পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাত

পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাত

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী এবং চিন্তক হিসেবে মহারাষ্ট্রের পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাত(Pandurang Mahadev Bapat) এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিংশ শতাব্দীর মহারাষ্ট্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচারে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য। মূলত গান্ধীপন্থী মহাদেব বাপাত মহারাষ্ট্রের ‘মুলসী সত্যাগ্রহ’-এ প্রত্যক্ষ সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক অবদানের জন্য তাঁকে ‘সেনাপতি’ উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর প্রচারিত ‘শুদ্ধ সত্যাগ্রহ’-এর ধারণা ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলন এবং গোয়ার মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাত।

১৮৮০ সালের ১২ নভেম্বর বম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত আহমেদনগর জেলার পর্ণার-এ একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত মারাঠি চিৎপাবন ব্রাহ্মণ পরিবারে পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাতের জন্ম হয়। তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলায়। বাপাতের বাবা-মায়ের নাম জানা যায় না।

বাপাতের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় আহমেদনগরেই। উনিশ শতকের শেষভাগে পুনেতে নিউ ইংলিশ স্কুলে তিনি চলে আসেন ইংরাজি পড়ার জন্য। সেসময় ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে জাতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী এবং নরমপন্থীদের মধ্যে বিস্তর বিবাদ চলছিল নানা বিষয়ে। বাপাত সেই ঘটনাগুলির সাক্ষী ছিলেন, পুনে শহরেও এর প্রভাব এসে পড়েছিল। পরে পুনেতে চিন্তামণি দেও মারা গেলে তাঁকে পুনরায় ফিরে যেতে হয় আহমেদনগরে ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। ১৮৯৯ সালে বাপাত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সংস্কৃতে তাঁর দক্ষতার জন্য জগন্নাথ শঙ্করশেঠ বৃত্তি লাভ করেন। এর পরেই পুনের ডেকান কলেজে তিনি ভর্তি হন। এই ডেকান কলেজেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে চাপেকর ক্লাবের সদস্য দামোদর বলবন্ত ভিড়ে-র সঙ্গে যিনি বাপাতকে দেশের কাজে নিয়োজিত হতে অনুপ্রাণিত করেন। বলা যায় দামোদর বলবন্ত ভিড়ের প্রেরণাতেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ডেকান কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ১৯০৪ সালে বাপাত ইংল্যাণ্ডে পাড়ি দেন মঙ্গলদাস নাথুবাঈ বৃত্তি পেয়ে। সেখানে এডিনবরার হ্যারিয়ট-ওয়াট কলেজে তিনি ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার জন্য। একইসঙ্গে সেই কলেজের কুইন’স রাইফেল ক্লাবে শ্যুটিং-এর প্রশিক্ষণ নেন বাপাত। এসময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় জন ডিঙ্গল-এর যিনি ইংল্যাণ্ডের ‘স্বাধীন শ্রমিক পার্টি’র নেতা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সহমর্মী ছিলেন। সেই শ্রমিক পার্টির ইস্তাহারে ‘ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়া’ নামে একটি প্রবন্ধ, দাদাভাই নওরজির ‘পভার্টি অফ ইণ্ডিয়া’ ইত্যাদি লেখাগুলি পড়ে তাঁর মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী মানসিকতা গড়ে ওঠে এবং ১৯০৭ সালে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বক্তব্য রাখার জন্য তাঁর বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বাপাতের পাশে দাঁড়ান শ্যামজি কৃষ্ণবর্মা। ইংল্যাণ্ডের ‘ইণ্ডিয়া হাউস’-এ বাপাতের থাকার বন্দোবস্ত তিনিই করে দেন। মূলত দাদাভাই নওরজির বইটি পড়ে ব্রিটিশের শোষণ ও অত্যাচারের ছবি তাঁর চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে। এসময় বিভিন্ন রুশ আন্দোলনকারীদের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয় এবং তাঁদের সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে বলশেভিক বিপ্লবের আদর্শে বাপাত অনুপ্রাণিত হন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বম্বের আর্য শিক্ষা সমাজের উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েই পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাতের কর্মজীবন শুরু হয়। যদিও বাপাতের কর্মজীবনে এই চাকরি নিতান্ত তুচ্ছ ঘটনা। আদ্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়েই তাঁর কর্মজীবনের মালা গাঁথা। বাপাতের রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত তৈরি হয়েছিল ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীন। ইংল্যাণ্ডেই বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। সাভারকরের পরামর্শে কিছু রুশ সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তিনিও প্যারিসে চলে যান বিস্ফোরক প্রস্তুতির কৌশল শিখতে। প্যারিসে তাঁর সঙ্গেই বোমা তৈরি শেখেন হেমচন্দ্র দাস, বাংলার বিখ্যাত বিপ্লবী। ইতিমধ্যে বাপাত ক্রমশ সহিংস আন্দোলনের পথে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। ১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবর্গকে তিনি প্রস্তাব দেন যে তাঁরা যেন আবেদন-নিবেদন নীতি ছেড়ে সক্রিয় চরমপন্থী আন্দোলনে সামিল হন। ১৯০৭ সালে ইংল্যাণ্ডে থাকাকালীনই লালা লাজপত রায়ের নির্বাসনের প্রতিবাদে তিনি সোচ্চারে ব্রিটিশ শাসক মর্লে-কে হত্যার হুমকি দেন, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য মানুষ মারা কোনো ঘৃণ্য কাজ নয় এমন মতবাদ তিনি প্রচার করা শুরু করেন। অবশেষে বোমা বানানোর কৌশল শিখে দুটি রিভলবার এবং একটি ‘বম্বিং ম্যানুয়াল’ নিয়ে দেশে ফেরেন বাপাত। এইসময় বাংলার বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, বারীন ঘোষ প্রমুখরা বিভিন্ন ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন, বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিলেন। পরে ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলা শুরু হওয়ায় মহাদেব বাপাত কিছুদিন গা ঢাকা দেন।

