মাদাম কামা

মাদাম কামা

ভারতের বাইরে জার্মানির স্টুটগার্টে প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন মাদাম কামা (Madam Cama)। বীর সাভারকরের বিন্যাস করা তেরঙা সেই পতাকা যদিও আজকের ভারতের জাতীয় পতাকার থেকে পৃথক ছিল। ভারতের বাইরে বিপ্লববাদের প্রচেষ্টায় শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা, সাভারকর, লালা হরদয়াল, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখদের সঙ্গে তাঁর নামও মিশে আছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে। প্যারিসে তাঁর বাড়িটিই একসময় হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের আলোচনাস্থল। রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিনও একসময় মাদাম কামার বাড়িতে মত বিনিময়ের জন্য এসেছিলেন। লণ্ডনে ভারতের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সপক্ষে পুস্তিকা বিলি করা শুরু করেছিলেন তিনি, এমনকি ভারতের বিপ্লবীদের বহু সময় অর্থ সাহায্য করতেও দ্বিধাবোধ করেননি মাদাম কামা। এছাড়াও ১৯১০ সালে ইজিপ্টের কায়রো শহরে এক সভায় তিনিই প্রথম লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হন। তাঁর স্মরণে ভারত সরকার ১৯৬২ সালে একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে।

১৮৬১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বম্বের এক পার্সি জরস্ত্রীয়ান পরিবারে মাদাম কামার জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ভিকাজি রুস্তম কামা। তাঁর বাবা শোরাবজী ফ্রামজী প্যাটেল ছিলেন একজন আইনবিশেষজ্ঞ এবং পেশায় ব্যবসায়ী, পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল জৈজিবাঈ শোরাবজী প্যাটেল। সেই সময় পার্সিরা ব্যবসা, শিক্ষা, শিল্প সবেতেই অগ্রণী হয়ে উঠেছিল। এমনকি সেবা ও জনহিতকর কাজেও তাঁদের অবদান ছিল স্মরণীয়। মাদাম কামার অত্যন্ত ধনী পরিবারও সেই গৌরবের অঙ্গীভূত হয়ে ওঠে।

অন্যান্য পার্সি মেয়েদের মতো মাদাম কামারও শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল আলেকজান্দ্রা গার্লস ইংলিশ ইন্সটিটিউশনে। ছোটোবেলা থেকেই বহু ভাষা শিখে দক্ষতা অর্জন করেন তিনি এবং ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে তিনি সমর্থন করতেন। এমনকি কৈশোরকাল থেকেই নিজেই একজন আদ্যন্ত জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠেন মাদাম কামা। ভারতের নানা সংকটের বিষয়ে তিনি ছোটো থেকেই বিভিন্ন মহলে তর্ক-বিতর্ক করতেন। ১৮৮৫ সালের ৩ আগস্ট ধনী আইনজীবী রুস্তম কামার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু এই বিবাহ কখনোই রুস্তম কামা আর ভিকাজি কামার মানসিক দূরত্ব ঘোচাতে পারেনি। তারা উভয়ে মতাদর্শের দিক থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর। একদিকে রুস্তম কামা ব্রিটিশদের অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধাবনত চোখে দেখতেন, তাদের সমীহ করতেন আর অন্যদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার কট্টর বিরোধী ছিলেন মাদাম কামা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন একমাত্র ব্রিটিশদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং ঔপনিবেশিক দখলদারির জন্যেই ভারত দূর্ভিক্ষপীড়িত, অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হয়ে আছে। সেই সময় থেকেই জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি  জনকল্যাণমূলক কাজে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে শুরু করেন। ১৮৯৬ সাল নাগাদ বম্বে প্রেসিডেন্সিতে প্লেগ মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়ে আর তখনই প্লেগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে গ্র্যান্ট মেডিকেল কলেজের স্বেচ্ছাসেবী দলগুলির প্রথম সারির কর্মী হয়ে ওঠেন মাদাম কামা। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। নিজেই প্লেগ আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু চিকিৎসার পরে সুস্থ হলেও দূর্বলতা সহজে কাটে না তাঁর। আরো ভালো চিকিৎসার জন্য ১৯০২ সালে লণ্ডনে পাড়ি দেন তিনি আর জীবনের বাকি সময় তিনি সেখানেই অতিবাহিত করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

