জন. ডি. রকফেলার

জন. ডি. রকফেলার

একজন সাধারণ মানুষ থেকে কোটিপতি ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন এমন কতিপয় মানুষদের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী জন. ডি. রকফেলার (John D. Rockefeller) অন্যতম। বিখ্যাত স্ট্যাণ্ডার্ড অয়েল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জন. ডি. রকফেলার বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন, শেষ জীবনে যার সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১০৪ কোটি আমেরিকান ডলার। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম বিলিওনেয়ার(billionaire) তিনিই। ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শীর্ষে ওঠার জন্য অন্য কোম্পানিকে ব্যবসা বন্ধের হুমকি দেওয়া, রেলকর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে কম মূল্যে পণ্য পরিবহন, এমনকি কোম্পানির অন্দরে গুপ্তচর নিয়োগের মতো ঘৃণ্য কাজে জড়িত থাকলেও আজীবন দানশীল ব্যক্তি ছিলেন জন. ডি. রকফেলার। তাঁর অর্থসাহায্যেই উন্নত হয়ে ওঠে তৎকালীন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। তেল শোধনের ব্যবসা এবং তৈলজাত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সমগ্র ইউরোপের বাজার দখল করে নিয়েছিলেন জন. ডি. রকফেলার।

১৮৩৯ সালের ৮ জুলাই আমেরিকা ও কানাডার সীমান্তে নিউ ইয়র্কের রিচফোর্ড শহরে জন. ডি. রকফেলারের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম জন ডেভিসন রকফেলার। তাঁর বাবা উইলিয়াম এভেরি রকফেলার একজন বোটানিক সেলসম্যান ছিলেন। শোনা যায় যে, তাঁর বাবা ক্যান্সারের ওষুধ দিতে পারেন বলে ভ্রান্ত দাবি করতেন। ‘ডেভিড বিল’ নামেও পরিচিত উইলিয়াম রকফেলারকে বিভিন্ন কাজের জন্য বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বাইরে কাটাতে হতো। জন. ডি. রকফেলারের মায়ের নাম এলিজা ডেভিসন যার কাছেই তিনি প্রকৃত অর্থ সঞ্চয়ের শিক্ষালাভ করেন, একইসঙ্গে দানশীলতার শিক্ষাও তিনি তাঁর মায়ের থেকেই পেয়েছিলেন। চার ভাইবোন আর এক দিদির মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন রকফেলার। তাঁর দিদির নাম লুসি এবং অন্যান্য চার ভাইবোন যথাক্রমে উইলিয়াম জুনিয়ার, মেরি, ফ্র্যাঙ্কিন এবং ফ্র্যান্সেস। ছোটবেলা থেকেই খুবই ভদ্র, শান্ত ও মনোযোগী ছাত্র রকফেলারের সঙ্গীতের প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা এবং সঙ্গীতকেই নিজের সম্ভাব্য পেশা হিসেবে বেছে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি প্রতিবেশীদের জন্য কাজ করে পঞ্চাশ ডলার জমিয়েছিলেন যা পরে মায়ের কথাতে একজন কৃষককে এক বছরের জন্য ধার দিয়েছিলেন বার্ষিক ৭% সুদের হারে। মনে করা হয় এই মুনাফা পাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই পরে ব্যবসায়িক জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন জন. ডি. রকফেলার।

ক্লিভল্যাণ্ডে থাকাকালীন প্রথম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন রকফেলার। তারপর বাসস্থান পরিবর্তনের কারণে অ্যালেঘেনিসে অবৈতনিক পাবলিক হাই স্কুলে রকফেলারকে ভর্তি করা হয়। ১৮৫২ সালে রকফেলার ওয়েগো অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়ে মানসিক পাটিগণিত অর্থাৎ মেন্টাল অ্যারিথমেটিকে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এরপর ১৮৫৫ সালে ফোলসম কমার্শিয়াল কলেজ থেকে রকফেলার দশ মাসের একটি হিসাবরক্ষণের কোর্স করেন যা ভবিষ্যতে তাঁকে অনেক নতুন পথের হদিশ দিতে সাহায্য করেছিল।

