মথুরা ধর্ষণ মামলা

মথুরা ধর্ষণ মামলা

ভারতে বহু সময় ধরেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্ষণের পরিসংখ্যান সূচক অনেকটাই উপরের দিকে রয়েছে। ‘দ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’-র অধীনে সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হয়। ফলে ভারতে ধর্ষণের মামলাও রুজু হয় অনেক, বেশিরভাগ খবরই চাপা থাকে নিত্যদিনের রোজনামচার ফাঁকে। নির্ভয়া ধর্ষণ মামলার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া মথুরা ধর্ষণ মামলা এমনই এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ছিল। থানার মধ্যে দুই পুলিশের হাতে ধর্ষিতা হয়েও সেদিন সুবিচার পাননি মথুরা নামের সেই তরুণী। সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল এর প্রতিবাদে আর তার ফলে ধর্ষণ আইনে যুক্ত হয়েছিল নতুন সংশোধনী।

১৯৭৪ সালের ১ জুন মহারাষ্ট্র সেশন আদালতে এই মামলা শুরু হয়েছিল। তবে এখানেই মামলার সমাপ্তি ঘটেনি। পরবর্তীকালে বম্বে উচ্চ আদালত এবং সুপ্রিম কোর্টেও এই মামলা ওঠে। অবশেষে ১৯৭৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট মথুরা ধর্ষণ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন দুজন পুলিশ কনস্টেবল তুকারাম এবং গণপত। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার বিচারপতি ছিলেন যশবন্ত সিং, কৈলাসাম এবং কোশল।

মহারাষ্ট্রের এক অনাথ আদিবাসী মেয়ে মথুরা, তাঁর এক ভাইয়ের সঙ্গে থাকত। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ যে সময় এই ঘটনাটি ঘটে, তখন তাঁর বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। নুসি নামের এক মহিলার সঙ্গে মথুরা মাঝে-মধ্যেই একটি বাড়িতে গৃহ-পরিচারিকার (Domestic Helper) কাজ করতে যেতেন। একদিন নুসির ভাইপো অশোকের সঙ্গে তাঁর যখন দেখা হয় অশোক মথুরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মথুরার ভাই এই প্রস্তাবের কথা শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় থানায় অশোক ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মথুরাকে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করে  এবং জানায় যে তাঁর বোন এখনও নাবালক। স্থানীয় থানার পুলিশ এই অভিযোগের ভিত্তিতে অশোক এবং তার পরিবারকে থানায় ডেকে নিয়ে আসে। পুলিশি তদন্তের পরে পুলিশ অশোক ও তার পরিবারকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুমতি দেয়। এরপর তুকারাম এবং গণপত নামের দুই কনস্টেবল মথুরার আত্মীয়দের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে মথুরাকে থানার মধ্যেই ধর্ষণ করে।এই ধর্ষণের ঘটনা চাপা থাকেনি। মথুরার বাড়ির লোক এ ঘটনা জানতে পারার পর থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় এবং জনতার চাপের মুখে বাধ্য হয়ে তুকারাম এবং গণপত একটি ‘পঞ্চনামা’ অর্থাৎ প্রমাণের আইনি নথি দায়ের করতে সম্মত হয়। ১৯৭৪ সালের ১ জুন এই মামলাটি মহারাষ্ট্রের সেশন আদালতে ওঠে। অদ্ভুতভাবে সেখানে এই মামলার রায়ে অভিযুক্ত দুই পুলিশ বেকসুর খালাস পান। এমনকি সেখানে এও বলা হয় যে মথুরার সম্মতিতেই এই যৌনমিলন হয়েছিল, ফলে তাকে কোনওভাবেই ধর্ষণের পর্যায়ে ফেলা যাবে না। সেশন আদালতে প্রমাণিত হয় যে মথুরা তাঁর যৌন-চাহিদার জন্য গণপতকে আকৃষ্ট করেছিল এবং তার সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছিল। তাছাড়া সেশন আদালতে গণপতের কাপড়-জামায় পাওয়া বীর্যের উপস্থিতিকে তার রাত্রিকালীন স্খলন (Night Fall) বলেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন বিচারপতিরা এবং মথুরার কাপড়ে পাওয়া বীর্য যে অন্য কারও সঙ্গে যৌনমিলনের ফলে এসেছে, তা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ (৬) ধারা অনুসারে ১৬ বছরের কম বয়সী কোনও মহিলার সঙ্গে তাঁর সম্মতিক্রমে বা অসম্মতিক্রমে যৌনমিলন এক দণ্ডনীয় অপরাধ। মথুরার উকিল ড. শাস্ত্রকার যেখানে মথুরার বয়সের সব প্রমাণ পেশ করেছিলেন আদালতের কাছে, সেখানে আদালতের বিচারপতি তা অপর্যাপ্ত বলে খারিজ করে দেন। তাছাড়া সেশন আদালতের বিচারপতি অদ্ভুতভাবে মথুরাকে দায়ী করেন এই ধর্ষণের গল্প বানানোর মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টার জন্য। এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের ভিত্তিতে বম্বে উচ্চ আদালতের নাগপুর বেঞ্চ সেশন আদালতের রায়কে দূরে সরিয়ে রেখে অভিযুক্তদের যথাক্রমে ১ বছর এবং ৩ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে। বম্বে আদালতে বলা হয় যে গুরুতর ভয় বা হুমকির কারণে আত্মসমর্পণ করার মধ্যে দিয়ে সম্মতি বা ইচ্ছায় যৌনমিলন হয়েছে এমনটা প্রমাণ হয় না। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি যশবন্ত সিং, কৈলাসাম এবং কোশল তাঁদের বিচারে মথুরা ধর্ষণ মামলা ওরফে তুকারাম বনাম মহারাষ্ট্র রাজ্য মামলার অভিযুক্তদের আবার দোষী সাব্যস্ত করে বিচারপর্ব শুরু করেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে দেখা যায় যে সুপ্রিম কোর্টে প্রমাণিত হয় মথুরা কোনও প্রকার অসম্মতি জানান দেয়নি। তাঁর শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্নও ছিল না আর তাই বলপূর্বক ধর্ষণের কোনও ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেনি, এ কথা প্রমাণিত হয়। এমনকি এখানে বিচারকেরা উল্লেখ করেন যৌনতায় অভ্যস্ত মথুরা ডিউটিতে ব্যস্ত থাকা পুলিশদের প্ররোচিত করেছিল যৌন সংসর্গ করতে।

এই রায় ঘোষণার কয়েকদিন পরেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক উপেন্দ্র বক্সী, রঘুনাথ কেলকার এবং লোটিকা সরকারের সঙ্গে পুনের বসুধা ধাগমওয়ার সুপ্রিম কোর্টে একটি খোলা চিঠি লিখে তাদের রায়ের বিরোধিতা করেন। ফলে এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় দেশ জুড়ে এবং ভারতের বহু নারী সংগঠন এই রায়ের পুনর্বিবেচনার দাবি জানায়। দিল্লিতে এই রায়কে কেন্দ্র করে ‘সহেলী’ নামের একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের প্রথম ধর্ষণ বিরোধী নারীবাদী সংগঠন গড়ে তোলেন লোটিকা সরকার যার নাম ‘ফোরাম এগেইনস্ট অপ্রেশন অফ ওম্যান’ (Forum Against Oppression of Woman)। আইনি সংস্কারের জন্য বিতর্ক তুলে এই সংগঠনটি একটি জাতীয় সম্মেলনও আয়োজন করে। এই ঘটনাকে অনুসরণ করেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি, নাগপুর সহ আরও অন্যান্য রাজ্যের মহিলারা রাস্তায় নামে প্রতিবাদ মিছিলে। অবশেষে এই চাপের মুখে পড়ে ভারত সরকার ধর্ষণ আইনের সংশোধন করে। ১৯৮৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘দ্য ক্রিমিন্যাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৮৩’-এর মাধ্যমে ভারতীয় ধর্ষণ আইনে একটি নতুন সংশোধনী আনা হয় যেখানে ভিক্টিমের (Victim) যৌনমিলনে অসম্মতিকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অর্থাৎ ধর্ষণের শাস্তিসূচক ধারার সংশোধনীতে ৩৭৬ (এ), ৩৭৬ (বি), ৩৭৬ (সি) ও ৩৭৬ (ডি) এই উপধারাগুলি যুক্ত করে পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন ধর্ষণকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ধার্য করা হয়। এর ফলে ভিক্টিমের ছবি তোলা কিংবা তার পরিচয় প্রকাশের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

আপনার মতামত জানান