প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ(Prasanta Chandra Mahalanobis) একজন খ্যাতনামা ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁকে ভারতে আধুনিক পরিসংখ্যানের জনক বলা হয়।’প্রফেসর মহলানবীশ’ নামেই  দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে আছেন৷ 

১৮৯৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন প্রবোধ চন্দ্র মহলানবীশ৷ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় কলকাতার ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে। এরপরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। যেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বোস, এবং প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সহ অন্যান্য নামী ব্যক্তিত্ব। ১৯১২ সালে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন । ১৯১৩ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য ইংল্যান্ড যান। সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ট্রাইপোস(Tripos) সম্পন্ন করেন৷ 

মহলানবীশের কর্মজীবন শুরু হয় ইংল্যান্ডে। পড়াশোনা শেষ হলে তিনি  সি.টি.আর উইলসনের সঙ্গে ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরি (Cavendish Laboratory) তে কাজ করেন। অল্পদিনের ছুটিতে তিনি ভারতে ফিরে এলে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং অধ্যক্ষের আমন্ত্রণে ১৯২২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে তিনি যোগ দেন৷ এখানে এসে প্রশান্ত চন্দ্র মহালানবীশ বায়োমেট্রিকা জার্নাল নিয়ে চর্চা শুরু করেন। এই জার্নাল তাঁকে এত আগ্রহী করে তুলেছিল যে তিনি এই জার্নালের গোটা সেটটাই কিনে নিয়েছিলেন। তিনি আবহাওয়া ও নৃবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানে পরিসংখ্যানের উপযোগিতা আবিষ্কার করেছিলেন এবং সেই বিষয়ে কাজ করতেও উদ্যোগী হন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের স্ট্যাটিস্টিকাল ল্যাবরেটরিতে তিনি কয়েকজনকে নিয়ে একটি দল গড়ে তুলেছিলেন। এই  দল পরিসংখ্যান নিয়ে পর্যালোচনা  করত৷  এই উদ্যোগে তাঁর অনেক সহকর্মী আগ্রহী হয়েছিলেন৷ ১৯৩১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্রমথনাথ ব্যনার্জী, নিখিল রঞ্জন সেন, স্যার আর.এন মুখার্জিকে নিয়ে একটি বৈঠক ডাকেন৷ তাঁদের সম্মিলিত মতে বরানগরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠে ১৯৩২ সালের ২৮ এপ্রিল যার রেজিস্ট্রেশন হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের একচিলতে ঘর থেকে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে এটি বনহুগলির ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষিত হয়ে- ক্রমে মহীরুহ  হয়ে উঠেছে আইএসআই(ISI)।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৩৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানে একটি প্রশিক্ষণ বিভাগ শুরু হয়৷ অধ্যাপক মহলানবীশ জে.বি.এস হ্যালডেন (J. B. S. Haldane) কে আই এস আই এ গবেষক অধ্যাপক( Research Professor) হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান৷ ১৯৫৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত হ্যালডেন আইএসআই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এই আইএসআই-এর ভূবিদ্যা বিভাগের এক যুগান্তকারী সাফল্য  হল ১৯৬১ সালে এখানকার গবেষকরা গোদাবরী উপত্যকায় খনন করে ১৬০ মিলিয়ন বছর আগেকার ডাইনোসরের কঙ্কালের জীবাশ্ম খুঁজে পান৷  সেই ডাইনোসরটির পা ছিল বেশ বড়।  আর সেই বছর ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী। তাই সেই জীবাশ্মের নাম দেওয়া হয় ‘বড়পাসরাস টেগোরি’। আজও আইএসআই-এর অন্যতম প্রধান দর্শনীয় বস্তু ডাইনোসরটি।

বর্তমানে ভারতে যে ক’টি প্রতিষ্ঠানে বিশ্বমানের বিদ্যাচর্চা চলছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার স্বীকৃতি রয়েছে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৩৩ সালে ইনস্টিটিউটটি কার্ল পিয়ারসনের বায়োমেট্রিকা সম্পর্কে বেশ কিছু জার্নাল প্রকাশ করে।

