বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস

২৫ এপ্রিল | বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ওই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে এসমস্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বে পালনীয় সেই সমস্ত দিবস গুলির মধ্যে একটি হল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস (World Malaria Day)।

প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল দিনটিকে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ম্যালেরিয়া সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সমগ্র বিশ্বে এই দিনটি পালন করা হয়।

২০০৭ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization, WHO) এর ৬০তম সভায় বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মূলতঃ ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলাই এই দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। সারা বছর ধরে ম্যালেরিয়া নির্মূল করার কর্মসূচী গ্রহণ, ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং এই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই দিনটি পালন করা হয়।

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পালনের আগে ‘আফ্রিকা ম্যালেরিয়া দিবস’ পালিত হত ২৫ এপ্রিল। ২০০১ সাল থেকে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০০০ সালে ঐতিহাসিক ‘আবুজা ডিক্লারেশন’-এ আফ্রিকার চুয়াল্লিশটি ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা সামিল হয়। ২০০৭ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৫ এপ্রিল দিনটিকে তাই বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস হিসেবে গ্রহণ করে।

ম্যালেরিয়া শব্দটির অর্থ হল ‘দূষিত বায়ু’। আগেকার দিনের মানুষ মনে করত যে দূষিত বায়ু সেবনে এই রোগ হয়। অনেকে মনে করেন ফ্রান্সিসকো টোর্টি (Francesco Torti) প্রথম ম্যালেরিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন কিন্তু তাঁর আগেও এই শব্দটি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। বরং টোর্টির উল্লেখযোগ্য কাজ হল, ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় সিঙ্কোনা গাছের ছালের প্রয়োগ। ১৮৮০ সালে চার্লস ল্যাভেরণ প্রথম ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে এককোষবিশিষ্ট পরজীবী প্রোটোজোয়াকে চিহ্নিত করেন।১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে ১৯০২ সালে তাঁকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘নোবেল’ পুরস্কার দেওয়া হয়। এই মশার কামড়ের ফলে মানুষের দেহে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়।এই রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে প্রধান হল জ্বর এবং মাথা ব্যথা। কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে এবং পরিশেষে মৃত্যু হয়। এ রোগে সাধারণত নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। এই সময় দেহের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।এছাড়াও প্রচন্ড গা হাত পা ব্যথা, বমি বমি ভাব, হজমের গোলযোগ, ক্লান্তি, যকৃৎ ও প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি অনেক উপসর্গ দেখা দেয়। ‘ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া’ হল ম্যালেরিয়ার জটিলতম ধরণ। ম্যালেরিয়ার লক্ষণ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের জটিলতা এক্ষেত্রে দেখা যায়। এতে অনেক সময় রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।

গ্লোবাল ম্যালেরিয়া অ্যাকশন প্ল্যান ( GMAP) ম্যালেরিয়া মুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য প্রথম একটি খসড়া তৈরি করে। জি.এম.এ.পি এই ব্যাপারে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং এই পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় হতে পারে, সে ব্যাপারেও আলোকপাত করে। জি.এম.এ.পি -র পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত করার ফলে সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সমগ্র বিশ্বে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে গেছে এবং ২০১৫ সালে তা ৭৫ শতাংশ কমেছে। সঠিক চিকিৎসা এবং কিছু প্রতিষেধক ব্যবস্থা যেমন – মশারি ব্যবহার করা, মশা নিরোধক মলম ও স্প্রে ব্যবহার করা এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রভৃতি নিয়ম মেনে চললে ম্যালেরিয়া রোধ করা সম্ভব।

২০০৮ সাল থেকে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয়। প্রথম বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসে ইউনাইটেড নেশনস ‌এর সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন ম্যালেরিয়া দূরীকরণের জন্য ওষুধ, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সুযোগ-সুবিধা এবং প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী প্রভৃতি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। প্রত্যেক বছর এই দিবসটি পালনের জন্য একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা‌ থিম নির্বাচন করা হয়। এছাড়াও কিছু প্রয়োজনীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে, ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণার ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রতিটি দেশেই এই দিনটিতে বিভিন্ন কম্পানি, প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্য দপ্তর, স্বাস্থ্যকর্মীরা এই দিনটিতে ম্যালেরিয়া নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন লক্ষ্যপূরণের নীতি গ্রহণ করে ও জনসচেতনতা গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

প্রত্যেক বছরই এই দিনটি বিশ্বজুড়ে একটি নির্দিষ্ট থিম বা প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – আমার থেকেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ শুরু হোক। (Zero malaria starts with me)। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – ম্যালেরিয়া রোগের বোঝা কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে উদ্ভাবনী শক্তির ব্যবহার। (Harness innovation to reduce the malaria disease burden and save lives)। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য – ম্যালেরিয়ার প্রকোপ শূন্যে নামিয়ে আনা: এই লক্ষ্যে বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং তাকে কার্যকর করুন (Time to deliver zero malaria: invest, innovate, implement)। ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য – স্বাস্থ্য সমতা, লিঙ্গ এবং মানবাধিকার (Health Equity, Gender and Human Rights)

3 comments

আপনার মতামত জানান