১৮৫৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে একজন সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে ক্লিভল্যাণ্ডের ‘হিউইট অ্যাণ্ড টাট্‌ল’ নামে একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে কর্মজীবন শুরু করেন রকফেলার। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রকফেলারের সহকারীরা তার গাম্ভীর্য এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠা-ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং সৎ রকফেলার কোম্পানির বিলে কখনো কোনো কারসাজি করতেন না। যারা কোম্পানির টাকা অনেকদিন ধরে বকেয়া রেখে দিয়েছিলেন, সেই টাকা সংগ্রহ করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন তিনি। কিন্তু তিনি তাঁর কাজের জন্য যথোপযুক্ত অর্থ পেতেন না। ছোটবেলা থেকেই নিজের জমানো অর্থ থেকে বিভিন্ন রকমের কল্যাণমূলক কাজ ও গির্জায় দান করতেন তিনি। ১৮৫৮ সালের মধ্যে রকফেলারের কাঁধে কোম্পানির আরো দায়িত্ব বর্তায়। তিনি কোম্পানির জন্য রেলপথ, খাল, নৌকা ইত্যাদির মিশ্রণে এক জটিল পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন যাতে শেষে কোম্পানিরই লাভ হয়েছিল। তাঁর কাজের প্রতি এই দৃঢ়সংকল্প, সতর্কতা, নৈপুণ্যের কারণে ক্লিভল্যাণ্ডের বিস্তৃত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। ১৮৫৯ সালে রকফেলার তার কুড়িতম জন্মদিনের কিছুদিন আগেই নিজের এক প্রতিবেশির সঙ্গে মাত্র দু’হাজার ডলার পুঁজি নিয়ে মূলত শস্য, মাংস সহ অন্যান্য জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য গড়ে তুললেন নিজেদের কোম্পানি ‘ক্লার্ক অ্যাণ্ড রকফেলার’। এক বছরের মাথায় তাঁদের ব্যবসার মূলধন দুই হাজার ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছি চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলারে এবং তারা মোট লাভ করেছিলেন চার হাজার চারশো ডলার। ক্লার্ক ও রকফেলারের এই ব্যবসাতে প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও রকফেলারের ব্যবসায়িক নীতি, দক্ষতা ও বুদ্ধির কাছে অন্যান্য সমস্ত কোম্পানি হার মেনেছিল।

আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় যখন বিভিন্ন মানুষের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে, তখন রকফেলারের কোম্পানি আরো ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। কারণ ক্লার্ক ও রকফেলারের কোম্পানি আমেরিকান সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছিল। ১৮৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে রকফেলার বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁদের কমিশন ব্যবসা তেমন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় নয়। তিনি বুঝতে পারেন যে, রেলপথগুলিই ভবিষ্যতে কৃষিপণ্য পরিবহনের প্রাথমিক মাধ্যম হয়ে উঠবে যা পরে তাঁদের ব্যবসায়িক সঙ্কটের কারণ হবে। রকফেলার আরো বুঝেছিলেন যে তাঁদের ব্যবসা সুদুরপ্রসারী করতে চাইলে কাঁচামালের ব্যবসাই একমাত্র পথ আর এই পথে তেলের ব্যবসা তাঁর জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। ১৮৬৩ সালের দিকে জন জানতে পারেন পেনসিলভেনিয়াতে তেলের খননকার্যের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। গভীর পড়াশোনা আর জ্ঞান আহরণের পর তিনি দেখেন, তেলের খননকার্য অপেক্ষা তেল পরিশোধনের ব্যবসা তুলনামূলকভাবে লাভদায়ক এবং এতে ঝুঁকির পরিমাণও অনেক কম। সেই মতো তেল পরিশোধন করে কেরোসিন তৈরি করতে লাগলেন রকফেলার যা আমেরিকার বিভিন্ন ঘরে নিস্তেল অন্ধকারে আলো এনে দিতে থাকলো। সেইসময় আমেরিকায় পণ্য-পরিবহনের মূল মাধ্যম ছিল রেলপথ। তাই তিনি ঠিক করেন তাদের কোম্পানি রেলপথের ধারে গড়ে তুললে পরিশোধিত তেল সহজেই আমেরিকার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারা যাবে। জন রকফেলার সবসময়েই একজন দক্ষ ব্যবসায়ী ছিলেন। সবসময় নিজের ব্যবসাকে ধ্যান-জ্ঞান মেনে ব্যবসাকে আরো কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায় সেই বিষয়ে তিনি সবসময় ভেবে চলতেন। তিনি লক্ষ করলেন যে, তেল পরিশোধনের সময় অনেক তেল নষ্ট হয়। এই নষ্ট হওয়া তেলকে পুনর্ব্যবহারের উপায় খুঁজতে একটা ‘রিসার্চ অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট টিম’ও তৈরি করেছিলেন রকফেলার। কিছুসময় পরেই তাঁর এই টিমের গবেষণায় নষ্ট হওয়া তেল দিয়ে প্যারাফিন ও মোম তৈরি করে জন. ডি. রকফেলার ব্যবসাকে আরো সমৃদ্ধ করার পথ খুঁজে পেলেন।

