জোনাকির আলো

জোনাকির আলো জ্বলে কীভাবে

রাত নামলে, বিশেষ করে গ্রামের দিকে, নক্ষত্রের মত আলো জ্বেলে উড়ে বেড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি। সেই দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে যায় অনেকেই, কবি মনে রোমান্টিকতার জন্ম দেয় আর বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মনে প্রশ্ন জাগে জোনাকির আলো জ্বলে কীভাবে? আমরা এখানে সেই বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মনের পিপাসা মেটানোর চেষ্টা করব।

মানুষের সঙ্গে জোনাকির সম্পর্ক বহু দিনের। শুধু নান্দনিক সৌন্দর্য নয়, প্রাচীন কালে গোবরে জোনাকি আটকে দেওয়ালে লাগিয়ে রাখার প্রথাও ছিল, এমনকি জোনাকি ধরে কয়লার খনি আলো করাও হত। যেখানে বেশির ভাগ প্রাণীর দেহে আলো জ্বলে না সেখানে জোনাকির আলো জ্বলা নিঃসন্দেহে ভাববার বিষয়। তবে জোনাকি ছাড়াও অনেক আরও কিছু জীব কিন্ত এই আলো উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। এই প্রক্রিয়াটিকে “বায়োলুমিনিসেন্স” (bioluminesence) বলা হয়।

বিভিন্ন গভীর সামুদ্রিক মাছ যেমন বেরিসিফর্মিজ (Beryciformes), গ্যাডিফরমিজ (Gadiformes), জেলি ফিশ, বিভিন্ন শৈবাল যেমন ডাইনোফ্লাগেলেট (dinoflagellate), কিছু মাশরুম যেমন মাইসিনা (Mycena) ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়, যারা বায়োলুমিনিসেন্স দেখাতে পারে। সাধারনত এই আলোর মাধ্যমে তারা সঙ্গী নির্বাচন, আত্মরক্ষা, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, মিথোজীবিত্ব ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করে থাকে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে প্রাণের আগমনের সাথে সাথেই এই বায়োলুমিনিসেন্স প্রক্রিয়ার শুরু বলে ধরা হয়। কোন সময় অক্সিজেন (oxygen) এর মাত্রা বেশি থাকার কারণে কিছু মলিকিউলস সৃষ্টি হয়, যা বিক্রিয়া করে কোষের বিভিন্ন ক্ষতি রোধ করতে পারত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে জলের গভীরে বা অন্য স্থানে এই অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ার কারণে এই যৌগগুলির আর দরকার থাকে না এবং সেগুলি ভেঙ্গে গিয়ে আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

রবার্ট বয়েল (Robert Boyle) এবং চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) এর মতো বিজ্ঞানীরা এই বায়োলুমিনিসেন্স এর কারন সন্ধানে নিজেদের অবদান রেখেছেন। রাফায়েল দুবইস (Raphael Dubois) নামে এক ফরাসী গবেষক প্রথম এই মলিকিউল আবিষ্কার করেন, যেটি জারিত (oxydise) হয়ে  আলো উৎপাদন করে এবং তার নাম দেন লুসিফেরিন। অসামু সিমোমুরা (Osamu Simomura) নামে এক জাপানি গবেষক ২০০৮ সালে নোবেল পান লুসিফেরিন (luciferin) ও লুসিফারেস (luciferase) এর যৌগিক গঠন আবিস্কার করার জন্য, যা এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। এখন বিভিন্ন রকম জীবন বিজ্ঞানের গবেষণায়ে এর ব্যবহার কৃত্রিমভাবে করা হয়। এই আলো স্বভাবত নীলাভ হলেও এখন সবুজাভ, রক্তিম ইত্যাদি রঙে পাওয়া যায়।

২০০০ এরও বেশি জোনাকির (গুবরে পোকা জাতীয়) প্রজাতি আছে যার মধ্যে কয়েকটিই মাত্র আলো দেয়। এরকমই একটি প্রজাতি হল ফটিনাস পাইরালিস, যেটি এই আলো উৎপাদনের ক্ষমতা দিয়ে সঙ্গী নির্বাচন ও বংশ বৃদ্ধি করে থাকে। ক্যালসিয়াম ও এডিনসিন ট্রাই-ফসফেট (ATP) এর উপস্থিতিতে লুসিফারেস উৎসেচকের সাহায্যে লুসিফেরিন ভেঙ্গে এই আলোর সৃষ্টি হয় যা মূলত দৃষ্টিগোচর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ফোটন সমুহ। আর একটি চমকপ্রদ ঘটনা হল এই যে, বায়োলুমিনিসেন্স প্রক্রিয়ায় কোনরকম শক্তি ক্ষয় হয় না যা জগতের প্রায় যেকোন রাসায়নিক বিক্রিয়াতেই বিরল।

পরিশেষে এই বলার যে নগরায়ন ও আলোক দূষণের জন্য জোনাকিদের বিস্তার সঙ্কটের মুখে। বেশ কিছু প্রজাতির জোনাকি বিলুপ্তির পথে এবং এই ভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমরা জোনাকির আলো জ্বলা রাতের সৌন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হবো।

আপনার মতামত জানান