সববাংলায়

মোহিতলাল মজুমদার

মোহিতলাল মজুমদার (Mohitlal Majumdar) বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতনামা বাঙালি কবি এবং সাহিত্য সমালোচক যিনি জনমানসে ‘দেহবাদী’ কবি হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলেছিলেন। মোহিতলাল মজুমদার সম্পূর্ণরূপে রবীন্দ্র-বিরোধী কবিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত না হলেও, তাঁর কাব্যের আদর্শ রবীন্দ্রনাথের থেকে ভিন্ন। মোহিতলাল মজুমদারের গভীর বিশ্লেষণ, ভাবগম্ভীর ভাষা এবং মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে সাহিত্যজগতে স্মরণীয় করে রেখেছে।

১৮৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কাঁচরাপাড়া গ্রামে জন্ম হয় মোহিতলাল মজুমদারের। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার এবং মায়ের নাম হেমমালা দেবী। নন্দলাল মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রামে। মোহিতলাল মজুমদার বলাগড়েই তাঁর কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন কাটিয়েছিলেন। কাঁচরাপাড়ার কাছে হালিশহরে তিনি তাঁর ছোটবেলা কাটিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য। এখানে ছিল তাঁর মায়ের মামার বাড়ি।

মোহিতলালের প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পূর্ণ হয়েছিল বলাগড় বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯০৪ সালে। তারপর ১৯০৮ সালে কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাশ করেন। এম.এ পড়া শুরু করলেও কোনো এক অজ্ঞাত সমস্যার কারণে পড়া শেষ করতে পারেননি, মাঝপথে ছেড়ে দেন।

মোহিতলাল মজুমদারের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯১০ সালে কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদের চাকরি পান তিনি। টানা তিন বছর এই পদে চাকরি করার পর আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসেন মোহিতলাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন ১৯২৮ সালে এবং অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৪৪ সালে। এরপর কলকাতায় ফিরে বঙ্গবাসী কলেজের গিরিশ-সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন তিনি।

সাহিত্য-সাধনার অঙ্গনে ‘মানসী’ পত্রিকার হাত ধরে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয়। যদিও পরে ‘ভারতী’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘কল্লোল’ পত্রিকাতেও তিনি বহু কবিতা-প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘বীরভূমি’ পত্রিকাতে তাঁর কবিতা প্রবন্ধ এবং অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলিতে তারুণ্যের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা,বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। অনেকে বলেন তাঁর কবিতায় আধ্যাত্মিক ভাবের কথা, তবে এই আধ্যাত্মিক মতবাদটি খুব স্পষ্ট নয়, বেদান্তের সঙ্গে বৈষ্ণবতত্ত্বের সমন্বয়সাধনের চেষ্টা মাত্র। মোহিতলাল কাব্যের আদর্শের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ভোগবাদী, দেহবাদী কবি। দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা থাকায় প্রথমদিকে তাঁর কবিতায় দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আবার আরেক রবীন্দ্র-অনুসারী কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছন্দ-মাধুর্যে তিনি মুগ্ধ ছিলেন। মোহিতলাল মজুমদার যেমন কিছুকাল ‘ভারতী’ পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তেমনই শনিবারের চিঠি পত্রিকার ‘শনিচক্র’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর সমালোচনামুলক প্রবন্ধগুলিতে তিনি নানাবিধ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন যেমন- কৃত্তিবাস ওঝা, সব্যসাচী, সত্যসুন্দর দাস ইত্যাদি। প্রথম দিকে ভারতী পত্রিকায় লেখালিখি করলেও এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-অনুসারী কবিরা যে রোমান্টিকতার মোহ-মদির সাধনায় লিপ্ত ছিলেন, মোহিতলাল তার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। নতুন কালের বাস্তবতার ছোঁয়া দেখা গেল তাঁর লেখায়। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম এক পালাবদল সূচিত করেছি কল্লোল সাহিত্য পত্রিকা। এই পত্রিকার দেহকেন্দ্রিক প্রেমভাবনার অনুপ্রেরণা ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। কল্লোল যুগ গ্রন্থে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত মোহিতলাল মজুমদারকে ‘আধুনিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আবার কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন – “আমাদের তরুণ বয়সে যখন রবিদ্রোহিতার প্রয়োজনীয় ধাপটি আমরা পার হচ্ছিলাম তখন যে দুজন কবিকে আমরা তখনকার মতো গত্যন্তর খুঁজে পেয়েছিলাম, তাঁদের একজন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং বিস্মরণী-র মোহিতলাল।” কিন্তু বাংলা কাব্যে দেহবাদের প্রবক্তা হয়েও মোহিতলাল কিন্তু যাযাবরী উদ্দামতাকে প্রশ্রয় দেননি। কল্লোল-এর কবিদের কাছে তিনি ছিলেন দ্রোণাচার্য। তবু কল্লোলগোষ্ঠীর নিরাশাবাদী চেতনা এবং আদিম রিপুর উল্লাসের সঙ্গে মেলাতে পারেননি মোহিতলাল।

আরও পড়ুন:  হটু বিদ্যালঙ্কার

মোহিতলালের সাথে বাদুড়বাগান লেনের মেসে পরিচয় হয়েছিল নজরুল ইসলামের। সেই পরিচয়ের সূত্র ছিল মোসলেম ভারত-এ প্রকাশিত মোহিতলালের একটি চিঠি। তাতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার প্রশংসা করেছিলেন মোহিতলাল। নজরুলের কাব্যকৃতির সম্ভাবনা বুঝতে পেরে মোহিতলাল তাঁর গুরুর আসন নেন। গুরু-শিষ্যের এক মধুর সম্পর্ক শুরু হয়। নজরুলই তখন মোহিতলালকে কল্লোল-এ নিয়ে আসেন। কল্লোল পত্রিকার আড্ডায় মোহিতলাল দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতা অসাধারণ আবৃত্তি করতেন বলে জানা যায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কল্লোল যুগ গ্রন্থ থেকে। কল্লোল-এ মাত্র বছরখানেক থাকলেও কিছু বিশেষ লেখেননি কখনো। পরে কল্লোলের সঙ্গ ত্যাগ করার পর কল্লোল-এ লিখলেন ‘পান্থ’ ও ‘প্রেতপুরী’ কবিতাদুটি। এই কল্লোলগোষ্ঠীর কয়েকজন যখন স্বতন্ত্র হয়ে প্রকাশ করেন ‘কালি-কলম’, তখন এঁদের সঙ্গেও মোহিতলালের যোগাযোগ তৈরি হয়। মোহিতলাল মজুমদারের মোট ১৭টি রচনা কালি-কলম-এ প্রকাশ পেয়েছিল মোট দুই বছরে। কবিতাগুলি ছিল – নাগার্জুন, তীর্থ-পথিক, নারী-বন্দনা, গদ্য ও পদ্য, ঘর-উদাসী, সৃষ্টির আদিতে, বিদায়-বাদল ইত্যাদি। এই কল্লোল পত্রিকার ইতিহাসে মোহিতলাল-নজরুল বিরোধের কাহিনি একই সঙ্গে মর্মান্তিক এবং বিস্ময়কর। গুরু শিষ্যের সম্পর্কের শুরুর দিকে মোহিতলাল মানসী পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘আমি ‘শীর্ষক কবিতাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন নজরুলকে। পরে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পরে আমি-র সঙ্গে বিদ্রোহী-র ভাবগত ও বাক্যগঠনগত সাদৃশ্য দেখা যায়। মোহিতলাল মনে করলেন গুরুর কাছে কোনো ঋণ স্বীকার করেননি নজরুল। তাঁর এই গোপন রাগের কারণ জানতেন নজরুল। শনিবারের চিঠি পত্রিকা নজরুলকে আক্রমণ করে তাঁর নতুন নামকরণ করে গাজী আব্বাস বিটকেল। এর কিছুদিন বাদে সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠির অক্টোবর, ১৯২৪ সংখ্যায় বেনামে প্রকাশ করলেন নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি ‘ব্যাঙ’। প্যারোডিটি পড়ে গুরুর রাগের কথা মনে করে নজরুল ভাবলেন এর লেখক হলেন স্বয়ং মোহিতলাল। তীব্র ক্ষোভে তিনি গুরু মোহিতলালকে লক্ষ করে লিখলেন সর্বনাশের ঘন্টা কবিতাটি যা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতার শেষ দুটি পংক্তি ছিল এইরকম – “আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস / ততদিন গুরু সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!”। কিন্তু আসলে মোহিতলাল প্যারোডিটি লেখেননি। তবু নজরুল শিষ্য হয়ে যে মোহিতলালকে ভুল বুঝলেন তা চরম পরিণতি ঘনিয়ে তুললো। মোহিতলাল নজরুলকে প্রতি-আক্রমণ করে শনিবারের চিঠিতে জবাব দিয়েছিলেন দ্রোণ-গুরু কবিতা লিখে – “গুরু ভার্গব দিল যা তুহারে! – ওরে মিথ্যার রাজা! / আত্মপূজার ভণ্ড পূজারী! যাত্রার বীর সাজা / ঘুচিবে তোমার,…।” এভাবে দুই প্রথিতযশা কবির ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে, বাংলা সাহিত্যে এ এক বিয়োগান্তক ঘটনা।

আরও পড়ুন:  মারাদোনা

মোহিতলাল মজুমদার কবিতার ভাবানুষঙ্গ এবং রূপনির্মিতিতে ছিলেন ক্লাসিক-পন্থী। তাঁর কবিতায় কাম দেহকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু এমিল জোলার ন্যাচারালিজম (Naturalism), লরেন্সের যৌনতা এবং ঈডিপাসের তত্ত্ব, লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার-এর সংস্কার মুক্তির ভাবনার থেকে মোহিতলালের কাব্যের আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা কবিতায় আরবি-ফার্সি শব্দের সার্থক প্রয়োগে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। ইংরেজি সাহিত্যেও তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। বাংলা ছন্দ-অলঙ্কার বিষয়ে তাঁর গভীর অনুধ্যান ও ব্যুৎপত্তি ছিল। ১৯৪৫ সালে বাঙলা কবিতার ছন্দ নামে তিনি একটি বই লেখেন যেখানে তাঁর ছন্দ-ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে।

মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যগ্রন্থগুলি হল যথাক্রমে দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯২২), স্বপন পসারী (১৯২২), বিস্মরণী (১৯২৭), স্মরগরল (১৯৩৬), হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১), ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১)। তাঁর প্রথম কাব্য দেবেন্দ্র-মঙ্গল ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের বিষয়ে প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সংকলন। আর শেষ কাব্যগ্রন্থ ছন্দ চতুর্দশী ৫৪টি সনেটের সংকলন। তাঁর অন্যান্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থগুলি হল – আধুনিক বাংলা সাহিত্য  (১৯৩৬), সাহিত্যকথা  (১৯৩৮), বিবিধ কথা  (১৯৪১), বিচিত্র কথা  (১৯৪১), সাহিত্য বিতান  (১৯৪২), বাঙলা কবিতার ছন্দ  (১৯৪৫), বাঙলার নবযুগ  (১৯৪৫), জয়তু নেতাজী  (১৯৪৬), কবি শ্রীমধুসূদন  (১৯৪৭), সাহিত্য বিচার  (১৯৪৭), বঙ্কিমবরণ  (১৯৪৯), রবি-প্রদক্ষিণ (১৯৪৯), শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র (১৯৫০), জীবন জিজ্ঞাসা (১৯৫১), বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫১), কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য  (প্রথম খণ্ড ১৯৫২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩), বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস (১৯৫৫), বঙ্কিম বরণ (১৯৪৯)।

১৯৫২ সালের ২৬ জুলাই মোহিতলাল মজুমদারের মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. , কল্লোলের কাল: জীবেন্দ্র সিংহ রায়, দেজ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০০৮, কলকাতা, পৃ ৪৪, ৪৫, ৯২, ১৫৯
  2. http://bn.wikipedia.org/
  3. http://www.sahos24.com/
  4. https://www.newsg24.com/

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন