আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

পাকিস্তানে আইয়ুব খানের শাসনকালে আওয়ামী লিগের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেছিল সেটাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (Agartala-Conspiracy-Case) নামে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম চলেছে। শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে সমস্ত বাঙালিদের নিয়ে বিচ্ছিন্ন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাইছিল কয়েকজন দুঃসাহসী বিপ্লবী। ১৯৪৭ সাল থেকেই পরপর নানা সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫৪ সাল থেকেই পাকিস্তানি সরকারের কাছে সমস্ত প্রকার সুযোগ-সুবিধা না পেলে পৃথক হবার পরিকল্পনা করে আসছিলেন অনেক রাজনীতিবিদ। কিন্তু ১৯৬৮ সালে এসে এই চাপান-উতোর বন্ধ করতে পাকিস্তান সরকার এই মামলা দায়ের করেছিলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানে উদ্ঘাটিত এক জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লিগের তৎকালীন সভাপতির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার এই মামলা রুজু করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার নানাবিধ প্রয়াসের মধ্যে পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা এই মামলা ছিল অন্যতম। ইতিহাসে দেখা যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ই জন্ম দিয়েছিল বিখ্যাত ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের।    

১৯৬৮ সালের ১৯ জুন থেকে শুরু হওয়া এই মামলায় মোট অভিযুক্ত ছিলেন পয়ঁত্রিশ জন যাঁদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান উল্লেখ্য নাম ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন – লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, নৌবাহিনীর স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, সুলতানউদ্দীন আহমদ, নূর মোহাম্মদ, আহমদ ফজলুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজউল্লাহ, এ. বি. এম আবদুস সামাদ, দলিল উদ্দীন, রুহুল কুদ্দুস, মো. ফজলুল হক, ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, আবদুর রাজ্জাক, মুজিবুর রহমান, মো. আবদুর রাজ্জাক, জহরুল হক, মোহাম্মদ খুরশিদ, শামসুর রহমান খান, এ কে এম শামসুল হক, আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, শামসুল হক, শামসুল আলম, মো. আবদুল মুত্তালিব, এম শওকত আলী, খন্দকার নাজমুল হুদা, এ. এন. এম. নূরুজ্জামান, আবদুল জলিল, মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, এস. এম. এস. রহমান, এ. কে. এম. তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, খুরশিদ উদ্দীন আহমদ এবং সর্বশেষ আবদুর রউফ। এঁদের মধ্যে কয়েকজন সিএসপি কর্মকর্তাও ছিলেন। মামলার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেন, সার্জেন্ট শামসুদ্দিন মিয়া, করপোরাল মো. আমির হোসেন মিয়া, ডা. সাইদুর রহমান, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মির্জা এম রমিজ, ক্যাপ্টেন আবদুল আলিম ভুইঁইয়া, করপোরাল সিরাজুল ইসলাম এবং জামালউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ গোলাম আহমেদ, আবদুল বাশার মহম্মদ ইউসুফ এবং সার্জেন্ট আবদুল হালিম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল মঞ্জুর কাদের এবং ও.টি.এইচ খান। ট্রাইব্যুনালের অন্যান্য বিচারকদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শেখ আবদুর রহমান, মাকসুমুল হাকিম এবং মুজিবর রহমান খান। অন্যদিকে অভিযুক্ত বিপ্লবী তথা রাষ্ট্রদ্রোহির পক্ষে সওয়াল জবাব করেছিলেন মোট ছাব্বিশ জন আইনজীবি যাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রধান কৌঁসুলি আবদুস সালাম খানও ছিলেন। পরে ইংল্যাণ্ড থেকে হাইকোর্টে পিটিশন জমা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিয়ে আসা হয়েছিল আইনজীবি টমাস উইলিয়ামকে। ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার মেসে এই বিচার চলেছিল দীর্ঘ আট মাস ধরে। এই মামলার আসল নাম ছিল – রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গণ মামলা, ত্রিপুরার আগরতলা শহরে এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হয়েছিল মনে করে এই মামলাটিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে চিহ্নিত করা হয়। পাকিস্তানের দণ্ডবিধির ১২১এ ও ১৩১ ধারা অনুযায়ী দণ্ডিত করা হয়েছিল অভিযুক্তদের।  

পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবর রহমান একটি সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে নৌবাহিনীর স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান এবং শিক্ষক মহম্মদ আলী রেজা উভয়ে একত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতে ত্রিপুরার আগরতলায় যান ভারতীয়দেরকে সাহায্যের অনুরোধ করতে। এই সমগ্র পরিকল্পনাটি উন্মোচন করেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুল আলম যিনি ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের পূর্ব পাকিস্তান পৃথকীকরণ কর্মসূচিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলার রেজিমেন্টের একজন অফিসার রউফ-উর-রহমান আওয়ামী লিগের ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শামসুল আলমকে হত্যার চেষ্টা করেন। শামসুল আলম অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সেই আঘাত প্রতিহত করেন এবং আততায়ীর পিছু ধাওয়া করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার পরে এই সাহসিকতার জন্য আলমকে ‘সিতারা-ই-বসালত’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৭ সালে এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত মোট ১৫০০ জন বাঙালিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করে যে এর পিছনে একটি সংগঠিত বৃহত্তর চক্রান্ত ছিল যার দ্বারা পাকিস্তানের স্থিতাবস্থা ভঙ্গ এবং একটি সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা ছিল। পরে আরও ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি পুলিশ। ১৯৬৮ সালের ৯ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

যেহেতু গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন তাই পাকিস্তান সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে একটি কোর্ট-মার্শাল করার কথা ভেবেছিল প্রথমে। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে মামলার সঙ্গে রাজনীতিবিদদের জড়িত করার পাশাপাশি বিচারের স্বচ্ছতা আনার জন্য কোর্ট মার্শালের বদলে সাধারণ দেওয়ানি মামলা হিসেবেই আগরতলা ষড়যন্ত্রের বিচার শুরু হয়। ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে অভিযুক্তদের নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্ত প্রদেশের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসের মধ্যে একটি সুরক্ষিত কক্ষে বিচার শুরু হয় এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এবং ১০০ পাতার একটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল আদালতের সামনে। এই অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন দুশো সাতাশ জন সাক্ষী এবং সাত জন অনুমোদনকারী। বঙ্গবন্ধুর তরফে আইনজীবি টমাস উইলিয়ামস একটি পিটিশন জমা করে পাকিস্তান সরকারের এই ট্রাইব্যুনালের অস্বচ্ছতার বিরোধিতা করেন এবং তাঁর চাপে পড়ে সাতজন অনুমোদনকারী স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তাঁরা রাষ্ট্রের চাপে পড়ে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের কাছে এই মামলাটি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র হিসেবেই প্রতিপন্ন হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার প্রমাণ করতে চেয়েছিল শেখ মুজিবর রহমান একজন ভারতের দালাল এবং বিচ্ছিন্নতাকামী। ফলে খুব শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ একজোট হয়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। মামলা প্রত্যাহার এবং সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র দেশ। ইতিমধ্যে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজবন্দী সার্জেন্ট জহরুল হককে পাকিস্তানি পুলিশ কারাগারের মধ্যেই গুলি করে মেরে ফেলে। এই সংবাদ জানতে পেরে উত্তেজিত সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সহ পাকিস্তান সরকারের প্রধান আইনজীবি ও ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সরকারি ভবনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এর ফলে এই মামলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিও পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-আন্দোলনের চাপে পড়ে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের রেসকোর্সের মাঠে একটি অভ্যর্থনা সভায় প্রথম শেখ মুজিবর রহমানকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু’।

বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করে এবং একটি গোল টেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইয়ুব খানের সামনে তাঁর ছয় দফা দাবি পেশ করেন। কিন্তু আইয়ুব খান একটিতেও সম্মত না হলে বিদ্রোহ জারি থাকে। এই বিদ্রোহই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান নামে পরিচিত। বিদ্রোহীদের মধ্যে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ, মতিউর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। দিকে দিকে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান উঠেছিল ‘কারার প্রাচীর ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। ফলে অচিরেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আইয়ুব খানের সরকারের পতন ঘটে। কারাগারে পুলিশের গুলিতে মৃত জহরুল হকের স্মৃতিতে ও তাঁর সম্মানার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের নামকরণ করা হয় জহরুল হক ভবন।

One comment

আপনার মতামত জানান