এনরিকো ফার্মি

এনরিকো ফার্মি

বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টররের আবিষ্কারক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন ইতালির পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি (Enrico Fermi)। কণা পদার্থবিদ্যা কিংবা কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর মূলত গবেষণা করেছেন তিনি। ১৯৩৮ সালে পারমাণবিক কণা এবং তেজষ্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার ফলে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য পদার্থবিদ্‌দের মধ্যে একইসঙ্গে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা এবং ফলিত পদার্থবিদ্যায় ব্যুৎপত্তির কারণে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের জগতে বিজ্ঞানী ফার্মি আদর্শ গ্যাসের উপযোগী ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান নির্মাণ করেন। যে কণাগুলি এই নীতি মেনে চলে তাদের ‘ফার্মিয়ন’ নামে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্যাসিস্ট ইতালি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান ফার্মি এবং সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রকল্পের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি।

১৯০১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইতালির রোমে এনরিকো ফার্মির জন্ম হয়। তাঁর বাবা অ্যালবার্তো ফার্মি ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য অধিকর্তা এবং তাঁর মা ইডা দে গাটিস পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ফার্মির এক বোন মারিয়া এবং এক ভাই ছিল গ্যুলিও নামে। অ্যালবার্তো এবং ইডার তৃতীয় সন্তান ছিলেন এনরিক ফার্মি। তাঁর পরিবার আদতে ধার্মিক না হলেও ঠাকুরদাদার পরামর্শে এনরিকোকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। কিন্তু বড়ো হয়ে এনরিকো প্রবল নাস্তিক্যবাদী হয়ে ওঠেন। এনরিকোর যখন ১৪ বছর বয়স, তাঁর ভাই গ্যুলিও হঠাৎই মারা যান। এই সময় বিধ্বস্ত মনে ফার্মিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাঁর বাবা-মা তাঁকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলেন। ঠিক এই সময়েই বেশ কিছু পদার্থবিদ্যার বইয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এই সব বইগুলি অর্ধশতাব্দী আগে লেখা হয়েছিল এবং এইসব বই পড়ে ফার্মি অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর কিশোর বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে রোমের জল সরবরাহ ব্যবস্থার ঘনত্ব পরিমাপ করার পরীক্ষা করেছিলেন এনরিকো ফার্মি। পরবর্তীকালে লরা ক্যাপবেনের সঙ্গে বিবাহ হয় এনরিকো ফার্মির।

স্থানীয় গ্রামার স্কুলে এনরিকো ফার্মির প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ছোটোবেলা থেকেই গণিত এবং পদার্থবিদ্যায় ব্যুৎপত্তির কারণে তাঁর বাবার বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যে এ.আমিডি এনরিকো ফার্মিকে যথেষ্ট উৎসাহ দিতে শুরু করেন। ১৯১৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে পিসার স্কোউলা নর্ম্যালে সুপিরিয়রে বৃত্তি অর্জন করেন তিনি। এই বৃত্তি নিয়ে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ফার্মি এবং দীর্ঘ চার বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। প্রবেশিকা পরীক্ষার সময় তাঁর লেখা প্রবন্ধ পড়ে এখানকার অধ্যাপকেরা এতই মুগ্ধ হন যে সরাসরি তাঁকে ডক্টরেট ক্লাসে উত্তীর্ণ করেন। ইতিমধ্যে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পুচিয়ান্তির অধীনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। ১৯২২ সালে পিসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এনরিকো ফার্মি। ১৯২৩ সালে তিনি রকফেলার বৃত্তি পান এবং জার্মানির গটিঞ্জেনে বিখ্যাত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ম্যাক্স বর্নের সঙ্গে বেশ কয়েক মাস যাবৎ কাজ করেন এনরিকো ফার্মি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতে ম্যাক্স বর্ন এক পথিকৃৎ বিজ্ঞানী। এনরিকো ফার্মির গবেষণার সময়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার চর্চা শুরু হয়েছে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বও প্রকাশ পেয়েছে। হাইজেনবার্গ আর শ্রোডিঙ্গারের মতো ম্যাক্স বর্নও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার চর্চা শুরু করেছিলেন যার প্রভাব পড়েছিল ফার্মির উপরেও। ১৯২৪ সালে পি. এরেনফাস্টের সঙ্গে কাজ করার জন্য লেডেনে চলে যান তিনি।