দাদাভাই নওরোজির প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। দাদাভাই নওরোজি সেই সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজের সুবাদেই মাদাম কামার পরিচয় সঙ্গে পরিচয় ঘটে বহু দেশপ্রেমী ছাত্র এবং ইউরোপিয় বুদ্ধিজীবীদের যারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মযজ্ঞে মুখ্য ভূমিকা নেন। মনে রাখতে হবে, লণ্ডনে১৯০৪ সালে প্রথমে মাদাম কামার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার যিনি সেসময় লণ্ডনের প্রবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হাইড পার্কে তীক্ষ্ণ জাতীয়তাবাদী ভাষণ দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কৃষ্ণবর্মার সুবাদেই দাদাভাই নওরোজির সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। ১৯০৫ সালে নওরোজি এবং সিং রেওয়াভাই রানার সঙ্গে মাদাম কামার সমর্থনে কৃষ্ণবর্মা স্থাপন করেন ‘ইণ্ডিয়ান হোম রুল সোসাইটি’। চিকিৎসান্তে ভারতে ফিরতে চেয়েছিলেন মাদাম কামা, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার একটি শর্ত আরোপ করে তাঁর আবেদনে এই মর্মে যে ভারতে ফিরে কোনোপ্রকার জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত থাকতে পারবেন না। কিন্তু এই শর্ত মানতে নারাজ হন মাদাম কামা, ফলে তাঁর ফেরার আবেদনও নাকচ হয়ে যায়। ঐ বছরই তিনি প্যারিসে চলে যান স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে। সেখানে এস.আর.রানা এবং মুঞ্চেরশাহ বুজোর্জি গোদরেজের সঙ্গে মিলিতভাবে ‘প্যারিস ইণ্ডিয়ান সোসাইটি’ গরে তোলেন মাদাম কামা। প্যারিসে তাঁর বাড়িটাই হয়ে উঠেছিল প্রবাসী বিপ্লবীদের আলোচনাস্থল। শোনা যায় রুশ বিপ্লবের নেতা মহামতি লেনিনও মত বিনিময়ের জন্য এসেছিলেন মাদাম কামার বাড়িতে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনায় বীর সাভারকরকে সাহায্য করেছিলেন তিনি এবং হল্যাণ্ডের এক প্রকাশককে এই ইতিহাস প্রকাশ করতে দেন তিনি কারণ কোনো ইংরেজ প্রকাশকই এটি ছাপতে রাজি হয়নি। এমনকি যখন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এই বই, বিখ্যাত ‘ডন কুইক্সোট’-এর ভিতর লুকিয়ে সাভারকরের এই বই চালান করা হতো। ধীরে ধীরে মাদাম কামা ‘বন্দে মাতরম্‌’ নামে একটি বিপ্লবী পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। একইসঙ্গে বিপ্লবী ষীদ মদনলাল ধিংরার স্মরণে ‘মদন্স তলোয়ার’ নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। দুটি পত্রিকাই ভারত এবং ইংল্যাণ্ডে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পণ্ডিচেরির ফরাসি কলোনির মাধ্যমে ভারতে এগুলি গোপনে নিয়ে আসা হতো এবং বিলি করা হতো। ১৯০৭ সালের ২২ আগস্ট জার্মানির স্টুটগার্টে দ্বিতীয় সমাজতান্ত্রিক সমাবেশে যোগ দেন মাদাম কামা এবং সেখানে ব্রিটিশদের কারণে ভারতে সৃষ্ট কৃত্রিম দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর প্রকোপের কথা ব্যক্ত করেন তিনি। এই সমাবেশেই বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং মাদাম কামার যৌথ বিন্যাসে নির্মিত ভারতের জাতীয় পতাকা উন্মোচন করেন মাদাম কামা। সেই তেরঙা পতাকার উপরে সবুজ রঙের মধ্যে ছিল আটটি পদ্ম যা কিনা স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের আটটি স্বাধীন প্রদেশের প্রতীক এবং তার নীচে জাফরান রঙের মধ্যে দেবনাগরী হরফে লেখা ছিল ‘বন্দে মাতরম্‌’ আর একেবারে নীচে লাল রঙের মধ্যে একদিকে অর্ধেক চাঁদ আর অন্যদিকে সূর্য ভারতের সম্মিলিত হিন্দু-মুসলিম শক্তিকে চিহ্নিত করে। লাল রঙ শক্তির প্রতীক, জাফরান জয় আর সবুজ রঙ দৃঢ়তা ও উৎসাহের প্রতীক। এই পতাকার সঙ্গে ভারতের বর্তমান জাতীয় পতাকার অনেক পার্থক্য আছে। মাদাম কামার উন্মোচিত এই পতাকা গুজরাটের সমাজতান্ত্রিক নেতা ইন্দুলাল ইয়াগ্নিক ভারতে গোপনে নিয়ে আসেন এবং বর্তমানে এটি পুনের মারাঠা ও কেশরী গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে। স্টুটগার্টের পরে মাদাম কামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বহু জায়গায় সফর করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে দেন এবং ব্রিটিশ শক্তির অত্যাচারের কথাও বলতে থাকেন। তাঁকে মার্কিন প্রদেশে পা রাখা ভারতমাতার প্রথম সাংস্কৃতিক প্রতিনিধির আখ্যা দেওয়া হয়। তারপর আবার লণ্ডনে ফিরে আসেন কামা। মদনলালা ধিংরার কার্জন হত্যাকে কেন্দ্র করে সাভারকরকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সরকার ভারতে নিয়ে যেতে চায় তাঁকে বিচারের জন্য, কিন্তু মার্সেইলস বন্দরে কোনোক্রমে জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ মারেন সাভারকর। পূর্বের কথামতো তীরে এসে মাদাম কামার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও কামা সময়মতো পৌঁছাতে পারনেনি আর তার ফলে পুনরায় ব্রিটিশদের জেলখানায় বন্দি হন সাভারকর। ১৯১০ সালে ইজিপ্টের কায়রো শহরে একটি সমাবেশে মাদাম কামা প্রথম লিঙ্গ সাম্যের কথা সোচ্চারে ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে পুরুষ এবং নারী প্রত্যেকেরই সমান অবদান থাকা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। ১৯২০ সালে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে দুই পার্সি নারী হেরাবাঈ এবং মিঠান টাটার সঙ্গে আলোচনায় বসেন মাদাম কামা এবং তাঁদের তিনি বোঝান যে ভারতে স্বাধীনতা এলে শুধু ভোটাধিকারের স্বাধীনতা নয়, বরং ভারতীয় নারীরা সকল প্রকার অধিকার পাবে। মাদাম কামার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ভীত হয়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁর ভারতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ৩৫ বছর ধরে টানা দেশের বাইরে থাকার পরে অসুস্থ শরীরে একটিবারের জন্য দেশে ফিরতে চান তিনি। অবশেষে ১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে বম্বেতে তাঁকে নিয়ে আসা হয় এবং অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

১৯৩৬ সালের ১৩ আগস্ট মাদাম কামার মৃত্যু হয়।

তাঁর স্মরণে ভারত সরকার ১৯৬২ সালে একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে।

One comment

আপনার মতামত জানান