কল্পনা দত্ত

কল্পনা দত্ত

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এক অগ্নিকন্যা হলেন কল্পনা দত্ত (Kalpana Datta)। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে তিনি চট্টগ্রাম বিপ্লবের একজন অন্যতম বিপ্লবী নেত্রী ছিলেন তিনি।

১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর অঞ্চলের বোয়ালখালি গ্রামে কল্পনা দত্তের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন বিনোদবিহারী দত্ত ও মা শোভনবালা দত্ত। কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি ৷

কল্পনার প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর ১৯২৯ সালে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন তিনি। সেইসময় ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। মাত্র বারো বছর বয়স থেকেই স্বদেশ ভাবনা তাঁর মননে জেগে উঠেছিল। তিনি বিভিন্ন স্বদেশী বই পড়তেন। বিপ্লবীদের জীবনী পড়তে তাঁর ভালো লাগত। তাঁর ছোটকাকার কাছ থেকে কল্পনা দেশের কাজে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য উৎসাহ পেয়েছিলেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি  কলকাতায় চলে আসেন এবং আই.এ প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান নিয়ে বেথুন কলেজে ভর্তি হন। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই তিনি রাজনৈতিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অনেক পরে ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন৷

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ভিডিওতে কল্পনা দত্তের জীবনী

বেথুন কলেজে পড়াকালীন তিনি নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি যোগ দেন বেথুন কলেজে গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘে। ফলে কলেজে ছাত্রীদের উদ্যোগে সংঘটিত হরতাল পালন এবং অন্যান্য আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি। এই সংঘে বীনা দাস এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতন সক্রিয় সদস্যেরা ছিলেন। বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন কোমল স্বভাবের মেয়েরা বিপ্লবী কাজের পক্ষে অনুপযুক্ত এবং ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, ‘’It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.’’  ১৯৩১ সালের মে’ মাসে মাস্টারদা সূর্য সেনের সশস্ত্র প্রতিরোধ দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায় তিনি যোগ দেন। মাস্টারদা চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাবে আক্রমণ করার জন্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও তাঁকে দায়িত্ব দেন। তবে হামলার এক সপ্তাহ আগে ওই অঞ্চলে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরার সময়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। কিছু দিন পরে জামিনে মুক্তিও পেয়ে যান৷ মুক্তি পেলেও তিনি বেশ কিছু সময়ের জন্য আত্মগোপন করেছিলেন।

১৯৩৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ গাইরলা গ্রামে তাঁদের ঘাঁটি ঘেরাও করে এবং এই অভিযানে সূর্য সেনকে গ্রেপ্তার করা হলেও কল্পনা দত্ত সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। অবশেষে ১৯ মে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেসের চার্জে রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন, হত্যা প্রভৃতির দায়ে সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্তকে গ্রেফতার করা হয়। মামলার রায়ে সূর্য সেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন৷ ১৯৪০ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কল্পনা ১৯৪৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষে ত্রাণকর্মী হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ নামে বাংলায় একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন৷  অরুণ বোস ও নিখিল চক্রবর্তী এই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন৷

১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহিলা আসনে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কল্পনা দত্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কংগ্রেসের প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের র স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে। যদিও এই নির্বাচনে কল্পনাশেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পর কল্পনা জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসেন ভারতে। এরপর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সক্রিয়ভাবে তিনি যুক্ত ছিলেন ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির প্রতিদিনের কাজে। রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবেও নাম করেছিলেন তিনি।

কল্পনা ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে চাকরি নেন এবং পরবর্তী সময়ে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মৈত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনা দত্তের।  চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তাঁর লেখাগুলি গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত।  ১৯৯০ সালে তাঁর লেখা ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আরও একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পুরান চাঁদ জোশিকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের দুই পুত্র সন্তানের নাম যথাক্রমে চাঁদ ও সুরজ।

১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কল্পনা দত্তের মৃত্যু হয়৷ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত যোশী একটি চিরস্মরণীয় নাম হয়ে রয়েছেন৷

One comment

আপনার মতামত জানান