ভারতবর্ষে নারীশিক্ষার দীর্ঘ উত্থানপতনময় সংগ্রামপূর্ণ ইতিহাসে যে সমস্ত মহিয়সী রমণীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে, হটু বিদ্যালঙ্কার (Hotu Vidyalankar) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে নারীশিক্ষা যে বিধিনিষেধ এবং কুসংস্কারের গহিন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে ছিল, হটু বিদ্যালঙ্কারের মত রমণীরা ছিলেন তৎকালীন সেই সমাজের বুকে এক আলোকবর্তিকা স্বরূপ। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত মানুষেরাই কেবল সংস্কৃত শিক্ষার অধিকারী ছিলেন। এমনই এক সমাজব্যবস্থার বুকে দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত না হয়েও হটু বিদ্যালঙ্কার সংস্কৃত শাস্ত্র কেবল অধ্যয়নের পাশাপাশি রীতিমতো সংস্কৃত পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। কেবলমাত্র সংস্কৃত ব্যাকরণ, নব্যন্যায় বা অলঙ্কারশাস্ত্রই নয়, তিনি চরক সংহিতার মতো আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রেও অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি পুরুষ পণ্ডিতদের মত বেশভূষা পরিধান করতেন, মাথা কামিয়ে টিকিও রেখেছিলেন এবং উপবীতও ধারণ করেছিলেন। কাশীতে গিয়ে দণ্ডীর মত পণ্ডিতদের কাছেও শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন হটু বিদ্যালঙ্কার। তিনি সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য নিজের আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তাঁদের চিকিৎসা করতেন। বহু কবিরাজ তাঁর কাছে বিনা দ্বিধায় শলা-পরামর্শের জন্য আসতেন।
১৭৭৫ সালে বর্ধমান জেলার কলাইঝুটি গ্রামে এক মধ্যবিত্ত অব্রাহ্মণ পরিবারে হটু বিদ্যালঙ্কারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা নারায়ণ দাস ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বিষ্ণুভক্ত এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল সুধামুখী। হটু বিদ্যালঙ্কার তাঁর আসল নাম নয়। বাবা-মা তাঁর নাম রেখেছিলেন রূপমঞ্জরী। অনেকগুলি সন্তানের মৃত্যুর পরে অবশেষে সুধামুখী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যেহেতু এক মড়াঞ্চে (যে-মহিলার সন্তান বাঁচে না) মায়ের কন্যা তাই রূপমঞ্জরীর নাম হয় হটু। বালিকা অবস্থাতেই মাতৃহারা হয়ে পড়েন হটু। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাই ছিল তাঁর সমস্ত সুখ-দুঃখের আশ্রয়। নারায়ণ দাস প্রায় মাতৃস্নেহেই মানুষ করেছিলেন তাঁকে। যেহেতু বার্ধক্যকালে স্ত্রী-পুত্রের অবলম্বন ছিল না, তাই নারায়ণ দাস কন্যাকে নিয়েই সময় কাটাতেন। নিজেও তিনি কিছু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন।
কন্যাকে একসময় লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেন নারায়ণ। ছোটবেলা থেকেই মেয়ে যে আর পাঁচজনের তুলনায় আলাদা তা লক্ষ্য করেছিলেন নারায়ণ দাস এবং হটুর ব্যতিক্রমী বুদ্ধিমত্তাও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। যা কিছু তিনি শিক্ষা দিতেন, সবই খুব সহজে অল্প সময়েই বুঝে ফেলত হটু। ফলে সেই নারীশিক্ষাবর্জিত এবং নারীশিক্ষা সংক্রান্ত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজের বুকে দাঁড়িয়েও নারায়ণ দাস দুঃসাহসিক এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও এইরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল এক আশ্চর্য কারণে। যে সমাজ নারীশিক্ষার উপরে হাজার বিধিনিষেধ জারি করে রেখেছিল এবং লেখাপড়া করলে রমণীরা অকাল বৈধব্যে পতিত হয়, এমন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সমাজের বাসিন্দা নারায়ণ দাসের আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশী হটুর বুদ্ধিমত্তা এবং বিদ্যার্জনে পারদর্শিতা লক্ষ্য করে পরামর্শ দিয়েছিল চতুষ্পাঠীতে হটুকে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য। এই ঘটনা সেই সমাজের প্রেক্ষিতে অবশ্যই আশ্চর্যজনক। প্রথমে নারায়ণ দাস হটুকে গুরুগৃহে রেখে