ভারতের বাইরে থেকে যে সমস্ত মহান বিপ্লবী ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা (Shyamji Krishna Varma) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে একজন আইনজীবি এবং সাংবাদিক ছিলেন যিনি লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্ডিয়ান হোমরুল সোসাইটি। তাছাড়া ১৯০৫ সালে তিনিই লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউস প্রতিষ্ঠা করেন। এই ইন্ডিয়া হাউস সেকালে ব্রিটেনে থাকা সমস্ত প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের একমাত্র আখড়া ছিল বলা যায়। কর্মজীবনে তিনি বহু দেশীয় রাজার দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা নিজে দয়ানন্দ সরস্বতীর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ধারণায় বিশ্বাস রাখতেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি ‘ইন্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট’ নামে একটি মাসিক জাতীয়তাবাদী পত্রিকাও প্রকাশ করতেন।
১৮৫৭ সালের ৪ অক্টোবর কচ্ছ জেলার মান্ডভিতে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার জন্ম হয়। তাঁর বাবা কৃষ্ণদাস ভানুসলী কটন প্রেস কোম্পানির একজন শ্রমিক ছিলেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল গোমতীবাঈ। তাঁর ১১ বছর বয়সেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর ঠাকুমার কাছেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ভাছুন্ডা গ্রামে যা বর্তমানে কচ্ছ জেলার আবদাসা তালুকের অন্তর্গত। পারিবারিক সমস্যা এবং চাকরির খোঁজেই তাঁর বাবা মান্ডভিতে এসে ওঠেন। ১৮৭৫ সালে তাঁর স্কুলের বন্ধু রামদাসের বোন ভানুমতিকে বিবাহ করেন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা।
ভুজ অঞ্চলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করেন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা। এরপর তাঁর পরিবার মুম্বাইতে চলে আসে এবং শ্যামজি ভর্তি হন মুম্বাইয়ের উইলসন হাই স্কুলে। মুম্বাইতে থাকার সময়েই তিনি সংস্কৃত ভাষা শিখে ফেলেন। বিবাহের পর পরই তিনি দয়ানন্দ সরস্বতীর সংস্পর্শে আসেন এবং বৈদিক দর্শন ও ধর্মের উপর বক্তৃতা দিতে থাকেন। দয়ানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন শ্যামজি। ১৮৭৭ সালে কাশীর পণ্ডিতরা তাঁকে ‘পণ্ডিত’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেকালে একমাত্র তিনিই ছিলেন যিনি অব্রাহ্মণ হয়েও এই উপাধি লাভ করেছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক মনিয়ের উইলিয়ামস তাঁকে তাঁর সহকারীর পদে কাজের প্রস্তাব দেন।
শ্যামজি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ইংল্যান্ড আসেন এবং ১৮৭৯ সালের ২৫ এপ্রিল অধ্যাপক মনিয়ের উইলিয়ামসের সুপারিশে অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করেন। ১৮৮৩ সালে বি.এ পাশ করার পরে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটিতে তিনি একটি বক্তৃতা দেন যেখানে তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘ভারতে লিপির উৎস’। এই বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মাকে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অনাবাসিক সদস্য (Non-Resident Member) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৮৮১ সালে প্রাচ্যবাদীদের বার্লিন সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা। ১৮৮৫ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং একজন আইনজীবি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। রতলাম রাজ্যের দেওয়ান পদে এরপরে তিনি নিযুক্ত হন, কিন্তু স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে কিছুদিন কাজ করার পরেই এই চাকরিটি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। যদিও গ্র্যাচুইটি বাবদ সেকালেই ৩২ হাজার ৫২ টাকা পেয়েছিলেন তিনি। এরপর খুব অল্প কয়েকদিন মুম্বাইতে কাটিয়ে তাঁর গুরু দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রধান আখড়া আজমীরে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এবং আজমীরের ব্রিটিশ আদালতে আইন অভ্যাস জারি রাখেন। এর পাশাপাশি তিনটি কটন প্রেসে তিনি নিজের উপার্জিত অর্থ লগ্নি করেছিলেন যার দরুণ বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটানোর উপযোগী নিশ্চিত উপার্জনের রাস্তা খুলে গিয়েছিল। ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা উদয়পুরের মহারাজার অধীনে কাউন্সিল সদস্য হিসেবে কাজ করেন এবং তারপর জুনাগড়ের দেওয়ান পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু এক ব্রিটিশ এজেন্টের অত্যন্ত অভদ্রতার কারণে সেই চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি।
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর লেখা ‘সত্যার্থ প্রকাশ’ এবং আরও অন্যান্য বইপত্র পড়ার পরে জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত এবং দীক্ষিত হন তিনি। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই লন্ডনে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা গড়ে তোলেন ‘ইন্ডিয়া হাউস’। ১৮৯০ সালে ‘এজ অফ কনসেন্ট’ বিলটিকে ঘিরে উদ্ভূত বিতর্কের সময় লোকমান্য তিলককে সহায়তা করেছিলেন তিনি। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন নীতিকে তিনি অত্যন্ত অসম্মানজনক এবং লজ্জাজনক বলে মনে করতেন। ১৮৯৭ সালে পুনেতে প্লেগ মহামারীর সময় ব্রিটিশ সরকারের কঠোর ও নির্দয় পদক্ষেপের জন্য অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয় কর্তৃক কমিশনার হত্যার সমর্থন জানান তিনি এবং মনে মনে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিখ্যাত দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সারের লেখাপত্রের দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯০৩ সালে হার্বার্ট স্পেন্সারের স্মৃতিতে ভারতীয় স্নাতকোত্তীর্ণ ছাত্রদের ইংল্যান্ডে তাঁদের উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করার জন্য দুই হাজার টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলেন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা। ১৯০৫ সালে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রচারক এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং আর্থ-সামাজিক সংস্কারের মাধ্যম হিসেবে তিনি প্রকাশ করেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট’ নামে একটি পত্রিকা। বহু প্রবাসীকে স্বাধীনতার যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল এই পত্রিকাটি। ঐ বছরই ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান হোমরুল সোসাইটি’। হাইগেটে তাঁর বাড়িতে এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম বৈঠকে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হিসেবে স্থির হয় –
ক) ভারতের জন্য ‘হোম-রুল’ (Home Rule) নিশ্চিত করার জন্য ইংল্যান্ডে প্রচার চালানো
খ) স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্যের বার্তা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে তুলে ধরা
লন্ডনে জাতিগত বৈষম্যের কারণে বাসস্থান না পাওয়ার সমস্যা মেটাতেই ভারতীয় ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল ইন্ডিয়া হাউস। ১৯০৫ সালের ১ জুলাই দাদাভাই নৌরজি, মাদাম কামা, লালা লাজপত রাই প্রমুখদের উপস্থিতিতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের সদস্য হেনরি হিন্ডম্যান ২৫ জন ছাত্রের বাসস্থানের সুবিধে সহ এই ইন্ডিয়া হাউস উদ্বোধন করেন। শ্যামজি ভেবেছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করে তুলবে এই প্রতিষ্ঠানটি। ক্রমে ক্রমে ভিকাজি কামা, লালা হরদয়াল, এস আর রানা, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরাও এর সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯০৫ সালের শেষ দিকে ইন্ডিয়ান হোম রুল সোসাইটির সদস্য হিসেবে শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা হলবর্ন টাউনে আয়োজিত ‘ইউনাইটেড কংগ্রেস অফ ডেমোক্র্যাটস’-এ যোগ দেন। ক্রমেই তাঁর কার্যকলাপ ব্রিটিশদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং ইনার টেম্পল-এ তাঁর সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়া হয়। সেই সময় লন্ডনের বহু পত্র-পত্রিকায় শ্যামজিকে সহায়তাকারী ব্রিটিশদের সমালোচনা করা হয়। যেহেতু শ্যামজির উপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছিল ব্রিটিশরা, তাই তিনি তাঁর সদর দপ্তর সরিয়ে নিয়ে যান প্যারিসে। বীর সাভারকরের হাতে ইন্ডিয়া হাউসের দায়িত্ব অর্পণ করে গোপনেই লন্ডন ত্যাগ করেন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা। ১৯০৭ সালের প্রথমদিকে প্যারিসে আসেন তিনি এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ফ্রান্স থেকে প্রত্যর্পণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু শ্যামজি সেখানকার বেশ কিছু রাজনীতিবিদদের সহায়তা ও সমর্থন পাওয়ায় এই কাজে ব্রিটিশরা সফল হননি। শ্যামজির বন্ধু মি. জেমস সম্পাদিত ‘দ্য লিবারেটর্স’ পত্রিকায় বো স্ট্রিটের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মি. মার্লিনের একটি সংবেদনশীল মামলাকে কেন্দ্র করে একটি বিতর্কিত প্রবন্ধ লেখেন শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা এবং তখন থেকেই প্যারিসে তাঁর নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিসে তাঁর কাজকর্মের ফলেই ইউরোপীয় দেশগুলির কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সমর্থন ও অনেক সহযোগিতা আদায়ের পথ প্রসারিত হয়। ১৯১৪ সালে ফরাসি রাজনীতিবিদরা ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জকে আমন্ত্রণ জানান প্যারিসে এবং সেই কারণে শ্যামজিকে পুনরায় জেনেভায় চলে যেতে হয়। কিন্তু এখানেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় সুইস সরকার তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং প্রদত্ত আশ্রয়ের অধিকারের সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন ও তা সুরক্ষিত করার সর্বোত্তম উপায় সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা ‘লীগ অফ নেশনস’কে ১০ হাজার ফ্রাঙ্ক দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাটিকে উড্রো উইলসন বক্তৃতা হিসেবে নামাঙ্কিত করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। ব্রিটিশ সরকার এবং সুইস সরকারের চাপের কারণে লীগ অফ নেশনস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মাঝে ছয় বছর নানা কারণে প্রকাশনা বন্ধ থাকার পর ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে আবার ‘ইন্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট’ পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশ পায়। ১৯২২ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার আরও দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু অবিলম্বে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তিনি এই কাজ থেকে বিরত হন।
১৯৩০ সালের ৩০ মার্চ শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার মৃত্যু হয়।