১৮৭০ সালে জন রকফেলার ‘স্ট্যান্ডার্ড অয়েল’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেন। জন দেখলেন যে পরিবহনের সমস্যার কারণে অনেক তৈল পরিশোধন কোম্পানি বেড়ে উঠতে পারছিল না কারণ সেই সময়ে রেলপথই ছিল প্রধান পরিবহনের ব্যবস্থা। কিন্তু রেল পরিবহনের খরচ যেরকম বেশি, সেরকমই আমেরিকার কিছু কিছু রেলপথ কিছু বিশেষ ব্যক্তির অধীনে থাকায় সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে যদি অন্য কেউ তেল-পরিবহনের চুক্তি করে ফেলে, অপর কোম্পানিগুলির তখন পরিবহনে সমস্যা হয়। রকফেলার এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে কিছু রেল কোম্পানির সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেন যে, তিনি অনেক পরিমাণে তেল ও কেরোসিন পরিবহন করবেন যে কারণে তাঁর পরিবহনের খরচ কমাতে হবে। রেল কোম্পানি এই চুক্তিতে সম্মতি জানালে জনের কেরোসিন পরিবহনের খরচ অনেক কমে গেল এবং এর ফলশ্রুতিতে মানুষের কাছে কম দামে তেল পৌঁছতে থাকলো। জন রকফেলারই প্রথম ব্যক্তি যিনি তেল পরিবহনের জন্য পাইপলাইনের ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে ‘স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি’র সুনাম হওয়ার ফলে, কোম্পানি নিজের আর্থিক অসুবিধার সময় ব্যাঙ্ককে পাশে পেয়েছিলেন। এমনকি একবার কোম্পানিতে আগুন লেগে যাওয়ার সময়ও ব্যাঙ্ক কোম্পানিকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছিল। কোম্পানির দ্রুত বৃদ্ধিতে রকফেলার প্রতিমাসে প্রায় ৩-৪ টি করে অন্য কোম্পানিগুলি কিনে নিজের অধীনে আনতে লাগলেন। ১৮৮২ সালের মধ্যে ‘স্ট্যান্ডার্ড অয়েল’ হয়ে উঠেছিল আমেরিকার সবথেকে বড়ো তৈল কোম্পানি।

রকফেলার ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে দান করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, দান করলে গোপনে করতে হবে, লোককে জানিয়ে দান হয় না। আমেরিকার ‘ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো’ তাঁরই অর্থসাহায্যে তৈরি হয়েছিল। ১৮৯৩ সালে জন. ডি. রকফেলারের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি স্বামীজির থেকে সাধারণ মানুষের সেবা কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে বহু উপদেশ পেয়েছিলেন। ১৯১৬ সালে রকফেলার হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর প্রথম বিলিওনেয়ার। তাঁর উদ্যোগেই গড়ে ওঠে রকফেলার ফাউণ্ডেশন। কিন্তু এর পরেও জানা যায় যে, ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শীর্ষে ওঠার জন্য অন্য কোম্পানিকে ব্যবসা বন্ধের হুমকি দেওয়া, রেলকর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে কম মূল্যে পণ্য পরিবহন, এমনকি কোম্পানির অন্দরে গুপ্তচর নিয়োগের মতো ঘৃণ্য কাজে জড়িত ছিলেন রকফেলার। একসময় ইউরোপের পত্র-পত্রিকায় ঘৃণ্য এক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯১১ সালে ইউরোপের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারকারী কোম্পানি ‘স্ট্যাণ্ডার্ড অয়েল’কে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ভেঙে মোট চৌত্রিশটি পৃথক কোম্পানি তৈরি করে।

১৯৩৭ সালের ২৩ মে আর্টারিওস্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ফ্লোরিডার নিজের বাড়িতে জন. ডি. রকফেলারের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান