জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার

জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার

ভারতের একজন খ্যাতনামা জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার (Jayant Vishnu Narlikar) ‘কনফর্মাল গ্র্যাভিটি তত্ত্ব’-এর প্রবক্তা। বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েলের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি এই তত্ত্ব প্রবর্তন করে ভারতসহ বিশ্বের বিজ্ঞানজগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এমনকি বহুচর্চিত ‘বিগ ব্যাং তত্ত্ব’কে প্রমাণ সাপেক্ষে অস্বীকার করেছিলেন বিজ্ঞানী নারলিকার। তবে শুধুই বিজ্ঞানচর্চা নয়, বিভিন্ন বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ ও পাঠ্যপুস্তক, হিন্দি ও মারাঠি ভাষায় অনেক কল্পবিজ্ঞানের গল্প, উপন্যাস এবং নানাসময় বিজ্ঞানের তথ্যভিত্তিক রচনা লিখে বিজ্ঞাননির্ভর সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ স্থান অর্জন করেছেন তিনি। একটা সময় তিনি ভারতীয় টেলিভিশনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং সেখানে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, মহাকাশবিজ্ঞান সংক্রান্ত ধারণা তুলে ধরে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নেন বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার।

১৯৩৮ সালের ১৯ জুলাই মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকার ছিলেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাতে গভীর জ্ঞানচর্চা করেছেন তিনি। তাঁর মা সুমতি নারলিকার ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ ভি. এস. হুজুরবাজার ছিলেন সম্পর্কে জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের মামা। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ার পরিবেশে বড় হওয়ার জন্য নারলিকারের মনে পড়াশোনার প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগ দেখা দেয়। বিজ্ঞান ও গণিতের প্রতি জন্ম নেয় ভালোবাসা। অনেক ছোট থেকেই তিনি জটিল থেকে জটিলতর বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতেন। তাঁর এই কাজে পারিবারিক ভাবেও তিনি অনেক উৎসাহ পেয়েছেন।

জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের বিদ্যালয়-শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজে (অধুনা সেন্ট্রাল হিন্দু বয়েজ স্কুল)। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই স্কুল ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন নারলিকার এবং উচ্চশিক্ষার জন্য তারপর তিনি পাড়ি দেন সুদূর ব্রিটেনে। বাবার মতোই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ফিৎজ্উইলিয়াম কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার এবং ১৯৫৯ সালে তিনি এই কলেজ থেকে ম্যাথমেটিক্স ট্রাইপোজে ‘সিনিয়র র‍্যাঙ্গলার’ (Senior Wranglar) পদক অর্জন করেন যা তৎকালীন সময়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধিক কৃতিত্ব’ হিসেবে স্বীকৃত হতো। এছাড়াও ১৯৬২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি স্মিথস্‌ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েলের তত্ত্বাবধানে নারলিকার ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরে তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজের কিংস কলেজে ‘বেরি র‍্যামসে ফেলো’ (Berry Ramsey Fellow) হিসেবে যুক্ত থাকেন এবং ১৯৬৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল কেমব্রিজে ‘ইনস্টিটিউট অফ থিয়োরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি’ স্থাপন করলে নারলিকার সেখানে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (founder stuff) পদে যোগ দেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এরপর নারলিকার ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯৭২ সালে মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ (TIFR)-এ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ‘বম্বে টিভি’তে একটি মারাঠি ধারাবাহিক ‘আকাশাশী জডলে নাতে’ প্রদর্শনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। আলোচনা এবং বিভিন্ন দৃশ্যপটের সাহায্যে এই ধারাবাহিক জ্যোতির্বিদ্যার অনেক অজানা দিককে তুলে ধরেছিল। সাধারণ দর্শকের কল্পনার চিত্র ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সফল ধারাবাহিকটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯৮১ সালে তিনি ‘ওয়ার্ল্ড কালচারাল কাউন্সিল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে ‘ইণ্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন’ (IUGC) পুনেতে ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাণ্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ (IUCAA) প্রতিষ্ঠা করলে নারলিকার প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা বা ডিরেক্টর হিসেবে আমন্ত্রিত হন। ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের সময় পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন।

আশির দশকে নারলিকার কার্ল সাগান পরিচালিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘দ্য কসমস’-এ প্রদর্শনা শুরুর আগে হিন্দিতে প্রতি পর্বের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করতেন। নিজস্ব ভাষায় বিষয়বস্তু জানতে পেরে সাধারণ ভারতীয় নাগরিক এই  অনুষ্ঠানটিকে খুবই পছন্দ করেছিল। এই ধারাবাহিকের সাফল্যের সূত্র ধরে নারলিকার ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, ভারতীয় টেলিভিশনে হিন্দি ভাষায় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো ধারাবাহিক সম্প্রচারিত হওয়া উচিত। তাঁর এই প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয়। নারলিকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারাবাহিকটি তৈরির ভার নেয় ভারতের চলচ্চিত্র বিভাগ। সর্বমোট ১৭টি পর্বে এই ধারাবাহিক নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ এই সময়কালের মধ্যে ভারতীয় টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়েছিল। ‘ব্রহ্মাণ্ড’ নামের এই ধারাবাহিকটি বিভিন্ন আকর্ষণীয় ছবি ও বর্ণনার সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক অভিনব আবিষ্কারের কথা তুলে ধরেছিল। এতে অংশগ্রহণ করেছিল অনেক স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। ফলে তরুণ প্রজন্মের দর্শকেরা এই ধারাবাহিকটিকে অত্যন্ত পছন্দ করেছিল।

নারলিকার তাঁর সৃষ্টিতত্ত্ব (cosmology) বিষয়ে কাজের জন্য, বিশেষত ‘বিগ ব্যাং তত্ত্ব’ সম্পর্কে বিভিন্ন মডেলের জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। তিনি বিগ ব্যাং তত্ত্বকে কোনোভাবেই সমর্থন করতেন না। তাঁর মতে, বিগ ব্যাং বা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারী বিশাল বিস্ফোরণ হয়েছিল প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ বছর আগে। অর্থাৎ ওই সময়ের আগে জগতের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু তিনি এমন কিছু নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন, যাদের বয়স প্রায় তিন কোটি বছর। এই ধরনের আরও কিছু বিতর্কিত দৃষ্টান্তের জন্য তিনি এই তত্ত্বকে মানতে অস্বীকার করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’-এর অন্তর্গত ‘কসমোলজি কমিশন’-এর প্রধান হয়েছিলেন। ম্যাকের নীতি (Mach’s principle), কোয়ান্টাম কসমোলজি, এবং পদার্থবিদ্যার দূরত্ব সম্পর্কিত নীতি (action-at-a-distance physics) বিষয়ে তিনি গবেষণা করেন। এনসিইআরটি অর্থাৎ ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যাণ্ড ট্রেনিং-এর বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য উপদেষ্টা বিভাগের প্রধান হিসেবে নারলিকারকে নিয়োগ করা হয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের একচল্লিশ কিলোমিটার পর্যন্ত উচ্চতায় যে জীবাণু থাকতে পারে, সেই বিষয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী নারলিকার অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০০১ এবং ২০০৫ সালে সংগৃহীত নমুনা পর্যবেক্ষণ করে তাঁর বিশ্বাস পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টির পদ্ধতি সম্পর্কে এই গবেষণা অনেক নতুন ধারণার সন্ধান দিতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ ইত্যাদির পাশাপাশি নারলিকার অনেক কল্পবিজ্ঞানধর্মী গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন। ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর বইগুলির মধ্যে অন্যতম হল— ‘ফ্রেড হোয়েলস ইউনিভার্স’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু কসমোলজি’, ‘দ্য রিটার্ন অফ বামন’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার’, ‘দ্য স্ট্রাকচার অফ ইউনিভার্স’ প্রভৃতি। হিন্দি ভাষায় নারলিকার লেখেন ‘পার নজর কে’ এক অসামান্য গ্রন্থ এবং তাঁর মাতৃভাষা মারাঠিতে লেখা ‘যক্ষাচী দেণগী’, ‘প্রেষিত’, ‘ভাইরাস’, ‘বামন পরত ন আলা’, ‘অভয়ারণ্য’, ‘আকাশাশী জডলে নাতে’ প্রভৃতি নারলিকারকে লেখক হিসেবেও বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। কল্পবিজ্ঞান রচনার সময় নারলিকার ভারতের পরিবেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং সমাজ ও বিজ্ঞানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। তাঁর রচিত কল্পবিজ্ঞানকাহিনি ‘ধূমকেতু’র উপর ভিত্তি করে ভারতের শিশু চলচ্চিত্র বিভাগ (Children’s Film Society of India) ছোটদের জন্য ২ ঘণ্টার একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিল। নারলিকারের মতে, ভারতের কাছে বিভিন্ন উচ্চমানের বিজ্ঞানমূলক গবেষণায় অংশগ্রহণ করার অনেক সুযোগ আছে যা ভারতকে আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মান এনে দিতে পারে।

নারলিকার সমগ্র জীবনে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মানসূচক খেতাব পেয়েছেন। কেমব্রিজে ডক্টরেট পড়াকালীন তিনি টাইসন পদক জয় করেন এবং ১৯৬৭ সালে অ্যাডামস পুরস্কারে ভূষিত হন। ইছালকরঞ্জি-র এফ. আই. ই ফাউন্ডেশন তাঁকে ‘রাষ্ট্রভূষণ’ উপাধি দেয়। ভারত সরকার ১৯৬৫ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ২০০৪ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ পুরস্কারে সম্মানিত করেছে বিজ্ঞানী নারলিকারকে। এছাড়াও ‘ভাটনগর পুরস্কার’, ‘এম. পি. বিড়লা পুরস্কার’-এ সম্মানিত জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার ২০১১ সালে ‘মহারাষ্ট্র ভূষণ’ পুরস্কার লাভ করেন। ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’-র পক্ষ থেকে তিনি ‘ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার’ লাভ করেন। লন্ডনের ‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’-তে নারলিকার সহযোগী সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে জনপ্রিয় বিজ্ঞানে কৃতিত্বের জন্য UNESCO তাঁকে ‘কলিঙ্গ পুরস্কার’ প্রদান করে। মারাঠি ভাষায় রচিত তাঁর আত্মজীবনী ‘চর নাগরন্তলে মেজে বিশ্ব’ (Chaar Nagarantale Maze Vishwa) বইটির জন্য তিনি ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ পেয়েছেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে নাসিকে আয়োজিত ৯৪তম ‘অখিল ভারতীয় মারাঠি সাহিত্য সম্মেলন’-এ সভাপতিত্ব করেছিলেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার।

বর্তমানে জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার ৮২ বছর বয়সে IUCAA-এর এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার পথ সুগম করার কাজে যুক্ত রয়েছেন।

One comment

আপনার মতামত জানান