নামিব ডেজার্ট বিটল

নামিব ডেজার্ট বিটল ।।  যে পোকা বাতাস থেকে জল পান করে

এই ভূমন্ডলের বিচিত্র প্রাণীজগত এবং তাদের জীবনধারণ পদ্ধতি প্রাণীবিজ্ঞানীদের বারে বারে বিস্মিত করেছে। তাঁরা চেষ্টা করেছেন নিরন্তর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাণীদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার রহস্য উন্মোচন করতে। প্রত্যেক প্রাণী, কীটপতঙ্গেরই এমন বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাদেরকে প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতিতেও  জীবনধারণের জন্য অভিযোজিত করে তোলে। আজ তেমনই একটি পোকার কথা বলবো যে পোকাটি শুষ্ক মরুভূমি থেকে এক  অসামান্য উপায়ে জল সংগ্রহ করে থাকে। গুবরে পোকার একটি বিশেষ প্রজাতি হল স্টেনোকারা গ্র্যাসিলিপস (Stenocara gracilipes)। বৈজ্ঞানিক এই নামের বাইরেও তার আরেকটি নাম আছে – নামিব ডেজার্ট বিটল (Namib Desert Beetle)। দক্ষিণ আফ্রিকার নামিব মরুভূমিতে সাধারণত এই পোকার বাস। বিশ্বের অন্যতম শুষ্ক অঞ্চল হিসেবে কুখ্যাত নামিব মরুভূমিতে জল প্রায় নেই বললেই চলে। এই প্রায় জলহীন শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকেই নামিব ডেজার্ট বিটল বাঁচার জন্য নিত্যদিন প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহ করে এক বিশেষ উপায়ে। পোকাটির এই জল সংগ্রহের পদ্ধতি এতটাই তাক লাগানো, এতটাই বিস্ময়কর ও অভিনব যে প্রাণী বিজ্ঞানীরা এটি লক্ষ করে তাজ্জব হয়ে গেছেন।  এই পোকাটি এক অভিনব উপায়ে ভোরের কুয়াশা থেকে জল সংগ্রহ করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এটাও দেখা গেছে কুয়াশা ছাড়াও আর্দ্র বাতাস থেকেও এই নামিব ডেজার্ট বিটল জল সংগ্রহ করতে পারে। প্রাণী বিজ্ঞানীরা নামিব ডেজার্ট বিটলের এই জল সংগ্রহের পদ্ধতিটি নিয়ে বিশদে গবেষণা চালিয়েছেন। পৃথিবীর জলসংকটপূর্ণ এলাকাগুলিতে  পরিষ্কার ব্যবহার্য জল সংগ্রহের জন্য নামিব মরুভূমির এই পোকাটির জল সংগ্রহের এই পদ্ধতিটিকেই বৈজ্ঞানিকরা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।

দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার শুষ্ক নামিব মরুভূমিতে বেঁচে থাকার জন্য স্টেনোকারা গ্র্যাসিলিপস বাতাস বা ভোরের কুয়াশা থেকে জল সংগ্রহ ক’রে জীবনধারণ করে থাকে। এই পোকাগুলির পা বেশ দীর্ঘ এবং তার দুই ডানার উপরিতল অমসৃণ, এবড়োখেবড়ো প্রকৃতির হয়ে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই এই পোকাগুলি মরুভূমির বালির স্তুপের ওপর চড়তে শুরু করে।  চড়তে চড়তে একসময় বালিয়াড়ির সবচেয়ে উঁচু অংশটিতে পৌঁছে যায় যেখানে কুয়াশা আর বালি একাকার হয়ে গেছে। এবার সে নিজের দীর্ঘ শক্ত পায়ের ওপর ভর করে তার শরীরটিকে ৪৫° কোণ করে কুয়াশার দিকে তাক করে রাখে। কুয়াশা থেকে জলীয় বাষ্প পোকাটির শক্ত ডানার ওপরে জমতে থাকে এবং ফোঁটা ফোঁটা জলে পরিণত হয়। ডানায় জমা জল এরপর পোকাটির মুখের দিকে গড়িয়ে যায় এবং সেই পোকা তারপর প্রাণভরে সেই জল পান করে।

জল সংগ্রহের এই পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের তাক তো লাগিয়ে দিয়েইছে, তার চেয়েও বেশি অবাক করেছে তাঁদের জল বিন্দুগুলির পোকাটির মুখ অবধি পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি।  তাঁরা পোকাটির শারীরিক কাঠমোর দিকে এবার তাঁদের গবেষণার নজর ঘোরালেন। তাঁরা লক্ষ করলেন এই স্টেনোকারা গ্র্যাসিলিপস পোকাগুলির ডানার পৃষ্ঠতলে একটি হাইড্রোফিলিক বা জল আকর্ষণকারী আবরণ রয়েছে। বাতাসের জলীয় বাষ্প এই হাইড্রোফিলিক পৃষ্ঠতলের সংস্পর্শে এলেই জলের অণু ও সেই  হাইড্রোফিলিক আবরণের অণুর মধ্যে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক আকর্ষণ তৈরি হয় যার কারণে প্রথমেই জলকণাটি চ্যাপ্টা হয়ে প্রায় মিশে যায় অসমান শক্ত ডানার সঙ্গে, ফলে বাতাস সেই জলকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না এবং পরবর্তী জলকণাগুলি সেই পৃষ্ঠতলে জমা হতে পারে সহজেই। এইভাবে জলের একটি ফোঁটার সঙ্গে আরেকটি ফোঁটা মিলিত হতে থাকে। ফোঁটাগুলি জমতে থাকে এবং আকারে বড় হতে থাকে। একটা সময়ে যখন জলের ফোঁটাগুলি এতটাই বড় হয়ে যায় যে আর পৃষ্ঠতলে আটকে থাকতে পারে না তখন সেই সেই জল পোকার মুখের দিকে গড়িয়ে নামতে শুরু করে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

তবে এই স্টেনোকারা গ্র্যাসিলিপস ছাড়াও নামিব মরুভূমিতে আরও কয়েকটি এমন পোকার সন্ধান পাওয়া গেছে যারা এই পদ্ধতিতে জল সংগ্রহ করে থাকে। তেমন দুটি পোকা হল অনিম্যাক্রিস আনগুইকুলারিস (Onymacris unguicularis) এবং ফাইসোস্টেরনা ক্রিবরিপস (Physosterna cribripes)।

এই পোকারা কীভাবে জল সংগ্রহ করে তা বোঝার জন্য আমেরিকার ওহিওর অ্যাক্রন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী হান্টার কিং এবং তাঁর সহকর্মীরা অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন রকম সারফেস টেক্সচার বা পৃষ্ঠতল-সহ কয়েকটি গোলক নির্মাণ করেন যার কোনটির পৃষ্ঠ খাঁজকাটা, কোনটি অসমান এবড়োখেবড়ো, কোনটি আবার মসৃণ। কোন পৃষ্ঠতল বাতাস থেকে কত পরিমাণ জল সংগ্রহ করতে পারে তা পরীক্ষা করবার জন্য সেই বিজ্ঞানীরা একটি কৃত্রিম বায়ু সুড়ঙ্গও তৈরী করেন। এই পরীক্ষাতে তাঁরা দেখতে পান প্রধানত অসমান এবড়োখেবড়ো পৃষ্ঠতলেরই বাতাস থেকে জল সংগ্রহ করে তা ধারণ করবার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। দেখা যায় সম আয়তনের মসৃণ গোলকের  তুলনায় প্রায় ২.৫ গুণ বেশি জলের ফোঁটা সংগ্রহ করেছে ওই অসমান পৃষ্ঠতলটি।

এছাড়াও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু আর পার্কার এবং ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা কাইনেটিকিউ (QinetiQ) এর গবেষক ক্রিস লরেন্সও এই পোকাগুলির ডানার বিশেষ ধরনকে অনুকরণ করার জন্য সেই ধরনেরই একটি পৃষ্ঠতল নির্মাণ করেছিলেন যা পোকাটির ডানার মতোই কার্যকরী বলে তিনি দাবি করেন। পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলিতে প্রবল জলের অভাব আছে সেই অঞ্চলের মানুষের সুবিধার্থে, সেখানকার চাষাবাদের প্রয়োজনে জল সংগ্রহের এই পদ্ধতিটির উপযোগীতা অনস্বীকার্য। বর্তমানে এনবিডি ন্যানো নামে একটি কোম্পানি এই প্রযুক্তিটির বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা করে চলেছে।

আপনার মতামত জানান