বিদ্যাচর্চা করাবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। যখন হটুর বয়স ষোলো-সতেরো হবে, তখন স্থানীয় এক বৈয়াকরণিক পণ্ডিতের বাড়িতে তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নারায়ণ। সেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মন ছিল উদার, সংস্কারের বেড়াজালে তিনি কখনও আবদ্ধ রাখেননি নিজেকে। ফলে একজন অব্রাহ্মণ, তার উপর আবার নারী শিক্ষাগ্রহণের জন্য তাঁর কাছে এসেছে দেখেও তিনি বিমুখ হননি, বরং সাদরে আহ্বান জানিয়েছিলেন হটুকে। একপ্রকার পিতৃস্নেহেই তাঁকে শিক্ষাদান এবং যত্ন করতে থাকেন সেই ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের একটি টোল ছিল যেখানে সমস্ত ছাত্রদের সঙ্গে বসে একমাত্র নারী রূপমঞ্জরী ওরফে হটু বিদ্যালঙ্কার ব্যাকরণ অনুশীলন করতে থাকেন। এই ঘটনা সেই সমাজের প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। টোলে পুরুষ সহপাঠীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে রূপমঞ্জরীর মধ্যে একটি পুরুষালী ভাব গড়ে ওঠে যা আজীবন তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ছাত্রদের মতো চুল কেটে তিনি মাথার পিছনে শিখা বা টিকিও রেখেছিলেন। উপবীত ধারণ করে ধুতি, চাদর ইত্যাদি পরিধান হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন তিনি। আমৃত্যু বিবাহ করেননি তিনি, এমনই কুমারী অবস্থায় জীবনযাপন করেছিলেন। তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষী নয় এমন মানুষও কোনওদিন তাঁকে চারিত্রিক দোষত্রুটির অভিযোগে দুষ্ট করতে পারেনি।
গুরুগৃহে ব্যাকরণ, নবন্যায়, অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয় অধ্যয়ন করে রীতিমতো আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন রূপমঞ্জরী। তবে গুরুগৃহে বসবাসকালীন তাঁর বাবা নারায়ণ দাসের মৃত্যু হয়। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যথাযথরূপে সম্পন্ন করবার পরে তিনি পুনরায় ফিরে যান গুরুর কাছে। ব্যাকরণ-সহ উপরিউক্ত নানা বিষয়ের অধ্যয়ন শেষে সরগ্রামের বাসিন্দা গোকুলানন্দ তর্কালঙ্কারের কাছে প্রথমে সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন হটু বিদ্যালঙ্কার। সাহিত্য অধ্যয়নের পর্ব সম্পন্ন হলে হটু চলে গিয়েছিলেন গয়াতে বাবা-মায়ের নামে পিণ্ডদানের উদ্দেশ্যে। ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন রাশভারী এই শিখাধারী পুরুষবেশী পণ্ডিত রমণীকে সকলেই সমীহ করে চলত। কাশীর মতো পণ্ডিতদের পীঠস্থানে হটু বিদ্যালঙ্কার অনেকের কাছ থেকেই সম্মান লাভ করেন। সেখানে গিয়ে পণ্ডিত দণ্ডীদের কাছে নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন হটু। পণ্ডিত অধ্যাপকরা তাঁর অনবদ্য প্রতিভা দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন এবং এত ভাল ছাত্রী পেয়ে আগ্রহের সঙ্গে তাঁকে শিক্ষাদান করেছিলেন। কাশী থেকে নতুনতর শাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করে একপ্রকার পণ্ডিত হয়েই যখন দেশে ফিরে আসেন হটু বিদ্যালঙ্কার, তখন তাঁর নামের পাশে জ্ঞানবান ব্যক্তির মতো এক উপাধি জুড়ে গিয়ে তিনি ‘হটু বিদ্যালঙ্কার’ নামে পরিচিত হন। তখন থেকেই আজ অবধি সেই উপাধিযুক্ত নামেই তিনি পরিচিত সমস্ত দেশবাসীর কাছে।
দেশে ফিরে নিজে একটি টোল খুলে শিক্ষাদান করতে শুরু করেছিলেন হটু। তবে কেবল শাস্ত্র, অলঙ্কারাদি বিদ্যাচর্চায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। জ্ঞানভাণ্ডারের স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু মানব জীবনের আরও নিকটবর্তী হওয়া, তার সুখদুঃখের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য উন্মুখ ছিলেন তিনি। যতই পুরুষবেশ ধারণ করুন না কেন, তাঁর নারীহৃদয়ের কোমলতা এবং সহানুভূতি তাঁকে দরিদ্র মানুষের অসুখে-বিসুখে দুঃখী করে তুলত। তাঁদের যথাযথভাবে সেবা করবার উদ্দেশ্যে তিনি পুনরায় তাঁর সাহিত্যের শিক্ষক গোকুলানন্দ তর্কালঙ্কারের কাছে যান এবং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অধ্যয়ন শুরু করেন। চরক সংহিতা, নিদান ইত্যাদি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তিনি। চিকিৎসাশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে তিনি সাধারণ মানুষের চিকিৎসা শুরু করেন এবং প্রভূত খ্যাতি লাভ করেন। এভাবেই টোল চালানোর পাশাপাশি জনসেবার কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন হটু। এতই জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর যে, অনেকে তাঁর কাছে চরক সংহিতা অধ্যয়নের জন্য আসত। কখনও কখনও খুব নামজাদা কোনও কবিরাজও শলা-পরামর্শের জন্য হটুর কাছে এসে উপস্থিত হতেন অকুণ্ঠিত চিত্তে। হটু সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। পাশ্চাত্য চিকিৎসাপদ্ধতিতে দীক্ষিত বাংলার প্রথম নারী ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের ঠাকুমা একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ভীষণ। তাঁর প্রাণের আশা সকলেই প্রায় পরিত্যাগ করেছিলেন, এতটাই সংকটজনক ছিল বৃদ্ধার শারীরিক অবস্থা। সেসময় চিকিৎসক হটু বিদ্যালঙ্কারের ডাক পড়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে হটু বিদ্যালঙ্কার সে যাত্রায় বৃদ্ধার প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ঘটনার একটি জোরালো প্রভাব পড়েছিল কাদম্বিনীর বাবা ব্রজকিশোর বসুর মনে। সেই সমাজব্যবস্থার বুকে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব ঠিক কতখানি। মহিলাদের অসুখ-বিসুখে সেই রক্ষণশীল সমাজে যে একজন মহিলারই প্রয়োজন চিকিৎসার জন্য, তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ব্রজকিশোর। এই ঘটনার ফলেই পরবর্তীকালে কাদম্বিনীকে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার দিকে অগ্রসর হতে ভীষণ উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু।
নিজে বিবাহ করেননি হটু বিদ্যালঙ্কার, কিন্তু রাধারমণ দাস নামে একটি ছেলেকে পালকপুত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্ধকার সময়ে, নারীশিক্ষার বাধাবিপত্তির যুগে হটু বিদ্যালঙ্কার পথপ্রদর্শকের মত আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে বাংলাদেশের রমণীদের বিদ্যাচর্চার অনুপ্রেরণাস্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন বলা যায়। এক নারী প্রবল রক্ষণশীল সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে আজীবন কুমারী অবস্থায় থেকে বিদ্যাচর্চায় ডুবে থাকলেন, মানুষের সেবা করলেন নিরন্তর — গোঁড়া এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে তিনি যে এক মূর্তিমতি প্রতিবাদ তা আর বলে দিতে হয় না। ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত থাকবে সেকথাও বলাই বাহুল্য। তাঁর সমকালেই হটী বিদ্যালঙ্কার নামে আরেক সংস্কৃতজ্ঞ রমণীর কথা জানা যায়। যদিও হটী ও হটু বিদ্যালঙ্কার উভয়েই পৃথক ব্যক্তি।
হটু বিদ্যালঙ্কারের মতো প্রতিভা ইংরেজদের চোখ এড়ায়নি। ইংরেজ পণ্ডিতরা ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র ‘স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক’ পুস্তিকাতে তাঁর কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এছাড়াও ১৮৯০ সালের ‘সখা’ পত্রিকাতেও পাওয়া গেছে তাঁর উল্লেখ। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের লেখা ‘রূপমঞ্জরী’ উপন্যাসের একাংশে হটু বিদ্যালঙ্কারের জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে।
১৮৭৫ সালে (১২৮২ বঙ্গাব্দ ১৫ পৌষ) প্রায় একশ বছর বয়সে হটু বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- 'রূপমঞ্জরী' (দ্বিতীয় খণ্ড),নারায়ণ সান্যাল, দে'জ পাবলিশার্স, জানুয়ারি ২০০৬, পরিশিষ্ট অংশ
- 'সংসদ বাঙালী চরিতাবিধান',শ্রী সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (সম্পা:), সাহিত্য সংসদ, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা ৪৮৮
- https://www.anandabazar.com/
- https://banglanewsmag.blogspot.com/