মধুমিতা শুক্লা হত্যা মামলা

মধুমিতা শুক্লা হত্যা মামলা

গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে থাকাকালীন কোন নামজাদা এক ব্যক্তির গর্হিত অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা ভারতে নতুন নয়। তবে কিছু এমন ঘটনা থাকে যাকে ঘিরে নানারকম জল্পনা ও রহস্য দানা বাঁধে। মধুমিতা শুক্লা হত্যা মামলা তেমনই একটি ঘটনা। ২৪ বছর বয়সী এক উঠতি কবি মধুমিতা শুক্লা দুইজন আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন বিধায়ক অমরমণি ত্রিপাঠির নাম। এছাড়াও তাঁর স্ত্রী এবং অন্য দুইজন ব্যক্তিও জড়িয়েছিলেন এর মধ্যে। ময়না তদন্তে জানা যায় মধুমিতা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং গর্ভস্থ সন্তানের ডিএনএ-এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় অমরমণির। যদিও নানা উপায়ে অমরমণি খালাস পাবার চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ পর্যন্ত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় তাঁর।  

মধুমিতা শুক্লা একুশ-বাইশ বছর বয়স থেকে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং ঝড়ের বেগে সাফল্যের সিঁড়ি চড়তে থাকেন। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে সুন্দরী এবং তরুণী মধুমিতা প্রথমবারের মতো অমরমণি ত্রিপাঠীর সাথে দেখা করেন। অমরমণি ত্রিপাঠি উত্তরপ্রদেশের মহারাজগঞ্জ জেলার নওতানওয়া বিধানসভা এলাকার বিধায়ক। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবেও পরিচিতি ছিল অমরমণির। তিনি বিবাহিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীয়ের নাম মধুমণি ত্রিপাঠি। তাঁদের এক সন্তানও রয়েছে, নাম আম্মানমণি ত্রিপাঠি। মধুমিতা ক্রমশ অমরমণির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ডায়রিতে মধুমিতা তাঁর এবং অমরমণির ক্রমবর্ধমান প্রেমের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তাঁর ডায়েরির বয়ান থেকে বুঝতে পারা যায় অমরমণির সঙ্গে সম্পর্কে থেকে কতখানি আনন্দিত ছিলেন তিনি। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎ মধুমিতা শুক্লা তাঁর নিজের ফ্ল্যাটে খুন হয়ে যান। 

২০০৩ সালের ৯ মে। লখনউয়ের পেপার মিল কলোনির বাড়িতে তখন ছিলেন মধুমিতা শুক্লা এবং তাঁর পরিচারক দেশরাজ। বিকেল তিনটে নাগাদ সেই বাড়ির দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলতেই পরিচারক দেশরাজ যাদের দেখতে পান তারা একদিন আগেও এসেছিল। এদের মধ্যে সত্যপ্রকাশ নামের একজন পুনরায় মধুমিতার সঙ্গে দেখা করবার আর্জি জানায়। পরিচারক মধুমিতাকে গিয়ে বলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য বাইরে দুইজন অপেক্ষা করছে। মধুমিতা এরপর নিজে এসে তাদের বাড়ির ভিতরে আহ্বান জানায় এবং দেশরাজকে চা করবার আদেশ দেন। দেশরাজ চা নিয়ে এলে মধুমিতা তাঁকে রান্নাঘরেই থাকতে বলেন। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ বিকট গুলির শব্দ শুনে ছুটে যায় দেশরাজ এবং দেখে মধুমিতা মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন এবং দুজন আততায়ী পালিয়ে গেছে৷ ১৯৯০-এর দশকে উত্তরপ্রদেশে প্রকাশ্য দিবালোকে এমন হত্যাকান্ড এটাই প্রথম।

এই ঘটনার পর পুলিশ প্রাথমিকভাবে এফআইআর দায়ের করতে অস্বীকার করে৷ শেষ পর্যন্ত এফআইআর নথিভুক্ত করলেও সেই এফআইআরে অমরমণি ত্রিপাঠী বা তাঁর স্ত্রী মধুমণি ত্রিপাঠীর কোনো উল্লেখই ছিল না। পুলিশ খুনিকে ধরবার চেষ্টা করলেও অমরমণির সুরক্ষা অব্যাহত রাখা হয়। যেহেতু অমরমণির সঙ্গে নিয়মিত একটি সম্পর্কের মধ্যে ছিলেন মধুমিতা, সেকারণেই অমরমণি প্রসঙ্গ জোরালো হয়ে ওঠে।

