প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যেই একটি হল জাতীয় ডাক দিবস (National Post Day)।
প্রতি বছর ১০ অক্টোবর সারা ভারত জুড়ে জাতীয় ডাক দিবস পালিত হয়। বিগত দেড়শো বছর ধরে ভারতীয় ডাকবিভাগের কর্মকাণ্ড এবং সাফল্যকে মনে রেখে ডাকবিভাগের কার্যক্রমকে জনমানসে আরো ছড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক ডাক দিবসের একটি বর্ধিতাংশ হিসেবে ভারতে এই জাতীয় ডাক দিবস পালিত হয়। আন্তর্জাতিক ডাক দিবস যেখানে পালিত হয় প্রতি বছর ৯ অক্টোবর তারিখে, সেখানে ঠিক এর পরেরদিনই জাতীয় ডাক দিবস পালিত হয় ভারতে। এছাড়াও প্রতি বছর ৯ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে পালিত হয় জাতীয় ডাক সপ্তাহ।
বহু প্রাচীনকাল থেকে মানুষ চিঠির মাধ্যমে দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আসছে। রাজা-বাদশাহরা আগে দূত মারফত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বার্তা পাঠাতেন। ক্রমে রানাররা কাঁধে করে চিঠির বোঝা বয়ে বয়ে পায়ে হেঁটে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে চিঠি পৌঁছে দিতো। কিন্তু, আধুনিক যুগ এখন প্রযুক্তিগতভাবে অনেক উন্নত। মাত্র সামান্য কয়েক সেকেণ্ড খরচ করেই ইমেল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো বার্তা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অতি সহজেই পাঠানো যায় এবং একইসঙ্গে বিভিন্ন জায়গার বহু মানুষকেও সেই বার্তা পাঠানো সম্ভব। কিন্তু আজও ভারতের এমন একটি শ্রেণি আছে যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করার সামর্থ্য রাখে না, ফলে তাদের কাছে চিঠিই আজও ভরসা। গ্রামে গ্রামে কিছুদিন আগে পর্যন্তও ডাকপিওনেরা নিরক্ষর মানুষকে চিঠি পড়ে দিতেন। ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠতো। সেই মোগল সম্রাট শেরশাহের আমলে ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক পাঠানোর ব্যবস্থা হয় ভারতে। তারপর ব্রিটিশরা এই দেশের ক্ষমতায় এলে ১৮৫৪ সালে বড়লাট লর্ড ডালহৌসি প্রথম ভারতে আধুনিক ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করেন। বর্তমানে এই বিভাগ ভারতের কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রকের অধীনে কার্যরত। সমগ্র ভারতে খুব নিপুণ বিন্যাস ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ডাকব্যবস্থা বন্টিত। তবে শুধুই চিঠিপত্র আদানপ্রদান নয়, মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প, জীবন বীমা প্রকল্পও চলে এই ডাকব্যবস্থার অধীনে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থাটিও অনেকাংশে এই ডাকবিভাগের মাধ্যমেই করা হয়ে থাকে। ভারতের ডাকবিভাগের এই ঐতিহ্য এবং এই বহুধাবিস্তৃত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করতেই প্রতি বছর ১০ অক্টোবর তারিখে সারা ভারত জুড়ে পালন করা হয় জাতীয় ডাক দিবস। তবে শুধুই ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক স্তরে ৯ অক্টোবর দিনে পালন করা হয় ডাক দিবস। প্রাচীনকালের মন্থর চিঠি বিনিময় ব্যবস্থাকে আরো সবল ও উন্নত করে তোলার জন্য ১৮৭৪ সালে ৯ অক্টোবর সুইজারল্যাণ্ডে তৈরি হয় ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (Universal Postal Union) যা ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের বহু শাখা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। তাদের মধ্যে টোকিও শাখাটি ঐ ৯ অক্টোবর দিনটিকে বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেয়। ঠিক এইরকম ভাবেই ভারতেও ১০ অক্টোবর দিনটিকে জাতীয় ডাক দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
এই দিনে ডাকবিভাগ নানাবিধ ডাকটিকিটের প্রদর্শনী আয়োজন করে। সাধারণ মানুষ সেইসব দুর্লভ ডাকটিকিট দেখার অবকাশ পায় বিশেষ এই দিনে। দেশের বিভিন্ন পোস্ট অফিসে এইদিন নানা সভা, বিতর্ক, কর্মশালা উদযাপিত হয়। ডাক সংগ্রহশালাগুলিতে বহু মানুষ এইদিন ভারতীয় ডাকবিভাগের গৌরবময় অতীত ইতিহাসের নানা দিক দেখার সুযোগ পায়, এই দিন নানা জায়গায় তথ্যচিত্রও দেখানো হয়ে থাকে। বিশ্ব ডাক দিবস পালনের উপলক্ষে এইদিন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চিঠি লেখার প্রচলন বাড়াতে অনেক কর্মশালা আয়োজন করে থাকে ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন।