খড়্গ/খাঁড়া – এই পদবীর উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। মনে করা হয়, খড়্গ-ই পরিবর্তিত হয়ে খাঁড়া হয়েছে। বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেবখড়্গ, জাতখড়্গ ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়। একসময় বৃত্তিধারী রাজকর্মচারীদের ‘খন্তরক্ষক’ পদ দেওয়া হতো। খন্ত বলতে ভুক্তির অন্তর্গত ছোট অঞ্চল (অনেকটা মৌজার মতো) বোঝাতো। সেখান থেকে খাঁড়া এসে থাকতে পারে বলে অনুমান। আবার, খড় শব্দের অর্থ শুকনো ঘাস (বিচুলি)। খড় গাঁ (গ্রাম) থেকে অর্থাৎ জায়গার নাম থেকে খড়্গ/খাঁড়া পদবীর উদ্ভব বলে একাংশ গবেষকের মত।
খান/খাঁ – উপাধিভিত্তিক পদবী। পাঠান রাজত্বকালে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের ‘খাঁ’ উপাধি দেওয়া হতো। সম্মান আরও বাড়লে বলা হতো খাঁসাহেব। গৌড়ের বাদশার হিন্দু সেনাপতিদের খাঁ উপাধি দেওয়ার চল ছিল। আবার, জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যও এই উপাধি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ফারসি ‘খান’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ খাঁ।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
খাসনবিশ/খাসনবীশ – পেশাভিত্তিক পদবী। এঁরা ছিলেন কেরানি বা হিসেবরক্ষক, রাজা-জমিদারদের নিজস্ব মুনশি (private secretary)। আবার, জমিদারদের বাৎসরিক পাট্টা পরিবর্তনের জন্য যে সেলামি দিতে হতো তাকে খাসনবিশী বলা হতো। মুঘলযুগে খাসনবিশ বলে একটা সরকারী পদ ছিল। আরবি খাস (রাজা/নবাবের নিজস্ব জমি) + নবীশ – অর্থাৎ, যিনি রাজা বা নবাবের নিজস্ব জমি দেখাশোনা করতেন, তিনিই খাসনবীশ/খাসনবিশ।
গর্গ – গোত্র প্রবর্তকের নাম অনুসারে এসেছে এই পদবী। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই পদবী দেখা যায়।
গলুই/গোলাই – এই পদবীর উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একটা মত অনুযায়ী ‘গোপ’ বা ‘গুপ্ত’ এর অপভ্রংশ গলুই/গোলাই। আবার ভিন্নমতে, যেহেতু গলুই শব্দের অর্থ নৌকোর সামনের বা পিছনের সরু অংশ, তাই নৌকো চালানোর সাথে যুক্ত মানুষদের কোনও একসময় হয়তো এই উপাধি দেওয়ার চল ছিল; আর সেখান থেকেই এই পদবীর উৎপত্তি।
গড়াই – পদবীর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত। ব্রাহ্মণদের আদি পদবী গুড় থেকে গড়াই এসেছে বলে একাংশ গবেষকের অনুমান। আবার অন্য এক মতে, ঘানিতে তেল নিষ্কাশন করার জন্য যে যাঁতা ব্যবহার হতো, সেই যাঁতা গড়ানোর কাজে যাঁরা যুক্ত থাকতেন তাঁদের থেকে গড়াই পদবীর প্রাপ্তি। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন গড়ের কাছাকাছি বসবাস থেকে গড়াই পদবী এসেছে। কোনও বস্তু নির্মাণ বা গড়া থেকেও এই পদবী এসে থাকতে পারে।
গড়গড়ি – স্থানভিত্তিক পদবী। এসেছে গাঞি নাম অনুসারে। সম্ভবত গড়গড়ে গ্রাম থেকে এই নাম এসেছে। মূলত ব্রাহ্মণদের পদবী।
গঙ্গোপাধ্যায়/গাঙ্গুলী – লৌকিক শব্দকোষ অনুসারে গঙ্গোপাধ্যায়ের আদি পদবী গাঙ্গুর। মনু সংহিতা উপাধ্যায়ের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছে, জীবিকার জন্য যিনি বেদের একাংশ বা বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করান তিনিই উপাধ্যায়। স্পষ্টতই গাঞি নামের সাথে উপাধ্যায় জুড়ে গঙ্গোপাধ্যায় হয়েছে। বর্ধমান জেলার বাঁকা নদের কাছে গঙ্গ নামে যে গ্রাম, সেই গ্রামের অধিবাসী ও পেশায় উপাধ্যায় এমন অধিবাসীদেরই পদবী গঙ্গোপাধ্যায়। এদিকে, গাঙ্গুলী এসেছে গঙ্গাকুলিক থেকে অর্থাৎ যাঁরা গঙ্গার কূলে বসবাস করেন। সেক্ষেত্রে গঙ্গার তীরবর্তী যে কোনও অঞ্চলের ব্রাহ্মনরাই গাঙ্গুলী হতে পারেন। যদিও গঙ্গোপাধ্যায় ও গাঙ্গুলী একই পদবী হিসেবে ব্যবহার হয়, কেউ কেউ মনে করেন এদের উৎপত্তি একই গাঞি নাম থেকে নয়।
গায়েন/গাইন – গায়েন শব্দের অর্থ গায়ক। মল্লভূম অঞ্চলে বীর হাম্বীরের আমলে যাঁরা গাইয়ে ছিলেন তাঁদের গায়েন উপাধি দেওয়া হয় সম্ভবত রাজপরিবারের তরফ থেকে। সেখান থেকেই এই পদবীর উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। পুরোনো পুথিপত্র ঘেঁটে পাওয়া যায় যে এক কালে গায়েনরা বেশ উচ্চশিক্ষিত ও সম্পদশালী ছিলেন।
গিরি – গিরি অর্থ পর্বত। পর্বতের মতো উঁচু অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত মানুষদের পদবী গিরি ছিল বলে অনুমান। আবার দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের পদবীও গিরি। সেখান থেকেও এই পদবী এসে থাকতে পারে।
গুঁই – সংস্কৃত গোমিক শব্দের অপভ্রংশ। অন্য এক মতে, গুণী থেকে গুঁই এসেছে।
গুণ – গুণ শব্দের অর্থ পারদর্শিতা। বীর্যবত্তা অর্থেও এর ব্যবহার আছে। এখান থেকেই গুণ পদবীর উৎপত্তি বলে অনুমান করা হয়। গুণী থেকে গুণ এসেছে কি না সে নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে। মূলত কায়স্থ পদবী এটি। গুপ্ত যুগের আগেই পশ্চিম ভারত থেকে বাংলায় কায়স্থরা এসেছিল। তাঁরা তাঁদের অধিপতি ও ধর্মাচার্য্যের উপাধির অনুকরণে, নিজেদের উপাস্য দেবতাদের নামে এবং নিজেদের পারদর্শিতা বা বীর্যবত্তা অনুসারে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন যেগুলো পরে পদবীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘গুণ’ সেরকমই এক পদবী।
গুপ্ত – গুপ্ত অর্থ যা লুকিয়ে রাখা হয়েছে বা গোপনীয় যা। এটিও কায়স্থ পদবী যা কায়স্থদের অধিপতিদের উপাধি থেকে এসেছে। এই ধরণের অন্যান্য পদবী – বর্মা, বর্ধন, রানা, রাহুত, শূর। তবে গুপ্ত পদবীর উৎপত্তির অন্য ব্যাখ্যাও আছে। যিনি রাজার ফসলের ভাগ গ্রহণ করে গোলাজাত করেন তাঁকে গুপ্ত বলা হতো। সেখান থেকেও এই পদবী এসে থাকতে পারে। আবার আর এক মত অনুসারে নামের (ব্রহ্মগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত ইত্যাদি) শেষাংশ থেকে গুপ্ত এসেছে।
গুহ – পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, চিত্রগুপ্ত ছিলেন কায়স্থ। সেই বংশের রাজা ধর্মযজ্ঞ তাঁর এগারোজন পুত্রকে নৈমিষয়ারণ্যে আটজন ঋষির কাছে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষার জন্য। যে ঋষির কাছে যে পুত্র গিয়েছিলেন সেই ঋষির গোত্র তিনি লাভ করেন এবং নিজ গুণ বা কাজের জন্য আলাদা আলাদা উপাধি পান। ধর্মযজ্ঞের এক পুত্র গুহ্যক গিয়েছিলেন ঋষি কাশ্যপের আশ্রমে। কাশ্যপের আশ্রম ছিল কোনও গুহার ভেতরে। সেইজন্য তিনি গুহ উপাধি পান। গুহ পদবীর উৎপত্তির পেছনে এই পুরাণের গল্পই শোনা যায়। কায়স্থ ছাড়া অন্য কোনও জাতির মধ্যে গুহ পদবী পাওয়া যায় না।
গুড় – গুড় পদবীটি বিভিন্ন জাতির মধ্যে দেখা যায়। বাঙালি রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের আদি পদবী ছিল গুড়। আবার আদিবাসী সমাজে এই পদবীর যথেষ্ট প্রচলন আছে। মনে করা হয় এটি বস্তুবাচক পদবী। মনে করা হয় যে হিন্দু সভ্যতার কাছে পরাজিত হয়ে আদিবাসী সমাজ শেষে হিন্দুসমাজে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তাদের আচার-ব্যবহার রীতিনীতির পরিবর্তন করে উন্নত জাতিতে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করে। তারা উন্নীত হলেও তাদের আদি বস্তুবাচক পদবী অক্ষুণ্ণ থেকে গেছে।
গুছাইত – সম্ভবত পেশাভিত্তিক পদবী। গুচ্ছবিৎ > গোছাইত > গুছাইত; অর্থাৎ পুজো বা বিয়ের অনুষ্ঠানে বা রাজসভায় যে গোছগাছ করতো।
গোপ – এই পদবীর উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন গোপালক থেকে গোপ এসেছে। আবার অন্য এক মত অনুসারে, যিনি বা যাঁরা রাজার ফসলের অংশ গোলাজাত করেন তাঁদের গোপ বলা হয় আর সেখান থেকেই এই পদবীর উৎপত্তি। সাধারণত, যাদব বা সদগোপদের মধ্যে এই পদবী দেখা যায়।
গোঁসাই/গোস্বামী/গোসাঁই/গোহাঁই – ইতিহাস ঘাঁটলে ‘কৃষ্ণস্বামী’, ‘বিষ্ণুশর্মা’ এইসব নাম পাওয়া যায়। এই স্বামী বা শর্মা কীভাবে পদবীতে পরিণত হয়েছে তা সঠিক জানা যায় না। তবে স্বামীর বৈষ্ণব রূপান্তর গোস্বামী বলে মনে হয় আর স্বামী থেকেই সাঁই অর্থাৎ গোস্বামী থেকে গোঁসাই বা গোসাঁই। পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে গোঁসাই হয়েছে গোহাঁই ও বড় গোহাঁই।
গোলদার – পেশাভিত্তিক পদবী। এঁরা ছিলেন মূলত আড়তদার (গোলা বা আড়তের দেখাশোনা করতেন)। গোলাদার থেকে গোলদার।
ঘটক – পেশাগত পদবী। ঘটকের অভিধানিক অর্থ দূত। আবার, মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও এর ব্যবহার আছে। ঘটকের কাজই ছিল বিবাহযোগ্য পাত্র-পাত্রীর পরিবারের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো। প্রতিটি জাতিরই কিছু পেশা নিৰ্দিষ্ট ছিল এবং তাই দিয়েই সমাজে তাদের পরিচিতি ছিল। পরে সেগুলোই পদবীতে পরিণত হয়েছে। ঘটকের ক্ষেত্রেও সেভাবেই এই পদবীর উৎপত্তি।
ঘোষ – পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, চিত্রগুপ্ত ছিলেন কায়স্থ। সেই বংশের রাজা ধর্মযজ্ঞ তাঁর এগারোজন পুত্রকে নৈমিষয়ারণ্যে আটজন ঋষির কাছে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষার জন্য। যে ঋষির কাছে যে পুত্র গিয়েছিলেন সেই ঋষির গোত্র তিনি লাভ করেন এবং নিজ গুণ বা কাজের জন্য আলাদা আলাদা উপাধি পান। ধর্মযজ্ঞের এক পুত্র মতিমন্ত বিদ্যালাভ করেন সৌকালীন ঋষির আশ্রমে। মতিমন্তের গুণ-কীর্তির যশ সবর্ত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি ‘ঘোষ’ উপাধি লাভ করেন। পুরাণ মতে সেখান থেকেই ঘোষ পদবীর উৎপত্তি। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন যে রাজসভায় ঘোষণাকারী বা ঘোষক থেকে ঘোষ পদবী এসেছে। কুলীন কায়স্থ ছাড়াও গোয়ালাদের মধ্যে এই পদবী দেখা যায়।
ঘোড়া/ঘোড়াই/ঘোড়পতি/ঘোড়পান্ডে/ঘড়াই/ঘোড়ফাঁড়ে – পেশাভিত্তিক পদবী। ঘোড়া জন্তুবাচক পদবী। অশ্বশালা বা ঘোড়াশালার রক্ষক থেকে ঘোড়পতি পদবীটি এসেছে বলে মনে করা হয়। আবার, ঘড়ুই বা ঘড়াই পদবীটির সাথে ঘরামি বৃত্তির যোগ আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
ঘোষাল – ব্রাহ্মণদের স্থানভিত্তিক পদবী। ঘোষ বা ঘোষল গাঞি নাম থেকে এই পদবীর উৎপত্তি। ভাষাতত্ত্ববিদদের একাংশ মনে করেন যে ‘ঘোষপাল’ থেকে ঘোষাল এসেছে। ঘোষপাল অর্থ যাঁরা গোচরভূমির কাছে বাস করেন। সেদিক থেকে দেখলে কোনও নির্দিষ্ট গ্রামের নাম অনুসারে ঘোষাল এসেছে এমন বলা যায় না।
ঘোষঠাকুর – মূলত বৈষ্ণবদের মধ্যেই এই পদবীটি চোখে পড়ে। বর্ধমান জেলার অগ্রদ্বীপ গ্রামে গোবিন্দ ঘোষ নাম শ্রীচৈতন্যদেবের একজন পার্ষদ ছিলেন। বৈষ্ণবেরা তাঁকে ঘোষঠাকুর বলে ডাকতো। পরে এই ঘোষঠাকুর বৈষ্ণবদের মধ্যে পদবী হিসেবে মান্যতা পায়।
তথ্যসূত্র
- বঙ্গীয় শব্দকোষ - হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- আমাদের পদবীর ইতিহাস - লোকেশ্বর বসু
- পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস - শ্রীখগেন্দ্রনাথ ভৌমিক
- বাংলার পদবি কথা - দেবাশিস ভৌমিক
