পরম শূন্য তাপমাত্রা

বিজ্ঞানীরা ‘পরম শূন্য তাপমাত্রা’ তৈরি করেন কীভাবে

একেবারে মাধ্যমিক স্তরের পদার্থবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে আমরা অনেকেই জেনেছি যে তাত্ত্বিকভাবে আদর্শ গ্যাসের সূত্রানুযায়ী দেখা গেছে কোনো গ্যাসের তাপমাত্রা যদি ক্রমহ্রাসমান হতে হতে একেবারে -২৭৩ সেলসিয়াসে (আরও নির্দিষ্ট করে বললে -২৭৩.১৫সেলসিয়াস ) পৌঁছে যায়, তাহলে সেই গ্যাসটির আয়তন শূন্য হয়ে যায়। এই অত্যন্ত শীতল প্রায় অকল্পনীয় তাপমাত্রাকেই আমরা পরম শূন্য তাপমাত্রা (absolute zero temperature) বলে। স্বাভাবিক ধারণায় অনেকের মনেই প্রশ্ন এসেছিল যে সত্যিই কী এই তাপমাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব? নাকি এটা শুধুমাত্র তাত্ত্বিকভাবেই প্রমাণিত? পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা থেকেই আমরা জানতে পেরেছি যে কোনো গ্যাসকেই শীতল করতে গেলে প্রথমে তা তরল এবং পরে কঠিনে পরিণত হয়। কিন্তু তাহলে গ্যাস একেবারে আয়তনহীন কীভাবে হতে পারে? সমস্যা যখন সামনে আসে, তাঁর সমাধানও থাকে। বিজ্ঞানীরা বহু গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন কোনোভাবেই একেবারে নিখুঁত পরমশূন্য তাপমাত্রা তৈরি করা সম্ভব নয়, তবে কিছু বিশেষ উপায়ে এর কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক, বিজ্ঞানীরা ‘পরমশূন্য তাপমাত্রা’ তৈরি করেন কীভাবে ।

পরমশূন্য তাপমাত্রার সূচক হল ০ কেলভিন। আমরা জানি যে তাপমাত্রা পরিমাপের এস.আই একক হল কেলভিন। কেলভিন স্কেলে শূন্য তাপমাত্রার অর্থ সেলসিয়াস স্কেলে -২৭৩। ঘরের তাপমাত্রা যদি ২৭ সেলসিয়াস হয় তাহলে তা কেলভিন স্কেলে হবে ৩০০ কেলভিন। সাধারণভাবে কোনো গ্যাসের মধ্যেকার অণুগুলির অনবরত যে চারদিকে ছুটে চলে তার মধ্যে নিহিত গতিশক্তিই আসলে সেই গ্যাসটির তাপমাত্রার সূচক। সেই গ্যাসের তাপমাত্রা হ্রাস পেলে গ্যাসের অণুগুলির গতিশক্তিও কমে যাবে। গ্যাসকে বা অন্য কোনো বস্তুকে ঠান্ডা করার জন্য হিমাঙ্কের অনেক নীচে তাপমাত্রা নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক সময় তরল নাইট্রোজেন গ্যাস বা তরল হিলিয়াম গ্যাসের সাহায্য নেওয়া হয়, কিন্তু এইগুলির সাহায্যে কখনোই পরমশূন্যে পৌঁছানো যায় না। পরমশূন্য উষ্ণতায় গ্যাসের অণুর মধ্যে কোনো গতিশক্তিই থাকবে না।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন আমাদের এই মহাবিশ্বের গড় উষ্ণতা ২.৭ কেলভিন। ফলে কোনো জায়গায় যদি এর নীচে তাপমাত্রা নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসারে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুসারে কোনো পদার্থের পরমাণু একইসঙ্গে দুই রকম অবস্থানে থাকতে পারে। হাইজেনবার্গের নীতি অনুযায়ী কোনো পদার্থের কোয়ান্টাম ব্যবস্থা সবথেকে কম একটি অশূন্য শক্তি স্থিতিতে এসে উপনীত হতে পারে, কিন্তু এখানে পদার্থের পরমাণুগুলির গতি শূন্য হয় না। তাপগতিবিদ্যার নীতি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে গেলে দেখা যাবে, গ্যাসকে শীতল করার জন্য বা উষ্ণ করার জন্য কিছু শক্তি প্রয়োজন যা কার্যের অংশ। অর্থাৎ গ্যাসের তাপমাত্রা কমাতে গেলে কিছু পরিমাণ কার্য করতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, পরম শূন্য উষ্ণতায় পৌঁছানোর জন্য অসীম পরিমাণ কার্য প্রয়োজন যা বাস্তবে অসম্ভব। তাই পরম শূন্য উষ্ণতায় পৌঁছানো বাস্তবে অসম্ভব।

কার্যত নিখুঁতভাবে পোঁছানো না গেলেও বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় পরম শূন্য তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে আর তা হয়েছে লেজার কুলিং-এর মাধ্যমে। লেজার কুলিং পদ্ধতিতে গ্যাসের পরমাণুর উপরে আলো ফেলে তার তাপমাত্রা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড ওয়াইনল্যাণ্ড, হান্স ডেমেল্ট, উইলিয়াম ফিলিপ্স, স্টিভেন চু প্রমুখরা এই পদ্ধতিতে পরীক্ষাগারের মধ্যেই মাইক্রোকেলভিন অর্থাৎ এক কেলভিনের এক লক্ষ ভাগ পর্যন্ত তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে জেনে রাখতে হবে, আলো আসলে একটি ফোটন কণার স্রোত যার মধ্যে কিছু শক্তি নিহিত আছে। দ্বিতীয়ত এই ফোটন কণার ভর না থাকলেও ভরবেগ আছে। পরমাণুর মধ্যে আলো পড়লে তার কম্পাঙ্ক অনুযায়ী পরমাণুর মধ্যেকার ইলেকট্রন দেখে নেয় তাঁর মধ্যে ফোটন শক্তি আছে কিনা, উপযুক্ত কম্পাঙ্কের আলো থেকে ফোটন গ্রহণ করে সেই ইলেকট্রন কক্ষপথ পালটে উপরের দিকে চলে যায় আর এই ফোটন গ্রহণের সময় ভরবেগ থাকার কারণে ফোটন পরমাণুর ইলেকট্রনকে প্রত্যাঘাত করে বলে সেই ইলেকট্রনটির গতিশক্তি কমে যায়। এভাবে একের পর ইলেকট্রন ফোটন গ্রহণ করে গতিশক্তি হারাতে থাকলে গ্যাস বা পদার্থের তাপমাত্রা কমতে পারে। কারণ আমরা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছি যে তাপমাত্রা আসলে গ্যাসের মধ্যস্থিত অণু বা পরমাণুর গতিশক্তির সূচক। দেখা গেছে কিছু পরমাণু আলোর উল্টোদিকে ছুটে যায় তাদের শীতল করার জন্য অন্য দিক থেকে আলোকরশ্মি ফেলা হয়।

লেজার কুলিং এর মাধ্যমে মাইক্রো কেলভিন তাপমাত্রা অবধি কমানো যায়, এরপরেও ইভাপোরেটিভ কুলিং-এর (evaporative cooling) মাধ্যমে ন্যানো কেলভিন পর্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ন্যানো কেলভিনের পরিমাণ আসলে এক মাইক্রো কেলভিনের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। একটা বিশেষভাবে নির্মিত চুম্বকীয় ফাঁদ সৃষ্টি করে তাঁর মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে উচ্চশক্তি সম্পন্ন পরমাণুগুলিকে নিষ্কাশিত করে নিলে আস্তে আস্তে ঐ অংশের গ্যাসের উষ্ণতা ন্যানোকেলভিন পর্যন্ত নেমে আসতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষায় দেখেছেন।

পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন নিউক্লিয়ার ডিম্যাগনেটাইজেশন রেফ্রিজারেটর যার দ্বারা ন্যানোকেলভিন তাপমাত্রা তৈরি করা সম্ভব। এখনও অবধি সর্বনিম্ন ৫০ পিকোকেলভিন উষ্ণতায় (১ কেলভিন = ১০-১২ কেলভিন) পৌঁছানো গেছে।

পরমশূন্য উষ্ণতার কাছাকাছি যত যাওয়া যাবে তত গ্যাসের অণুগুলির মধ্যে অসামঞ্জস্য এবং অদ্ভুত আচরণ লক্ষ করা যায়, সুপারফ্লুইডিটি, সুপারকণ্ডাক্টিভিটি ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম। পরম শূন্য উষ্ণতায় পৌঁছানোর এই গবেষণার ফলে বিজ্ঞানীদের সামনে খুলে গেছে সম্ভবনাময় নতুন কোয়ান্টাম জগত। কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে কোন সুপার কম্পিউটারের থেকে কয়েক লক্ষ গুণ দ্রুত কাজ করে। পরম শূন্য উষ্ণতা এবং তার ফলে পদারথের অবস্থা নিয়ে গবেষণা আজও চলছে। পরমশূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছানো না গেলেও তার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া গেছে আর এটাই বিজ্ঞানের এক বিরাট অগ্রগতির পরিচায়ক।

আপনার মতামত জানান