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের অন্যতম কৃতিত্ব হল মহালানোবীশ দূরত্ব ( Mahalanobis distance) আবিষ্কার। এছাড়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির মধ্যে অন্যতম হল বড় আকারের নমুনা সমীক্ষা(large-scale sample surveys) । তিনি পাইলট সমীক্ষার ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন৷ পরবর্তী জীবনে প্রশান্ত চন্দ্র মহালানবীশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন৷ সদ্য স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি দ্বি-সেক্টরের মডেলের ভিত্তিতে শিল্পায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর তৈরী করা ওয়্যাসিলি লিওন্টিফের ইনপুট-আউটপুট মডেলের রূপটি দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নিযুক্ত হয়েছিল, যা ভারতের শিল্পায়নকে দ্রুত করেছিল৷

ইন্টারনেটহীন সেই যুগে বিজ্ঞান-চেতনা বিস্তারে কনফারেন্সের প্রভাব অনুভব করে ১৯৩৮ সালে ভারতে রাশিবিজ্ঞানের প্রথম কনফারেন্সের আয়োজন করেছিলেন প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ। ঠিক তার চার বছর পরে প্রশান্তচন্দ্রের উদ্যোগেই ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় গণিত এবং রাশিবিজ্ঞান বিষয় দুটি। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সঙ্গে অধ্যাপক মহলানবীশয়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে ১৯৬১ সালে অনুষ্ঠিত পরিষদের ত্রয়োদশ বার্ষিকীতে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ সভাপতি হিসেবে বক্তৃতা দেন৷ বলাবাহুল্য তাঁর ভাষণ সেখানকার বিদ্যানুরাগীদের যথেষ্ট প্রেরণা জুগিয়েছিল৷ ১৯৫০ সালে ভারতে প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার আনার প্রচেষ্টায় প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷  তাঁর এই প্রচেষ্ঠা জাতিকে যে কয়েক পা এগিয়ে দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছ’দশক আগেই উন্নত গণনার প্রয়োজনে আইএসআই আমদানি করে ফেলেছিল ভারতের প্রথম কম্পিউটার। প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেক্রেটারি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।  বেশ কিছুদিন তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯১০ সালে। তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল৷ ১৯২৬-এ ইউরোপ সফরে সস্ত্রীক প্রশান্তচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গী হন।

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ  নৃতত্ত্ব,ভাষা চর্চা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বড় নমুনা জরিপ, প্ল্যানিং, কৃষি, জাতীয় আয়, তথ্যপ্রযুক্তি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, সমাজবিদ্যা, জেনেটিক্স- প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর অবদান রেখে গেছেন৷ বিজ্ঞান এবং দেশের সেবায় অবদানের জন্যে ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার থেকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার পদ্মবিভূষণে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশকে সম্মানিত করেন ৷ বিজ্ঞান-সাধনা আর দেশসেবা তাঁর জীবনব্যাপী কর্মের অঙ্গ ছিল৷ দুইয়ের দশকে রাশিবিজ্ঞানের সাহায্যেই উড়িষ্যার বন্যার কারণ নির্ধারণ করার মতন পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন। ভারতে এক পরিণত রাশিবিজ্ঞানের কালচার তৈরি করেছিলেন তিনি ।  ১৯৩৫ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন৷ ১৯৫৭ সালে স্যার দেবীপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক, ১৯৬৮ সালে শ্রীনিবাস রামানুজন স্বর্ণপদক তিনি পেয়েছিলেন৷  মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি ও ডিরেক্টর ছিলেন। তিনি ভারত সরকারের মন্ত্রিসভার সম্মানিত পরিসংখ্যান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালনে সক্রিয় ছিলেন।২০০৬ সালের ২৯ জুন তাঁর জন্মদিনটিকে ভারত সরকার  জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ জুন ২০১৮ সালে তাঁর ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি এম ভেঙ্কাইয়া নাইডু কলকাতার আইএসআইতে একটি প্রোগ্রামে একটি স্মরণীয় মুদ্রা প্রকাশ করেছিলেন৷ 

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের ২৮ জুন ১৯৭২ সালে মৃত্যু হয়। 

তথ্যসূত্র


  1. https://en.m.wikipedia.org/
  2. https://www.britannica.com/
  3. https://eisamay.indiatimes.com/
  4. https://www.anandabazar.com/
  5. জ্ঞান ও বিজ্ঞান - ১৯৭২ ডিসেম্বর দ্বাদশ সংখ্যা।

One comment

আপনার মতামত জানান