আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত লেখক হলেন নারায়ণ সান্যাল । গল্পের প্লটের অভিনবত্বে এবং তার সাবলীল উপস্থাপনায় তিনি বাংলা সাহিত্যে এক চিরকালীন স্থান দখল করে রয়েছেন।
১৯২৪ সালের ২৬ এপ্রিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে নারায়ণ সান্যালের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম চিত্তসুখ সান্যাল এবং মায়ের নাম বসন্তলতা সান্যাল৷
নারায়ণ সান্যাল ম্যাট্রিক পাশ করেন আসানসোল ই.আই.আর বিদ্যালয় থেকে। স্কুলের খাতায় তাঁর নাম ছিল নারায়ণদাস সান্যাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি.এস সি নিয়ে স্নাতক হন৷ ১৯৪৮ সালে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি বি.ই.(B.E) সম্পন্ন করেন। তিনি ইন্সটিট্যুট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া)-এর ফেলো ছিলেন।
নারায়ণ সান্যালের কর্মজীবন শুরু হয় পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট থেকে৷ পরবর্তীকালে ন্যাশনাল বিল্ডিং অরগানাইজেশান-এও কর্মরত ছিলেন তিনি৷ তাঁর পরিচিতি মূলত লেখক হিসেবে হলেও পেশায় তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।
নারায়ণ সান্যালের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব মূলত তাঁর সাহিত্যকীর্তি৷ তিনি নানান বিষয়ের উপর প্রচুর বই লিখেছেন। তাঁর লেখনীর বিষয়বস্তুগুলি সাহিত্য ও সমাজের বিভিন্ন প্রান্তকে ছুঁয়ে যায়। তাঁর লেখার বিষয়ের মধ্যে শিশুসাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প ও স্থাপত্য, ভ্রমণ, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, শরণার্থী সমস্যা, ইতিহাস, জীবনী , প্রাণীদের বিশ্বকোষ, সামাজিক উপন্যাস এবং দেবদাসি সম্পর্কিত বেশ কিছু লেখা আমরা পাই৷ সমাজের গভীর অন্ধকার দিকগুলি তাঁর লেখায় অন্য মাত্রা পেয়েছে। তাঁর লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা’। প্রব্যাবিলিটি(Probability)’ বা সম্ভাব্যতার বিচারে আজ পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক বিরাট অংশ বিশ্বাস করেন যে বিপুলা এ বহির্বিশ্বে আমাদের মত এবং আমাদের থেকে বহু বহুগুণ উন্নত জীবেরা রয়েছে। তাদের নিয়েই এগিয়েছে গল্প৷ বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি অনুপ্রানিত হয়েছেন লেখক এরিক ভন দানিকেন এর দ্বারা৷
তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস হল ‘বিশ্বাসঘাতক’-এ স্থান পেয়েছেন পৃথিবীর বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকরা। সত্য ঘটনা আশ্রয় করে কল্পনার মিশেল ঘটিয়ে লেখকের কলম ঝলসে উঠেছে৷ হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পটভূমিতে এই গল্পটি লেখা হয়েছে। টানটান উত্তেজনার বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এক অসাধারন মিশেলে রচিত এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ।
নারায়ণ সান্যাল রচিত আরেকটি অনবদ্য বই হল ‘তিমি তিমিঙ্গল’। এই বইটিতে তিমিদের নিয়ে রয়েছে অসাধারণ গল্প, তাদের জন্ম, বড় হওয়া প্রেম বিবাহ এবং মানুষের মতন ভয়ঙ্কর জীবের জন্য তারা আজ লুপ্তপ্রায়৷ খুবই দক্ষতার সঙ্গে একটি বাস্তবচিত্র লেখক এঁকেছেন এই বইটিতে।
গোয়েন্দা কথাসাহিত্যের জগতে তাঁর লেখা ‘কাঁটা’ সিরিজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এই সিরিজের বেশিরভাগ গল্পই স্ট্যানলি গার্ডনার এবং আগাথা ক্রিস্টির বিভিন্ন বিদেশী উপন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। নারায়ণ সান্যাল রচিত ‘বিশুপালবধ উপসংহার’ মূলত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত লেখা ব্যোমকেশ বক্সি সিরিজের শেষাংশ৷
এছাড়া তাঁর লেখা অন্যান্য সাহিত্যকর্ম গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,’সত্যকাম’ যেটি নিয়ে পরবর্তী কালে হিন্দি সিনেমা হয়েছে৷ এছাড়াও তাঁর লেখা ‘নাগচম্পা’, ‘অশ্লীলতার দায়ে’, ‘নীলিমায় নীল’ ‘প্রশান্ত পন্ডিত’ প্রভৃতি গল্পগুলি নিয়েও বাংলা সিনেমা হয়েছে। তাঁর লেখা কিশোর সাহিত্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য ‘শার্লক হেবো’, ‘অরিগ্যামি’, ‘ডিসনিল্যান্ড’, ‘নাক উঁচু’, ‘হাতি আর হাতি’ ইত্যাদি৷ এছাড়া তাঁর লেখা অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘হে হংসবলাকা’, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’, ‘ অজন্তা অপরূপা’, ‘ভারতীয় ভাস্কর্যে মিথুন’, ‘ রূপমঞ্জরী’, ‘দণ্ডকশবরী’, ‘অন্তর্লীনা’, ‘মনামী’, ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’, ‘ সুতনুকা কোন দেবদাসীর নাম নয়’, ‘ মান মানে কচু’ প্রভৃতি৷ জীবনীমূলক লেখাও তিনি লিখেছেন যেমন, ‘আমি নেতাজিকে দেখেছি’, ‘আমি রাসবিহারীকে দেখেছি’, ‘লিন্ডবার্গ’ ইত্যাদি।
নারায়ণ সান্যাল তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন বহুবার৷ ১৯৯৯ সালে তাঁর লেখা বই ‘অপরূপ অজন্তার ‘ জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান । ২০০০ সালে’ রূপমঞ্জরী’ র জন্য তিনি বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর লেখা অন্যতম উপন্যাস ‘সত্যকাম’ এর জন্য তিনি বেঙ্গল ফিল্ম সাংবাদিকদের দ্বারা সেরা চলচ্চিত্র গল্প লেখক পুরস্কার পান৷
‘অমি নারায়ণ সান্যাল কে দেখেছি’ এই নামে তাঁর একটি জীবনীও আছে। লেখক প্রদীপ দত্ত।
২০০৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী নারায়ণ সান্যালের মৃত্যু হয়৷
আমার সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্যিক।