প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের পালনীয় সেই দিবসগুলির মধ্যে একটি হল জাতীয় সমুদ্র বাণিজ্য দিবস (National Maritime Day)।
প্রতি বছর ৫ এপ্রিল সমগ্র ভারত জুড়ে পালন করা হয় জাতীয় সমুদ্র বাণিজ্য দিবস। আন্তর্মহাদেশীয় বাণিজ্য ও অর্থনীতির বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে মূলত এই দিনটি পালিত হয়। সমুদ্রপথে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে বাণিজ্য এবং ভারতের সামুদ্রিক অঞ্চলগুলির সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করাই এই বিশেষ দিনের উদ্দেশ্য। তাছাড়া দেশের নৌ-বাহিনীর নাবিকও অন্যান্য সদস্যদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য একটি বিশেষ দিন হিসেবে জাতীয় সমুদ্র বাণিজ্য দিবস পালন করা হয়। কারণ এই নৌ-বাহিনীর সদস্যরাই নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে সমুদ্রপথে সকল প্রকার পণ্য পরিহনের জন্য সমস্ত দিন পরিশ্রম করে থাকেন। জাহাজের মধ্যে মাসের পর মাস সময় অতিবাহিত করেন তাঁরা, এমনকি করোনা মহামারীর সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা অন্যান্য দেশে আটকে পড়া হাজার হাজার ভারতীয়কে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
ভারতীয় জাতীয় অর্থনীতিতে সমুদ্র বাণিজ্যের অবদান কম নয়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আয়তন বা পরিমাণের হিসেবে প্রায় ৯০ শতাংশ এবং মূল্যের হিসেবে প্রায় ৭৭ শতাংশ পণ্যই সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়। তবে ভারতের সমুদ্র-বাণিজ্যের ইতিহাস ছিল সুপ্রাচীন। আনুমানিক ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হরপ্পায় লোথাল বন্দরের কথা জানা যায় যা প্রাচীন ভারতের প্রথম সমুদ্র বন্দর। সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরেও প্রাচীনকালের জাহাজের একটি চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। বহু আগে থেকেই ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে বহু দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল ভারতের।ভারতের প্রাচীন বন্দর শহরগুলির মধ্যে বিখ্যাত ছিল নাগাপত্তনম, উদিপি, তুতিকোরিন, ম্যাঙ্গালোর, কান্নুর, থানে, মাদুরাই, থাঞ্জাভুর, তিরুচিরাপল্লি ইত্যাদি। রেশম, তুলা, চন্দন, কাঠ ও অন্যান্য মশলা ছিল মূলত ভারতের সমুদ্র-বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ যা ভারত থেকে বাইরের বহু দেশে রপ্তানি করা হত। ব্রিটিশ আমলে এই সমুদ্র বাণিজ্যের ধারাক্রমটা অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। বলা হয় ব্রিটিশরা ভারতের সমুদ্র-বাণিজ্যকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ বাণিজ্যতরীগুলি সেই সময় সর্বোচ্চ এক হাজার টনের হত, যেখানে ভারতীয় বাণিজ্যতরীর ওজন ছিল তার থেকেও বেশি প্রায় পনেরশ টন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য ভাবানগর অঞ্চলে ‘দরিয়া দৌলত’ নামে একটি বিরাট জাহাজ তৈরি করেছিল ভারতীয়রা। ভারতের লাউজি ওয়াড়িয়া পরিবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য দেড়শ বছর ধরে প্রায় ৩৫৫টি জাহাজ নির্মাণ করেছিল, এমনই নথিবদ্ধ রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। ১৮৪২ সালে হংকং-কে অধিকার করার জন্য ব্রিটিশদের সঙ্গে যে নানকিং চুক্তি হয়েছিল, তাও স্বাক্ষরিত হয়েছিল ভারতীয়দের নির্মিত ‘এইচ এম এস কর্নওয়ালিস’ নামক একটি জাহাজে। ভারতে ১৮৯১ সালে প্রথম ফরাসি সরকারের অনুমতিক্রমে দর্মনাথন পুরুষান্থি তৈরি করেন ‘পুরুষান্থি স্টিম নেভি কোং’। ১৯০০ সালের দিকে এই সমুদ্র-বাণিজ্য সংস্থা বন্ধ হয়ে যায় কারণ ফরাসি সরকার সায়গং থেকে ব্যাঙ্ককে জলপথে বাণিজ্য করতে সম্মতি জানায়নি। তারপরেই ১৮৯৪ সালে জে এন টাটা শুরু করেছিলেন বম্বে থেকে চিন ও জাপানের মধ্যে ‘টাটা লাইন’ বাণিজ্য-তরী নির্মাণ করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর চালু করেছিলেন ‘বেঙ্গল স্টিমশিপ কোম্পানি’ যা মূলত সাধারণ মানুষের পরিবহনে সাহায্য করত। এমনকি শোনা যায় এই জাহাজের যাত্রীদের কোম্পানির তরফ থেকে একটি করে সুদৃশ্য রেশমের রুমালও উপহার দেওয়া হত। ১৯৬৪ সালে প্রথম ভারতে পালন করা হয়েছিল জাতীয় সমুদ্র বাণিজ্য দিবস। এই দিনেই ১৯১৯ সালে ‘সিন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেড’ (Scindia Steam Navigation Company Limited) সংস্থার পক্ষ থেকে ‘এস এস লয়্যালটি’ (S S Loyalty) নামে একটি জাহাজ মুম্বাই থেকে লন্ডনের পথে পাড়ি দেয়। সেটাই ছিল ভারতের প্রথম বাণিজ্যের জন্য সমুদ্রযাত্রা। এই তারিখটি তাই সত্যই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেই সময় সমস্ত প্রকার জলপথই ব্রিটিশদের অধিকৃত ছিল। ভারতের বর্তমান ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ শিপিং-এর মতে, বর্তমান ভারতে ৪৩টি জাহাজ নির্মাণ ও পরিবহন সংস্থা রয়েছে যাদের নিজেদেরই প্রায় ১৪০০টি জাহাজ রয়েছে এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেই সব জাহাজে মোট ১ কোটি ২৬ লক্ষ ৯০ হাজার টন পণ্য পরিবাহিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রতি মানুষের সচেতনতা ও সমর্থন বাড়ানোর জন্যও এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সুসংগঠিত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে পণ্য পরিবহনের জন্য সমুদ্রপথই সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। ইতিহাস অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সিন্ধু উপত্যকার মানুষেরা মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্য শুরু করেছিল। পরে মিশরে রোমান সাম্রাজ্য স্থাপিত হলে মিশরের সঙ্গেও তারা সমুদ্রবাণিজ্য করতে শুরু করেছিল বলে জানা যায়। ১৯৫৯ সালে ভারত আন্তর্জাতিক সমুদ্রবাণিজ্য সংগঠন (International Maritime Organization)-এর সদস্য হয়। সামুদ্রিক সুরক্ষা এবং জাহাজের কারণে দূষণ প্রতিরোধের জন্য এই সংগঠনটি কাজ করে। মূলত ইউনাইটেড কিংডম এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রতি বছর এই সংগঠনের পক্ষ থেকে সমুদ্র-বাণিজ্য কেন্দ্রিক সম্মেলন আয়োজিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী সেই সম্মেলনের খসড়ার একটি আদর্শ ভিত্তি তৈরি হয়।
প্রতি বছর জাতীয় সমুদ্র-বাণিজ্য দিবসকে কেন্দ্র করে একটি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এই দিনে ভারতের সমুদ্র-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের সম্মান জ্ঞাপন করা হয়। তাঁদের সকলকে বরুণ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার বলতে একটি বরুণদেবের মূর্তি এবং সম্মান-জ্ঞাপনী একটি স্ক্রল (Scroll)। এর পাশাপাশি কৃতী ব্যক্তিদের ‘এনএমডি অ্যাওয়ার্ড অফ এক্সিলেন্স’ (NMD Award Of Exellence) দিয়েও সম্মানিত করা হয়। কৃতী ব্যক্তিদের আজীবনের অবদান এবং সমুদ্র-বাণিজ্যের সিনিয়র ফাংশনাল স্তরে কৃতিত্বের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও একটি স্মারক ও একটি মানপত্র দেওয়া হয়ে থাকে। সমুদ্র-বাণিজ্য শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের ‘আউটস্ট্যান্ডিং কন্ট্রিবিউশন টু মেরিটাইম এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করা হয়। ২০২১ সালে ভারতে ৫৮তম জাতীয় সমুদ্র বাণিজ্য দিবস উদ্যাপিত হয়।
২০১৯ সালে এই বিশেষ দিনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভারত মহাসাগর – একটি সুযোগের মহাসাগর’ (Indian Ocean – A Ocean of Opportunity)। ২০২০ সালে এই দিনটির প্রতিপাদ্য স্থির হয়েছিল ‘দীর্ঘায়ু পৃথিবীর জন্য দীর্ঘস্থায়ী সমুদ্র-পরিবহন’ (Sustainable Shipping For Sustainable Planet) এবং ২০২১ সালে জাতীয় সমুদ্র-বাণিজ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘কোভিড-১৯ পেরিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সমুদ্র-পরিবহন’ (Sustainable Shipping Beyond COVID-19)।
One comment