চন্দননগরের মেয়রকে হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে সেই মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে ১৯১২ সালে বাপাত গ্রেপ্তার হন। কিন্তু কোনো উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ১৯১৫ সালে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। জেলে থাকাকালীন তিনি তুকারামের ‘অভঙ্গ’, অরবিন্দ ঘোষের ‘লাইফ ডিভাইন’, গীতা-সংক্রান্ত নানা প্রবন্ধ, ‘গীতাভাষ্য’, উপনিষদ ইত্যাদি বই পড়েন। ফলে তাঁর মনে অজ্ঞেয়বাদ দূর হয়ে ক্রমশ হিন্দু-সংস্কার, হিন্দু-ধর্মের প্রতি ঝোঁক দেখা দেয়। বলা হয় এই সময় থেকেই তিনি গান্ধীপন্থায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তিনি সত্যাগ্রহ, অহিংসা, অনাসক্তি ইত্যাদি ধারণায় অনুপ্রাণিত হলেন। অজ্ঞেয়বাদী থেকে হিন্দুত্বে বিশ্বাস তাঁর রাজনীতি এবং মানসিকতায় বড় ধরণের পরিবর্তন এনে দিল। জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে পুনেতে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন সংহত করতে তিনি বাল গঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে যোগ দেন। ১৯২০ সালে গান্ধীর ‘স্বরাজ’ ভাবনায় ভাবিত হন বাপাত। ঠিক এর পরের বছরই তিনি মুলসী সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দেন। টাটা কোম্পানির তরফে মুলসী অঞ্চলে কৃষকদের জমি দখল করে তার উপর দিয়ে পরীক্ষামূলক পরিখা খনন করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদ করেন এক স্থানীয় কৃষক এবং এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে পিস্তল দেখিয়ে হুমকি দিলে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই মুলসী অঞ্চল ছিল পুনের কাছেই। এখানে একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল টাটা কোম্পানির। কিন্তু সেনাপতি বাপাতের আন্দোলনে বাঁধ নির্মাণ এক বছর স্থগিত থাকে। জাতীয় কংগ্রেস বাপাতের নেতৃত্বে এই মুলসী সত্যাগ্রহ পরিচালনা করে। বম্বে কোর্ট থেকে আদেশ দেওয়া হয় টাটা কোম্পানি একমাত্র কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে তবেই জমি সংগ্রহ করতে পারবেন। তখনই বাঁধ-নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ্যে দুটি ভাগ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণ জমিদাররা সেই ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি থাকলেও ভাগচাষিরা সেনাপতি বাপাতের নেতৃত্বে ক্ষতিপূরণ নিতে তীব্র আপত্তি জানায়। দীর্ঘ তিন বছর ব্যাপী তাঁদের এই আন্দোলন চলে সম্পূর্ণ অহিংস পন্থায়। অবশেষে নির্মাণকার্যে সক্রিয় বাধা দেওয়ার জন্য বাপাত গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ সাত বছর তিনি জেলে ছিলেন। ১৯৩১ সালে বাপাত মুক্তি পান। আন্দোলন ব্যর্থ হয়। বাঁধ নির্মাণ ধীরে ধীরে সমাপ্ত হয়। কিন্তু বাপাতের এই প্রতিবাদ সমসাময়িক রাজনৈতিক পটভূমিকে প্রভাবিত করেছিল।

গান্ধীর সত্যাগ্রহের ধারণাকে পরিমার্জিত করে তিনি ‘শুদ্ধ সত্যাগ্রহ’ শুরু করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংলগ্ন না থাকলেও গান্ধী এবং মূলধারার কংগ্রেস নেতাদের কার্যাবলির সমালোচনা করতে শুরু করেন তিনি। পরিবেশবিদ মাধব গাডগিল এবং ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁদের বই ‘ইকোলজি অ্যান্ড ইকুইটি: দ্য ইউজ অ্যাণ্ড অ্যাবিউজ অফ নেচার ইন কনটেম্পোরারি ইণ্ডিয়া’-তে বাপাতের এই আন্দোলনের কথা লিখেছেন। তাঁরা এও জানিয়েছেন যে বাপাতের শুদ্ধ সত্যাগ্রহ আন্দোলন কখনোই সম্পূর্ণ অহিংস বা সম্পূর্ণ হিংসাত্মক সক্রিয় ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের আরেকটি দিক ছিল ‘প্রাণ-যজ্ঞ’ যা একপ্রকার আত্মহননের মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ জানানো যদিও তাঁর এই পরিকল্পনা বাস্তুবায়িত হয়নি। মুম্বাইতে সুভাষ চন্দ্র বসুর ডাকে সাড়া দিয়ে একটি জনসমাবেশে উপস্থিত থাকার জন্য তৃতীয়বার তাঁকে জেলে যেতে হয়। ১৯৩৯ সালে সুভাষ চন্দ্র বসুর ফরোয়ার্ড ব্লক-দলের মহারাষ্ট্র শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন বাপাত এবং হায়দ্রাবাদে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হলে পুনে শহরে তিনিই প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তাঁর স্মৃতিতে পুনের রাস্তার নাম পালটে রাখা হয় সেনাপতি বাপাত রোড। ১৯৬৪ সালে অমর চিত্র কথা কমিক্স ধারাবাহিক প্রকাশিত হয় বাপাতের জীবনকে নিয়ে। ভারত সরকার সেনাপতি বাপাতের স্মরণে এবং তাঁর সম্মানে ১৯৭৭ সালে একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করে।

১৯৬৭ সালের ২৮ নভেম্বর ৮৭ বছর বয়সে পাণ্ডুরঙ্গ মহাদেব বাপাত ওরফে সেনাপতি বাপাতের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান