ডাবের ভিতর জল জমে কীভাবে

ডাবের ভিতর জল জমে কীভাবে

গরমের দাবদাহে রাস্তায় বেরিয়ে অথবা কাজে-কর্মে হাঁফিয়ে উঠলে ডাবের জল খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তারেরা, তাতে শরীরে খনিজ মৌলের মাত্রা ঠিক থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকেই আমরা নানা সময় ডাবের জল খেয়ে থাকি। প্রচণ্ড গরমে শরীরকে শীতল করে, শক্তি ও কর্মোদ্যম ফিরিয়ে আনতে ডাবের জলের জুড়ি মেলা ভার। এই ডাবই বহুদিন গাছে থাকলে নারকেলে পরিণত হয়, তখন আবার তার ভিতরে সাদা শাঁস হয়ে যায়। তবু তখনও তার ভিতরে জল থাকে। ডাবের খোলা অত্যন্ত পুরু ও কঠিন, নারকেল হয়ে গেলে তার কাঠিন্য আরও বাড়ে। তাহলে প্রশ্ন হল ডাবের ভিতর জল আসে কোথা থেকে? আর কোনও ফলের মধ্যে তো এত জল থাকে না। প্রকৃতিতে অনেক ধরনের রসালো ফল পাওয়া যায়, যাদের শাঁসের মধ্যেই অনেক পরিমাণ জল থাকে। কিন্তু তা ডাবের মত নয়। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক, ডাবের ভিতর জল জমে কীভাবে (How water gets inside of the coconut)।

ডাবের জল এমন এক প্রাকৃতিক তরল উপাদান যাতে প্রচুর পরিমাণে আয়নীয় যৌগ (Electrolyte), ভিটামিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, আয়রন, প্রোটিন এবং আরও অন্যান্য খনিজ মৌল রয়েছে। তবে এর মধ্যে কোনও রকম ফ্যাটজাতীয় উপাদান থাকে না। ডাব যত কচি থাকে, তত তার মধ্যে এই স্বচ্ছ তরলের পরিমাণ বেশি থাকে। কিন্তু ডাব থেকে নারকেলে রূপান্তরিত হওয়ার সময় সেই জলের পরিমাণ কমে গিয়ে সাদা পুরু শাঁসে পরিণত হয়। সাধারণভাবে দেখা যায় যে নারকেল গাছগুলির শিকড় অনেক দীর্ঘ হয় এবং সেই শিকড়ের সাহায্যে প্রচুর পরিমাণে জল শোষণ করে নেয় গাছটি। এক্ষেত্রে গাছের কোষের মধ্যে থাকা জাইলেম কলা গাছের কাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়, এগুলোই কৈশিকী নল হিসেবে কাজ করে। ফলে জলের পৃষ্ঠটানের (Surface Tension) কারণে সরু জাইলেমের মধ্য দিয়ে মাটির ভৌম জল চলে যায় সোজা উপরের দিকে। কিন্তু এই শোষিত জল প্রথমে লবণাক্ত (Saline) থাকে। যেইমাত্র গাছের সর্বত্র এই জল গিয়ে পৌঁছায়, জল ক্রমে পরিশ্রুত হয়ে মিষ্টি স্বাদু জলে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে এভাবেই ডাবের ভিতরে জল সঞ্চিত হয় যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘এন্ডোস্পার্ম’ (Endosperm) বলা হয় যা ভ্রূণের (embryo) পুষ্টির জন্য কাজে লাগে। একেবারে প্রাথমিক দশায় নারকেল গাছের মূলতন্ত্র জল শোষণ করতে পারে যা কৈশিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে (Capillary Reaction) অভিকর্ষের বিরুদ্ধে উপরের দিকে উঠে গাছের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই তরল সেই উপাদানটি কলায় (Tissue) রূপান্তরিত হতে শুরু করে। সেটাই নারকেলের মধ্যে সঞ্চিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে সেই কোমল কলাটি অনেক কঠিন ও পুরু হয়ে যায় যার ফলে জলের পরিমাণ অনেক কমে যায়। নারকেল গাছের শিকড় অভিস্রবণ প্রক্রিয়ার দ্বারা মাটি থেকে জল শোষণ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় আংশিক-ভেদ্য পর্দার উপস্থিতিতে ঘনীভূত দ্রবণ থেকে লঘু দ্রবণে জলের অপসারণ পদ্ধতিকে বলা হয় অভিস্রবণ (Osmosis)। নারকেলের ভিতরে এভাবে যে এন্ডোস্পার্ম সঞ্চিত হয় তা নারকেলের পুষ্টির উৎস। যে কোনও ফলের মধ্যে এই এন্ডোস্পার্ম থাকে গ্লুকোজ (Glucose) বা স্টার্চের (Starch) রূপে। তবে অন্যান্য ফলের সস্য (endosperm) কঠিন বা রসালো হয়, কিন্তু একমাত্র ডাবের ক্ষেত্রেই তরল সস্য দেখা যায়। এই এন্ডোস্পার্মেরই কিছু অংশ কঠিন হয়ে যায় আর বাকি অংশটি তরলের আকারে জমা থাকে।

ডাবের জলের ১০০ মিলিলিটার পরিমাণে ১৯ কিলো ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ জল, ৪ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট আর বাকি অংশ প্রোটিন থাকে। তবে নারকেলের জলের সঙ্গে নারকেলের দুধকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ডাবের সস্য অংশ থেকেই জল পাওয়া যায়, কিন্তু অন্যদিকে নারকেলের পুরু শাঁস থেকে নারকেলের দুধ পাওয়া যায়। ডাবের জলের থেকে নারকেলের দুধে অনেক বেশি পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাট থাকে। প্রচুর পটাশিয়াম থাকায় আমাদের শরীরে তরলের ঘাটতি কমাতে এবং রক্ত সঞ্চালন, দুর্বলতা, বিপাকীয় ক্রিয়া ঠিক করতে ডাবের জলের বিকল্প কিছু নেই। তবে অতিরিক্ত ডাবের জল খেলে আবার অধিক মাত্রায় পটাশিয়ামের উপস্থিতির কারণে হাইপারক্লেমিয়া রোগ (Hyperklamea) দেখা দিতে পারে এবং মনোযোগের অভাব, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। বর্তমানে বহু ক্রীড়া সংস্থা এবং ক্রীড়াবিশারদ খেলোয়াড়দের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ডাবের জলের গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করছে। তবু ডাবের ভিতর জলের উপস্থিতি আজও মানুষের কাছে প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়।  

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আপনার মতামত জানান