ঘূর্ণিঝড়ে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা হয় কিভাবে?

ঘূর্ণিঝড়ে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা হয় কিভাবে?

হারিকেন বা টাইফুন বা যেকোনো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক পরেই বিপর্যয় মোকাবিলার পাশাপাশি তার থেকে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করাও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আবহাওয়া দপ্তরের তরফে।  ঘুর্ণিঝড়ের পরে সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদ সংক্রান্ত ক্ষতির পর্যালোচনা করার জন্যই সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করা হয়ে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য, আকার, স্থান এরকম বেশ কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা হয়। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে ঘুর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করার জন্য কিছু মাপকাঠি অনুসরণ করা হয় যার মধ্যে প্রধান দুটি হল, ‘হারিকেন সিভিয়ারিটি ইন্ডেক্স’ (Hurricane Severity Index, HSI) ও সাফির-সিম্পসন হারিকেন উইন্ড স্কেল (Saffir-Simpson Hurricane Wind Scale)।

HSI এর মাধ্যমে কোন ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি এবং তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে পরিমাপ করা হয়। হাওয়ার প্রাবল্য এবং এই হাওয়া যে এলাকা জুড়ে প্রবাহিত হতে থাকে- এই দুটি ফ্যাক্টরকে মাথায় রেখে HSI-এর মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য পরিমাপ করা হয়ে থাকে। HSI-এর মাধ্যমে মূলত যেটা দেখাতে চাওয়া হয় সেটা হল- সমপ্রাবল্যের দুটি আলাদা ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসের ক্ষমতা আলাদা হতে পারে যদি তাদের আকার আলাদা হয়। আবার কম প্রাবল্যের বিশাল জায়গা জুড়ে হওয়া কোনো ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা, ছোটো জায়গা জুড়ে হওয়া বিশাল প্রাবল্যের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে বেশি মারাত্মক হতে পারে।

অর্থাৎ, এই চিন্তাধারা থেকেই HSI এর কাজ করে যে, ঘূর্ণিঝড়ের আকার হাওয়ার প্রাবল্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ৫০ নম্বরের একটি স্কেল থাকে, যা ২৫ নম্বরের দুটি বিভাগে বিভক্ত থাকে। প্রথম বিভাগে ১ থেকে ২৫ নম্বর থাকে ঘূর্ণিঝড়ের বায়ুক্ষেত্রের জন্য। অর্থাৎ, হাওয়া কতখানি এলাকা জুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে তা এই নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষা করা হয়।

আর দ্বিতীয় বিভাগের ১ থেকে ২৫ নম্বর ভাগ করা থাকে তা হল হাওয়ার প্রাবল্য মাপার জন্য। হাওয়ার গতি এবং কোনো বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বলের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে এখানে নম্বরগুলি নির্দিষ্ট করা হয়।

সাফির-সিম্পসন হারিকেন উইন্ড স্কেল ১৯৭৩ সালে জনমানসে পরিচিতি পেতে শুরু করে। এই স্কেলের দ্বারা হাওয়ার গতির মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়কে কিছু বিভাগে ভাগ করে নেওয়া হয় এবং সেই বিভাগ অনুযায়ী সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করা হয়ে থাকে। এই স্কেলটি ৭৪ মাইল প্রতি ঘন্টা বা তার বেশি গতিবেগের হাওয়াকেই পরিমাপ করে। হাওয়ার গতিবেগ তার চেয়ে কম হলে এটি কাজ করেনা। হাওয়ার প্রভাব কতক্ষণ চলবে তা HSI নির্ধারণ করতে পারলেও সাফির-সিম্পসন স্কেলের এই ক্ষমতাটি থাকেনা।

বায়ুক্ষেত্রের এই আকার শুধু স্থলভাগে নয়, জলভাগেও প্রভাব ফেলতে পারে। সাফির-সিম্পসন হারিকেন উইন্ড স্কেল এই বিষয়টি নির্ধারণ করতেও অপারগ।

তবে, সাফির-সিম্পসন হারিকেন উইন্ড স্কেল হাওয়ার গতিবেগের ওপর ভিত্তি কর ঘূর্ণিঝড়কে পাঁচটি বিভাগে ভাগ করে। এই বিভাগগুলিতে আগে থেকেই নির্দিষ্ট হিসাবের ভিত্তিতে কেমন কি ক্ষতি হতে পারে তা পরিমাপ করে রাখা হয়।

প্রথম বিভাগটিতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ৭৪ থেকে ৯৫ মাইল প্রতি ঘন্টা বা ১১৯ থেকে ১৫৩ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই ধরণের ঘূর্ণিঝড়ে পাকাবাড়ির ক্ষতি হতে পারে, গাছের বড় ডালপালা ভেঙে পড়তে পারে, অগভীর মূলের গাছ উপড়ে যেতে পারে। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে কয়েকদিন বিদ্যুৎ নাও থাকতে পারে।

দ্বিতীয় বিভাগটিতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ৯৬ থেকে ১১০ মাইল প্রতি ঘন্টা বা ১৫৪ থেকে ১৭৭ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই ধরণের ঘূর্ণিঝড়ের ফলে গাছ ও পাকাবাড়ির বিশেষ ক্ষতির সঙ্গে অতিরিক্ত যা হতে পারে তা হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকতে পারে।

তৃতীয় বিভাগে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ১১১ থেকে ১২৯ মাইল প্রতি ঘন্টা বা ১৭৮ থেকে ২০৮ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই ধরণের ঘূর্ণিঝড়ে পাকাবাড়ির চাল উপড়ে যেতে পারে, গাছ উপড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ থাকতে পারে। বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে জল সরবরাহও বন্ধ থাকতে পারে।

চতুর্থ বিভাগে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ১৩০ থেকে ১৫৬ মাইল প্রতি ঘন্টা বা ২০৯ থেকে ২৫১ কিমি প্রতি ঘন্টা। ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব যদি এরকম হয় তবে পাকাবাড়ির প্রভূত ক্ষতি হতে পারে, সঙ্গে বাইরের দিকের দেওয়াল পড়ে যেতে পারে, গাছ পড়ে সপ্তাহ বা মাসখানেকের জন্য বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ হয়ে গোটা এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এক কথায় এলাকাটি থাকার অযোগ্য হয়ে যেতে পারে।

পঞ্চম এবং শেষ বিভাগে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ১৫৭ মাইল প্রতি ঘন্টা বা তার বেশি অথবা ২৫২ কিমি প্রতি ঘন্টা বা তার থেকে বেশি। এই রকম ঘূর্ণিঝড়ে একটি বড় অংশের পাকা বাড়ি ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। সপ্তাহ বা মাসখানেকের জন্যও এলাকাটি বসসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম বিভাগগুলিকে প্রধান (Major) বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেহেতু এই বিভাগগুলিতে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে।

মূলত ভারতের বাইরের দেশের ঘূর্ণিঝড়ের কথা মাথায় রেখে এই দুটি মাপকাঠিতে ঘূর্ণিঝড় -এর শ্রেণিবিভাগ করে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাপ করা হয়। এছাড়াও ভারতীয় জলবায়ু এবং ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সরকারি নির্দেশিকায় ঘূর্ণিঝড় -এর কিছু বিভাগের উল্লেখ রয়েছে, যার ভিত্তিতে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য পরিমাপ করা যেতে পারে।  

প্রথম বিভাগটির নাম দেওয়া হয়েছে নিম্নচাপ (Depression)। এতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ৩১ কিমি প্রতি ঘন্টার চেয়ে কম।

দ্বিতীয় বিভাগটির নাম গভীর নিম্নচাপ (Deep Depression)। এতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ৫০ থেকে ৬১ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই প্রথম দুটি বিভাগে খোলা এবং অসুরক্ষিত কাঠামোতে সামান্য ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

তৃতীয় বিভাগটির নাম ঘূর্ণিঝড় (Cyclonic Storm) যাতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ৬২ থেকে ৮৭ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই ধরণের ঘূর্ণিঝড়ে খড়ের নীচু কুঁড়েঘরের ক্ষতি হয়, গাছের ডাল ভেঙে বিদ্যুৎ যোগাযোগের সামান্য ক্ষতি হতে পারে।

চতুর্থ বিভাগটির নাম দেওয়া হয়েছে তীব্র ঘূর্ণিঝড় (Severe Cyclonic Storm). এই বিভাগে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ৮৮ থেকে ১১৭ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই ধরণের ঘুর্ণিঝড়ে খড়ের চাল এবং কুঁড়েঘরের  বিশেষ ক্ষতি হয়। গাছ উপড়ে বিদ্যুতের খুঁটি এবং যোগাযোগ মাধ্যমের সামান্য ক্ষতি হয়। কিছু এলাকায় বন্যা হয়।

পঞ্চম বিভাগটির নাম অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় (Very Severe Cyclonic Storm) যাতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ১১৮ থেকে ১৬৬ কিমি প্রতি ঘন্টা। এই ধরণের ঘূর্ণিঝড়ে মূলত কাঁচাবাড়ির প্রভূত ক্ষতি হয়। বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ মাধ্যমের আংশিক ক্ষতি হয়। বন্যার কারণে রেল এবং  সড়কপথের ক্ষতি হয়। উড়ন্ত ধুলোবালি থেকে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যা হয়।

ষষ্ঠ বিভাগটি হল, অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড় (Extremely Severe Cyclonic Storm) যাতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ১৬৭ থেকে ২২১ কিমি প্রতি ঘন্টা। ঘূর্ণিঘড়ের প্রাবল্য এরকম হলে কাঁচা বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো বাড়িরও অনেক ক্ষতি হয়। বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়। ধুলোবালি থেকে সমস্যা এবং দীর্ঘ বন্যার ফলে রেল এবং সড়কপথের ক্ষতি হয়।

সপ্তম বিভাগটির নাম হলো সুপার সাইক্লোন (Super Cyclone) যাতে হাওয়ার গতিবেগ থাকে ২২২ কিমি প্রতি ঘন্টা বা তার থেকে বেশি। এই ধরণের ঘূর্ণিঝড়ে আবাসন এবং কলকারখানা বা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। রেল এবং সড়কপথের প্রভুত ক্ষতি হওয়ায় ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যা বিশালাকার ধারণ করে এবং সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠে বড় দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। বাতাসে ধুলোবালি মিশে চরম দূষণের সৃষ্টি করে। এককথায় বসসবাসের অযোগ্য পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায়।

আপনার মতামত জানান