এই ঘটনা চরমে পৌঁছয় যখন ময়নাতদন্ত হয় মধুমিতার মৃতদেহের। রিপোর্টে দুটি খবর জানা যায়।  প্রথমত, মধুমিতা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।  দ্বিতীয়ত, গর্ভস্থ সন্তানের ডিএনএ-র সঙ্গে অমরমণির ডিএনএ হুবহু মিলে গেছে। মধুমিতার ডায়রি এন্ট্রি লক্ষ করলে দেখা যায়, মধুমিতা শেষপর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর প্রিয় ‘ভিক্টর’ (অমরমণি) তাঁর প্রতি আর আগ্রহী নয়। তিনি ইতিমধ্যে দুটি গর্ভপাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই তৃতীয় সন্তানটিকে আর নষ্ট করতে চাননি।

এদিকে প্রমাণ সত্ত্বেও এই ঘটনাটিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা তাঁর কর্মজীবনকে ধ্বংস করার চেষ্টা বলে প্রচার করতে থাকেন অমরমনি৷ এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ মাসেরও বেশি সময় পরে, অমরমণি ত্রিপাঠীকে ২০০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিকভাবে তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মহানগর পুলিশ স্টেশনের অফিসার অজয় কুমার চতুর্বেদী। তিনি মধুমিতার ডায়রি উদ্ধার করে সেখান থেকে এই মামলা সম্পর্কিত নানা তথ্য বার করেছিলেন৷ তারপর সাক্ষ্যপ্রমাণ জড়ো করে অমরনাথ ত্রিপাঠীর বাড়িতেও হানা দেন এবং তদন্ত শুরু করেন। কিন্তু সরকারী নির্দেশিকা যথাযথভাবে না মানার কারণে মধুমিতা শুক্লা হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৩ সালের জুন মাসে মামলার প্রধান তদন্তকারী আইপিএস মহেন্দ্র লালকাকে রাজ্য সরকার বরখাস্ত করে। কিন্তু তার পঁয়তাল্লিশ দিন পরেই সরকার যখন বুঝতে পারে যে মহেন্দ্র আসলে সঠিক ছিলেন তখন তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর সিআইডির কাছ থেকে মামলাটির দায়িত্বভার সিবিআই গ্রহণ করে।  ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে অমরমণিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ত্রিপাঠীর ফোন কলগুলিকে পরীক্ষা করে দেখা হয়। দেখা যায় যে, হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত ফোন কলগুলি গোরখপুর থেকে অমরমণির স্ত্রী মধুমণির করা। এই প্রমাণগুলি থেকে ত্রিপাঠীর স্ত্রীকেও মধুমতি শুক্লা হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তদন্ত শেষে সিবিআই যে চার্জশিট দাখিল করে তাতে অভিযুক্ত করা হয় অমরমণি ত্রিপাঠী, তাঁর স্ত্রী মধুমণি, ভাইপো রোহিত চতুর্বেদী এবং দুই আততায়ী সন্তোষ রাই ও প্রকাশ পান্ডেকে।

তাঁরা জামিন পাওয়ার বিভিন্ন চেষ্টা করেছিলেন। শুক্লার গর্ভস্থ সন্তানের ডিএনএ রিপোর্টকে অস্বীকার করারও চেষ্টা করেন অমরমণি। অবশ্য তাদের সমস্ত আবেদনই খারিজ করে দেওয়া হয়। অমরমণি এবং তাঁর স্ত্রীকে গোরখপুর থানায় রাখা হয়েছিল। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে মামলাটি দেরাদুনের ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর কেবল প্রকাশ পান্ডে ছাড়া বাকি সকলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল৷ পরে এই মামলাটি নৈনিতাল হাইকোর্টে গিয়ে পৌঁছয়। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে এবং সেইসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বারীন ঘোষ ও বিচারপতি ইউসি ধায়ানির সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ প্রকাশ পান্ডেকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করে।

সম্প্রতি এই হত্যাকান্ড নিয়ে ডিসকভারি চ্যানেলে ‘লাভ কিলস’ নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ পেয়েছে।

আপনার মতামত জানান