কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা হয়তো প্রায় কেউই শুনিনি। সাধারণ কম্পিউটার তো দেখেছি সকলে, কাজও করি আমরা সেইসব যন্ত্রে। তাহলে কী নতুন বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে তা জানতে তো ইচ্ছে হবেই। প্রযুক্তির উন্নতিতে সাধারণ কম্পিউটারের তুলনায় কয়েক হাজার গুণ বেশি গতিতে জটিল সব সমস্যার সমাধান করা যায় এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে। তাহলে প্রশ্ন আসবেই স্বাভাবিকভাবে যে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসলে কী? চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক।
কোয়ান্টাম গণনা পদ্ধতিতে খুব দ্রুত সাধারণ কম্পিউটারের থেকে অনেক বেশি গতিতে যে বিশেষ প্রকারের কম্পিউটার জটিল সব সমস্যার সমাধান নিমেষেই করে ফেলতে পারে, সেটিই হল কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Quantum Computer)। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক। সাধারণ কম্পিউটার কাজ করে মূলত বাইনারি পদ্ধতিতে। অর্থাৎ এখানে যে কোনো ইনপুট বা আউটপুট দুটি বাইনারি ডিজিটের সাহায্যে দেওয়া হয় – ০ আর ১। যেহেতু দুটি বিকল্প থাকে তাই এর নাম বাইনারি ব্যবস্থা। এই ০ আর ১ মিলে তৈরি করে ‘বিট’ (Bit)। এই বিট হল বৈদ্যুতিক বা আলোক সংকেতের প্রতিনিধিত্বকারী। এই পদ্ধতিতে আটটি বিট মিলে তৈরি হয় এক বাইট (Byte)। সাধারণ কম্পিউটার এই বিট পদ্ধতিতেই কাজ করে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারে দেখা যায় বিটের বদলে রয়েছে কিউবিট ব্যবস্থা (Qubit)। বিট যেখানে একটি তথ্যকে সংরক্ষণ করতে পারে, তুলনায় একটি কিউবিট একইসঙ্গে একাধিক তথ্য সংরক্ষণে সক্ষম। কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হয়েছে যে পদার্থের মধ্যে যে পরমাণু রয়েছে তার একইসঙ্গে দুটি ধর্ম বিদ্যমান – কণা ধর্ম এবং তরঙ্গ ধর্ম। ফলে কোয়ান্টাম মতে একটি কণা একইসঙ্গে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে। তাই এই পদ্ধতিতে ঐ ০ আর ১ এর মাধ্যমে বহুগুণ বেশি তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবে কম্পিউটার। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে একটি বিটের তুলনায় একটি কিউবিটের তথ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা জ্যামিতিক হারে (Geometric Progression) বাড়ে, অর্থাৎ দুই কিউবিট চারটি তথ্য সংরক্ষণ করতে পারলে চার কিউবিট পারবে আটটি তথ্য সংরক্ষণ করতে। আবার আটটি কিউবিট একইসঙ্গে ষোলোটি তথ্য সংরক্ষণে সক্ষম। সাধারণ কম্পিউটারে যেখানে আটটি বিট ০ থেকে ২৫৫-এর মধ্যে যেকোনো একটি সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, সেখানে আটটি কিউবিট ০ থেকে ২৫৫-এর মধ্যে সবকটি সংখ্যাকেই একইসঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। গাণিতিক অনুমানে দেখা গেছে, কয়েক শত কিউবিট যে পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে তত সংখ্যক পরমাণু সমগ্র বিশ্বেই নেই। তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি যে কোনো হিসাবের সমস্যাও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে খুব দ্রুত সমাধান করা সম্ভব। যে কোনো রকম জটিল তথ্যের সমাহার থেকে তার ফলাফল নির্ণয় করা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে খুব সহজভাবে করা সম্ভব, অনেক কম সময়ে নির্ভুলভাবেই তা করা যায়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে একটি সুপার কম্পিউটারের থেকেও শক্তিশালী এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার। একটি ইলেকট্রনের একবার ঘূর্ণন বা ফোটন কণার অবস্থানের উপর নির্ভর করে কিউবিট তৈরি হয়। একটি কিউবিটের ধারাক্রম একইসঙ্গে বিভিন্ন তথ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে যাকে কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট (Quantum Entanglement) বলে এবং এই সমস্ত কিউবিটগুলি একে অপরের সঙ্গে কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের (Quantum Superposition) সাহায্যে যুক্ত থাকে।
১৯৮০ সালে যখন বিজ্ঞানী পল বেনফ্ ট্যুরিং মেশিনের জন্য একটি কোয়ান্টাম মেকানিকাল মডেল প্রস্তুত করেন তখন থেকেই কোয়ান্টাম গণনা পদ্ধতির জন্ম হয়। পরবর্তীকালে রিচার্ড ফাইনম্যান এবং ইউরি ম্যানিন বলেন যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের থেকেও অনেক কম সময়ে জটিল তথ্যের সমস্যা সমাধান করতে পারবে। ১৯৯৪ সালে পিটার শ্যর একটি কোয়ান্টাম অ্যালগোরিদম্ (Quantum Algorithm) প্রস্তুত করেন পূর্ণসংখ্যার উৎপাদকে বিশ্লেষণের জন্য। সাধারণ কম্পিউটারের থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অতি সক্রিয়তার বৈশিষ্ট্যকে বিজ্ঞানী জন প্রিস্কিল কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি বলে চিহ্নিত করেছেন। এখনও পর্যন্ত গুগল এবং আইবিএম কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জনে সক্ষম হয়েছে বলে জানা যায়। ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ব্যবস্থার মাধ্যমে মাত্র সাড়ে তিন মিনিট সময়ে এমন এক জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব যা কিনা সাধারণ কম্পিউটারের মাধ্যমে করতে গেলে প্রায় দশ হাজার বছর সময় লেগে যেত। আরো জানা যায়, গুগলের নির্মিত কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রসেসরে হিলিয়াম-৩ ব্যবহৃত হয় যা পারমাণবিক বিশ্লেষণের ফলেই একমাত্র তৈরি হতে পারে। আমাদের বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অজস্র কম্পিউটারের মাধ্যমে রোজই প্রায় ২.৫ হেক্সাবাইট তথ্য উৎপন্ন হয় যা সংরক্ষণ করে খুব দ্রুত বিশ্লেষণ ও সমাধান করার ক্ষমতা রয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের।
এখন জেনে নেওয়া যাক কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিছু প্রকারভেদ সম্পর্কে। প্রধানত চার প্রকার কোয়ান্টাম কম্পিউটার দেখা যায় –
১. কোয়ান্টাম গেট অ্যারে (Quantum gate array)
২. ওয়ান-ওয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার (One-way Quantum Computer)
৩. অ্যাডিয়াবেটিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Adiabetic Quantum Computer)
৪. টোপোলজিকাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Topological Quantum Computer)
এগুলির প্রতিটির কাজের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন এবং কোয়ান্টাম গণনার পদ্ধতিও ভিন্ন। এছাড়াও সুপারকণ্ডাকটিং কোয়ান্টাম কম্পিউটার, ট্র্যাপড আয়ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তবে এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহারের কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হল কোয়ান্টাম ডি-কোহারেন্স (decoherence)। অর্থাৎ কোয়ান্টাম কম্পিউটারে মূলত পরমাণুর চলনের দ্বারা গণনা সম্পন্ন হয়। এখন যে পরিবেশে কম্পিউটার রয়েছে তাতে যদি কোনো বিচ্যুতি ঘটে, কোনো পরমাণুর চলন বা গতি বেড়ে যায়, কোনো কম্পন তৈরি হয় তাহলে গণনা ভুল হতে পারে বা কোয়ান্টাম কম্পিউটার কাজ নাও করতে পারে। এখনও পর্যন্ত গ্রোভারস অ্যালগোরিদম্ এবং শ্যর অ্যালগোরিদম্ ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কাজ সম্পন্ন হয়। তবে এর যে কয়টি সুবিধের কথা আগে বলা হল, তাছাড়াও এই কম্পিউটার অনেক বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী কারণ এতে কোয়ান্টাম টানেলিং পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে কয়েকশো গুণ কম বিদ্যুৎ খরচ হয়। কোয়ান্টান কম্পিউটারের মাধ্যমে জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহার করা সহজ হবে যেমন এই পদ্ধতিতে যে কোনো বিমানবন্দরের বিমান উড়ানের তালিকা নির্ণয় করা যাবে খুব সহজে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ধারণা প্রাথমিকভাবে অযৌক্তিক মনে হলেও প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির ফলে ভবিষ্যতে এই কম্পিউটারই আসতে চলেছে আমাদের সভ্যতায়।
One comment