হিংলাজ মন্দিরটি পাকিস্তানের করাচি থেকে উত্তর-পূর্বে ৯০ মাইল দূরে বালুচিস্তান প্রদেশের মাকরান মরুভূমির উপর অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ পড়েছিল।এখানে অধিষ্ঠিত দেবী কোট্টরা,যিনি মুসলিমদের কাছে আবার “নানী বিবি” নামে পরিচিত। এবং ভৈরব হলেন ভীমলোচন। যা হিন্দুদের কাছে হিংলাজ তীর্থ ,তাই আবার মুসলিমদের কাছে “নানী কি হজ” নামে বিখ্যাত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় এটিই সর্বশ্ৰেষ্ঠ ও সর্বপ্রথম সতীপীঠ। দেহের প্রথম অংশ হলো মস্তক,এখানে দেবীর মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ পতিত হয়েছিল।
আরব সাগরের তীরে অবস্থিত পাকিস্তানের এই অঞ্চলের (বেলুচিস্তান)সাথে মিলিত রয়েছে ইরান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত।এরই মাঝে মাকরান মরুভূমির মধ্যে রয়েছে চারহাজার ফুট উঁচু হিংলাজ পর্বত, মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে হিঙ্গুলা নদী।এই নদীর পাশে হিঙ্গল অভয়ারণ্যের মধ্যে গুহার ভিতর দুর্গম এই সতীপীঠ অবস্থিত। আগেকার দিনে এই যাত্রা ছিল অত্যন্ত কঠিন। প্রায় একমাস সময় ধরে শুকনো মরু পেরিয়ে হিংলাজ পৌছানো যেত। তীর্থযাত্রীরা ছড়িদারদের সাহায্যে ধূ ধূ মরুভূমি পার হয়ে হিংলাজ যাত্রার উদ্দেশ্যে জমায়েত হত নাগনাথের আখড়ায়। বহু প্রাচীন এই আখড়া থেকেই উঠের পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু হত। সঙ্গে থাকত শুকনো খাবার,জল আর মরুদস্যুদের হাত থেকে বাঁচার কিছু অস্ত্র, পথপ্রদর্শক ছড়িদারদের হাতে থাকত ত্রিশূল আকৃতির গাছের ডাল,সেই গাছের ডালে তারা নানারঙের কাপড় জড়িয়ে রাখত। ধূ ধূ প্রান্তরের যেখানে যাত্রীরা যাত্রাবিরতি নিত, সেখানেই সেই ত্রিশূল পুঁতে দেওয়া হত। আবার শুরু হতো পথ চলা। এরপর করাচিতে হাব নদীর কাছে পৌঁছলে সেখানে তীর্থযাত্রীদের গেরুয়া রঙের কাপড় দেওয়া হত, সেটা হাতে বেঁধে তারা কিছু শপথ গ্রহণ করত, যার মধ্যে সন্ন্যাস নেওয়া ও একে অপরকে জল না দেওয়ার শপথ হলো উল্লেখযোগ্য। তারপর হিংলাজ মায়ের গান গাইতে গাইতে এইভাবেই যাত্রীরা বিশাল পথ অতিক্রান্ত করত। এরপর পথে আসত চন্দ্রকূপ নামে উষ্ণকুন্ড। ধর্মভীরুদের বিশ্বাস এই কুণ্ডের সামনে পাপ স্বীকার করলে মা তাকে ক্ষমা করে দেন। তাই চন্দ্রকূপের সামনে পাপ স্বীকার করে অনুমতি নিয়ে হিংলাজ মায়ের উদ্দেশ্য রওনা হত সবাই। এরপর পথে আসত অঘোর নদী, এই নদী পার হলেই হিংলাজ পর্বতে মায়ের দর্শন পাওয়া যেত। তবে মাকে দর্শনের আগে তীর্থযাত্রীরা “মোহন্ত মহারাজের” পুজো করত। এভাবেই মাতা হিংলাজের কাছে পৌছানো যেত। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অবধূত রচিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ সম্বন্ধে অনেকেই জানেন। একই নামে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ছবি। বিশাল মরুভূমি (থর ও মাকরান) পার করে দেবী হিংলাজ দর্শনের কাহিনী লিখেছিলেন তিনি। হিংলাজ যাত্রা কত কঠিন সেই উপলব্ধি স্পষ্ট হয়েছিল তাতে। এখনও হিংলাজ দর্শন যে কোনও ভারতীয় তীর্থযাত্রীর কাছে কঠিন। এমনিতেই কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে এখানে ভারতীয়দের ভিসা পাওয়াই দুরূহ। তার উপর বালোচিস্তান প্রদেশ নিয়ে বিতর্কের জের তো রয়েছেই। ফলে দেবী হিংলাজ দর্শনে যাওয়া কঠিনতর হয়েছে।
হিংলাজের মন্দিরটি একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত৷ এটি আসলে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসের অগ্নিকুণ্ড৷ অগ্নিজ্যোতিকেই হিংলাজদেবীর রূপ বলে মানা হয়৷ গুহার সামনে গোলাকৃতি বেদির উপর কাপড় জড়ানো সিঁদুর মাখানো দুটি শিলামূর্তি রয়েছে।পুরোহিতদের মতে এই দুটি হিংলাজ মা ও তার মেয়ে। এর পাশে সুড়ঙ্গ দিয়ে গুহায় যাবার দরজা আছে।যেখানে হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া যায়। এখানে অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, তবে দেবীর জ্যোতি অনেক সাধক নাকি প্রত্যক্ষ করেছেন।
তথ্যসূত্র
- একান্ন পীঠ, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৭৮, সমন্বয়ের মহাতীর্থ হিংলাজ
- https://eisamay.indiatimes.com/eisamay.indiatimes.com/astrology/dharma-karma/pilgrimage/hinglaj
- https://bn.m.wikipedia.org/wiki/হিংলাজ
- https://abpanandanews.blogspot.com/হিংলাজ
One comment