কলেজে পড়া শেষ করে তিনি আবার চট্টোগ্রামে ফিরে আসেন৷

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারর কর্মজীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় বিদ্যালয় ‘নন্দনকানন অপর্ণাচরণ স্কুল ‘-এ প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে৷ তাঁর সবথেকে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে পড়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান৷ প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার ছিলেন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকারের বাজেয়াপ্ত করা কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রেখে দিয়েছিলেন। প্রীতিলতা  তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী। সেই বইগুলোর মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়ে ফেলেন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। এই সমস্ত বই প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল।

লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়) এর নেতৃত্বে ‘ দীপালি সংঘ ‘ নামে একটি সংগঠন নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত। ঢাকায় অবস্থিত এই সংঘ মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজও করত। ‘দীপালী সঙ্ঘে’ যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেছিলেন৷ এর মধ্যে মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তাঁর বিপ্লবী দল চট্টগ্রামের মহাপরিদর্শক মিঃ ক্রেগকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে। কিন্তু ভুলবশত তাঁরা ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এসপি তারিনী মুখোপাধ্যায়কে হত্যা করে ফেলে। বিচারে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় এবং কালীপদ চক্রবর্তীর কারাদণ্ড হয়। সেই সময় প্রীতিলতা কলকাতায় ছিলেন। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় আলিপুর জেলে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার জন্য৷

এর পরবর্তী সময়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসগুলিতে আক্রমণের মতন কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করেন। এমনকি জালালাবাদ যুদ্ধে বিপ্লবীদের অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্বও ছিল তাঁর৷ ১৯৩৩ সালের ১৩ জুন, প্রীতিলতা সূর্য সেন ও নির্মল সেনের সঙ্গে তাঁদের ধলঘাট শিবিরেই দেখা করেন৷ সেখানেই তিনি বিপ্লবী দলে যোগদানের ইচ্ছে প্রকাশ করেন৷ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী মহিলাদের দলে যোগদান করা নিয়ে আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই আপত্তি ধাপে টেকেনি৷ বরং কোন মহিলা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় কম থাকবে।  ধীরে ধীরে তিনি বিপ্লবী দলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন৷ মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাষ্টারদা লিখেছেন “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম…”।

ধলাঘাট সংঘর্ষ প্রীতিলতার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই রাতে পুলিশ সৈন্যর মুখোমুখি পড়ে যান  মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা,  নির্মল সেন এবং অপূর্ব সেন৷ সেনার গুলিতে নির্মল সেন এবং অপূর্ব সেন মারা যান৷ আর কোন মতে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানা ভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কাদামাখা পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। প্রীতিলতা আত্মগোপন করে থাকলেও পুলিশি তল্লাশিতে জানা যায় সে রাতে প্রীতিলতা বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও প্রীতিলতা  লুকিয়ে থাকায় পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি । পুলিশ বাহিনী তাঁর সন্ধান করতে থাকে।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা। গুড ফ্রাইডের কারনে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। এই ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা থাকত “ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস নট অ্যালাওড”। পরিকল্পনার দিন পিছিয়ে ১৯৩২ সালের ১০ আগষ্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ক্লাব আক্রমনের পর তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি ফেরার পথে পটাশিয়াম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন৷ এরপর মাষ্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বরে আবার ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের ওপর দেবেন বলেন মনস্থির করেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে যায়৷ তাই আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর। ২৩ সেপ্টেম্বর এই আক্রমণে প্রীতিলতা পুরুষবেশ নেন৷ তাঁর পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতো। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার সেখান থেকে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পরানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নিয়েছিল কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী তাঁদের পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন এর।

বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেওয়া তাঁর গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভেতর থেকে আনুমানিক রাত ১০.৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। দিনটি ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে ছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাবে আক্রমণ করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।

ভিডিওতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মাকে লেখা তাঁর শেষ চিঠি

প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেন৷ ক্লাবের চারপাশ ঘন ঘন বোমার আঘাতে কেঁপে ওঠে।  ক্লাবঘরের সব আলো নিভে যাওয়ার কারনে সকলে অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে থাকে। ক্লাবে যে সমস্ত ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করে। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হন ।  পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয়েছিলেন। এর সাথে চারজন পুরুষ ও সাত জন নারী আহত হন।

আহত প্রীতিলতা পুলিশের হাতে নিজেকে ধরা দিতে চাননি তাই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেন৷ ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে গুলির আঘাত গুরুতর ছিল না৷ তাঁর মৃত্যু পটাসিয়াম সায়নাইড খাওয়ার ফলেই হয়েছে৷ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন৷

বাংলাদেশী লেখিকা সেলিনা হোসেন প্রীতিলতাকে সকল নারীর আদর্শ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর স্মৃতিতে নির্মান করা হয়েছে বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট (Birkannya Pritilata Trust)।

6 comments

আপনার মতামত জানান