ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

শকুনির মৃত্যু

মহাভারতের শল্যপর্বের ঊনত্রিশতম অধ্যায়ে শকুনির মৃত্যু র ঘটনা বর্ণিত আছে। দ্যূতসভায় দাঁড়িয়ে কনিষ্ঠ পান্ডব সহদেব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি যুদ্ধে শকুনিকে হত্যা করবেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আঠেরোতম দিনে সহদেবের হাতেই শকুনির মৃত্যু হয়।          মদ্ররাজ শল্যের মৃত্যুর পর অবশিষ্ট কৌরবসৈন্যরা প্রাণভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে লাগল। তখন শকুনির ছেলে উলুক পান্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন। প্রথমে তাঁর সঙ্গে সহদেবের যুদ্ধ শুরু হল। ভীষণ যুদ্ধের পর সহদেব ভল্লের আঘাতে উলুকের মাথা কেটে ফেললেন। 

নিজের ছেলের অসহায় মৃত্যু দেখে রাগে-দুঃখে পাগলপ্রায় শকুনি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পান্ডবদের আক্রমণ করলেন। সহদেবকে সামনে পেয়ে শকুনি তিনটি বাণ দিয়ে তাঁকে আঘাত করলে সহদেব পাল্টা বাণ ছুঁড়ে শকুনির ধনুক ভেঙে দিলেন। ধনুক কাটা যেতে শকুনি সহদেবের দিকে একটি বিশাল তরোয়াল ছুঁড়ে মারলেন। কিন্তু সেটিও সহদেবের বাণে মাঝপথেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

তরোয়ালটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শকুনি একটি ভয়ঙ্কর গদা তুলে নিয়ে সজোরে সহদেবের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। সহদেব অনায়াসে সেই গদাটিকেও মাটিতে ফেলে দিলেন। তখন শকুনি কালরাত্রির মত জ্বলন্ত, অতি ভীষণ একটি শক্তি প্রয়োগ করলেন। শক্তিটি বায়ুবেগে সহদেবের দিকে আসতে থাকলে সহদেব হাসতে হাসতে একটি সোনার তৈরি আশ্চর্য বাণ দিয়ে সেটিকে তিন টুকরোয় ভেঙে দিলেন। মেঘ থেকে যেমন করে বিদ্যুৎ মাটিতে পড়ে, তেমন করেই সেই ভয়ানক শক্তি নিজের সব ক্ষমতা হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে শকুনি প্রাণের ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কৌরবসৈন্যরাও পালাতে লাগল। পান্ডবদের সৈন্যরা আনন্দে সিংহনাদ করতে করতে কৌরবদের আক্রমণ করতে লাগলেন। সহদেব তখন পলায়নরত শকুনিকে ধাওয়া করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং মাহুত অঙ্কুশ দিয়ে যেমন করে ক্ষ্যাপা হাতিকে আঘাত করে, সেইভাবে তিনিও অসংখ্য বাণ দিয়ে শকুনিকে আঘাত করতে লাগলেন। সহদেব বললেন, “দুর্মতি! স্মরণ করো দ্যূতসভার ঘটনা। স্মরণ করো পান্ডবদের প্রতিজ্ঞা। সেই সভায় তোমরা যা যা অন্যায় করেছিলে, তারই ফল আজকের এই যুদ্ধ। সেই পাপীদের মধ্যে সকলেই যমালয়ে চলে গেছে, শুধু তুমি আর দুরাত্মা দুর্যোধন বাকি আছো। মানুষ আঁকশি ব্যবহার করে যেমন করে গাছ থেকে ফল মাটিতে ফেলে, আমি তেমনি করেই আজ তোমার মাথা মাটিতে ফেলব। মৃত্যুর জন্য তৈরি হও।”

এই কথা বলে সহদেব কান পর্যন্ত ধনুকের জ্যা টেনে দশ বাণে শকুনিকে ও চার বাণে তাঁর রথের ঘোড়াগুলিকে আঘাত করলেন। শকুনির ছাতা, রথ ও ধ্বজ বিনষ্ট করে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তিনি অগণিত বাণ দিয়ে শকুনির সব মর্মস্থানে আঘাত করতে লাগলেন। আহত শকুনি একটি প্রাস দিয়ে সহদেবকে আটকানোর চেষ্টা করলে সহদেব গর্জন করতে করতে সূর্যের মত উজ্জ্বল তিনটি ভল্ল ছুঁড়ে মারলেন। সেই তিনটি ভল্ল ছুটে গিয়ে শকুনির দুই হাত ও মাথা কেটে ফেলল। যেভাবে কাঠুরেরা বিরাট গাছকে এক আঘাতেই মাটিতে ফেলে দেয়, সেইভাবে শকুনির প্রাণহীন শরীর মাটিতে পড়ে গেল।

শকুনির মৃত্যু দেখে গান্ধাররাজ্যের সৈন্যরা ভয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে যুদ্ধ ছেড়ে পালাতে লাগল। পান্ডবরা সবাই কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দে শঙ্খধ্বনি ককরতে লাগলেন। নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণ করার জন্য পান্ডবপক্ষের যোদ্ধারা সহদেবকে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ, শল্যপর্ব, অধ্যায় ২৮-২৯, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৮
  2. ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, শল্যপর্ব, পৃষ্ঠা ১৭৯-১৮১
  3. ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত', ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় প্রকাশ অধ্যায় ৮১, ‘উলুক-শকুনি বধ', পৃষ্ঠা ৫৫৪-৫৫৮,

আপনার মতামত জানান