১৯২৪ সালেই ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এনরিকো ফার্মি। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ফার্মি। ১৯২৬ সালে ফার্মি পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলা কণাগুলির উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে কিছু পরিসংখ্যানগত নীতি ও সূত্র আবিষ্কার করেন যা পরে ‘ফার্মি পরিসংখ্যান’ নামে পরিচিত হয়। যে কণাগুলি এই নীতি মেনে চলে তাদেরকে ফার্মির নামে নাম দেওয়া হয় ‘ফার্মিয়ন’। তাঁর অনেক আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই বিষয়ে গবেষণা করে বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আর তখন সেইসব কণাগুলির নাম ছিল ‘বোসন’। ফার্মির এই গবেষণায় সাহায্য করেছিলেন বিজ্ঞানী পল ডিরাক। উভয়ে মিলে যে পরিসংখ্যান নীতি আবিষ্কৃত হয়, সেই নীতিটি পরে ‘ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান’ নামে পরিচিত হয়। এই মহাবিশ্বে শক্তির কণাগুলিকে বলে বোসন কণা আর পদার্থের কণাকে বলা হয় ফার্মিওন। ১৯২৭ সালে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হন ফার্মি এবং ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা করেছেন। এখানে অধ্যাপনা করার সময়ে তড়িৎ-চৌম্বক তত্ত্ব, বর্ণালীমিতি বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ফার্মি ১৯৩৪ সালে ইলেক্ট্রন ছাড়া পরমাণুর নিউক্লিয়াস পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এনরিকো ফার্মি গবেষণার মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের বিটা-ক্ষয় থেকে নিউট্রিনো কণার নির্গমনের ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন এবং তিনি এর সঙ্গে এও বলেন যে চারটি ফার্মিওন কণা একত্রে পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। একে ফার্মির বিটা-ক্ষয় তত্ত্ব বলা হয়। পরমাণুর নিউট্রন ভেঙে প্রোটনের পাশাপাশি নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনো কণা নির্গমণের ঘটনা প্রথম তিনিই আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে ফার্মির এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানী হান ও স্ট্রাসমান নিউক্লীয় বিভাজন প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন যা থেকে নিউট্রন বোমা তথা পরমাণু বোমা তৈরি করার প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া ফার্মির এই আবিষ্কার কিছুদিনের মধ্যেই স্লো-নিউট্রন কণার অস্তিত্বকে প্রকাশ্যে আনে। এই স্লো-নিউট্রন আসলে ধীরগতির নিউট্রন।

১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে এনরিকো ফার্মি যোগ দেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউক্লীয় বিভাজন বিক্রিয়া বিষয়ে গভীর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ফার্মি বুঝতে পারেন যে, পরমাণুর নিউক্লিয়াস কোনো দ্রুতগতিসম্পন্ন নিউট্রন কণার আঘাতে প্রচুর শক্তি নির্গত করে যার কিছু অংশ পরে গামা-রশ্মিতে পরিণত হয় এবং বাকি শক্তির সঙ্গে আরো কিছু নিউট্রন কণা বেরিয়ে আসে। এই নিউট্রঙ্গুলি পুনরায় পরমাণুকে আঘাত করে আর এভাবেই এই প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে শৃঙ্খলের মতো চলতেই থাকে। ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো স্টেডিয়ামের নীচে স্কোয়াশ কোর্টে প্রথম এনরিকো ফার্মি নিয়ন্ত্রিত নিউক্লীয় বিভাজন প্রক্রিয়ার প্রায়োগিক প্রদর্শনী করে দেখান। এই নিউক্লীয় বিভাজন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি নিউক্লীয়-বিভাজক বা নিউক্লীয় রি-অ্যাক্টরের। ফার্মিই প্রথম বিশ্বের ইতিহাসে এই নিউক্লীয় রি-অ্যাক্টর তৈরি করেন যার নাম ছিল ‘শিকাগো পাইল-১’। এই কাজের সাফল্যের পরে ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করে বিখ্যাত ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্ট’-এ কাজ করতে শুরু করেন ফার্মি। এই ম্যানহাটন প্রজেক্টের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে আমেরিকা পরমাণু বোমা তৈরি করেছিল। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই জনার্দা দেল মুয়ের্তো মরু অঞ্চলে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করে এর পরীক্ষা করা হয় যাকে ইতিহাসে ‘ট্রিনিটি টেস্ট’ বলা হয়। পরীক্ষায় সফল হওয়ার পরেই আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট তারিখে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে ক্রমান্বয়ে দুটি পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্সটিটিউট ফর নিউক্লিয়ার স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এনরিকো ফার্মি। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই সংস্থায় অধ্যাপনা করেন।

মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেশণার ফলে পাই-মেসন এবং মিউওন কণার উৎপত্তি ও প্রকৃতি বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেন তিনি। মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে যে বিপুল শক্তি সঞ্চিত থাকে তাও গবেষণার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেন ফার্মি। তিনিই প্রথম একটি অত্যাশ্চর্য বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এই প্রশ্নে তিনি বলেন যে, একটিমাত্র ছায়াপথে এতগুলো নক্ষত্র আর সেই অসংখ্য নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরে চলা একটিমাত্র গ্রহতেই এত প্রাণী রয়েছে, তাহলে সমগ্র মহাবিশ্বে এরকম আরো কত ছায়াপথ, আরো কত গ্রহে কতশত প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেসব ধরা পড়ে না কেন এই প্রশ্নের উত্তর গাণিতিকভাবে প্রমাণ করার কাজ শুরু করেন বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট। তাই এই প্রশ্নকে বলা হয় ‘ফার্মি-হার্ট প্যারাডক্স’।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও বহু সময় পদার্থবিদ্যার বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। নিউট্রন কণার আঘাতে নিউক্লীয় বিক্রিয়ার সূত্রপাত ও তেজস্ক্রিয়তা তৈরির ঘটনা আবিষ্কার ও তার যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। এছাড়াও হিউ পদক, ফ্র্যাঙ্কলিন পদক, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক পদক লাভ করেছেন তিনি।

২০০৮ সালে গামা-রে লার্জ এরিয়ে স্পেস টেলিস্কোপের না বদলে এনরিকো ফার্মির স্মরণে এই টেলিস্কোপের নাম বদলে রাখা হয় ফার্মি গামা-রে স্পেস টেলিস্কোপ রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাঁর স্বীকৃতিতে অ্যাক্টিনাইট পর্যায়ের একটি কৃত্রিম মৌলের নাম ফার্মিয়াম রাখে।

১৯৫৪ সালের ২৮ নভেম্বর পাকস্থলীর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এনরিকো ফার্মির মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান