পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত উত্তর ২৪ পরগণা জেলার একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ হল হালিশহর (Halishahar)। KMDA এর অন্তর্ভুক্ত এই এই প্রাচীন মফঃস্বলটিকে ঘিরে উত্তরে চর নন্দনবাটি, চর কাঁচড়াপাড়া, পূর্বে কাঁচড়াপাড়া এবং নান্না, দক্ষিণে বালিভারা এবং নৈহাটি এবং পশ্চিমে হুগলী অবস্থিত। ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে হালিশহর ২২.৯৫° উত্তর অক্ষাংশ ৮৮.৪২° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাবর অবস্থান করছে।

হালিশহর একটি অত্যন্ত প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ শহর যা অতীত গৌরব বুকে নিয়ে নীরবেই দাঁড়িয়ে আছে। হালিশহর নামটির উৎপত্তি দেখলেই আমরা বুঝতে পারি এই শহর কতই না সমৃদ্ধশালী ছিল একসময়ে। বখতিয়ার খিলজীর শাসনকালে ‘হাভেলীশহর’ কথাটি থেকেই কালক্রমে হালিশহর নামটি এসেছে বলে মনে করা হয়। হাভেলী কথার অর্থ হল অট্টালিকা। অর্থাৎ কিনা অট্টালিকা সমৃদ্ধ যে নগরী। আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরীতে হালিশহরের নাম পাওয়া যায়। তবে এরও আগে গঙ্গা তীরবর্তী এই শহরের নাম ছিল কুমারহট্ট। মনে করা হয় এখানে একসময় কুমার অর্থাৎ কুমোর দের বিশাল হাট বসত সেখান থেকেই কুমার হাট যা ক্রমে কুমারহট্টে পরিণত হয়। সেন যুগেরও প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই শহরের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে।
এতো গেল নামকরণের ইতিহাস। এবার দেখি এই শহর আরও কি কি ভাবে ইতিহাস দ্বারা আষ্ঠে পৃষ্ঠে নিজেকে বেঁধে রেখেছে। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে হালিশহর নামটি প্রথম পাওয়া গেছিল।
এখানকার ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের জ্ঞানের খ্যাতি একসময় নবদ্বীপের সমান ছিল। এখানকার চৈতন্য ডোবা নামের পুকুরের ধরে শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী বসবাস করতেন। একসময় শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে এখানে বৈষ্ণব ধর্ম যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল।
এই শহর কেবল প্রাচীনত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত নয়, এই শহর অনেক প্রথিতযশা বাঙালির জন্মস্থানও বটে। অনেকেই হয়ত জানেন না, বিখ্যাত শ্যামাসংগীত গায়ক সাধক রামপ্রসাদ সেনের বাড়িও এখানেই ছিল। রামপ্রসাদ এই শহরেই ১৭২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রানি রাসমনীর জন্মস্থান ও এই শহর। এখনো এখানে এলে তাঁর বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এই শহরেই বসবাস করতেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী। বিপ্লবী বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায় এই শহরেরই সন্তান ছিলেন। বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি হিসেবে তিনি ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরই সংস্পর্শে এসে দেশপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেন সুশীলকুমার ঘোষ। সে সময়ে সুশীল ঘোষের নেতৃত্বে দলে দলে কংগ্রেস কর্মীরা ওই সভায় যোগ দেন। নেতাজিও এখানে মাঝে মাঝে আসতেন বলে জানা যায়। কাজি নজরুল ইসলামও হালিশহরে এসেছিলেন।
হালিশহর বরাবরই ধর্ম আর ইতিহাসকে একসাথে আঁকড়ে এগিয়ে চলেছে। এখানে কালী, মনসা, শীতলা, চড়ক ও বৃক্ষপূজার চল আছে বহুদিন ধরে। এখানকার প্রাচীন মন্দিরগুলির মধ্যে ‘পঞ্চরত্ন’ ও চারচালা মন্দিরের প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। এখানকার বিখ্যাত পূজার মধ্যে কালিকাতলার ‘জ্যাংড়া কার্তিক’ ও জেলেপাড়ার ‘ধুমো কার্তিক’ পূজা বেশ বিখ্যাত। এখানকার প্রাচীন পূজা গুলির মধ্যে খাসবাটির শ্যামাসুন্দরীর পূজা প্রায় তিনশো বছর প্রাচীন। এছাড়াও সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির যথেষ্ট বিখ্যাত। এই মন্দিরটি অসাধারণ কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত।এছাড়াও এখানকার নন্দকিশোর মন্দির যেটি ১৭৪৩ সালে জমিদার মদনগোপাল রায় প্রতিষ্ঠা করেন। অপূর্ব টেরাকোটা কাজ আছে মন্দিরটির স্থাপনরীতিতে।
হালিশহরের প্রাণকেন্দ্র হল হালিশহর রেলওয়ে স্টেশন। পূর্ব রেলওয়ে জোনের শিয়ালদহ রেল বিভাগের শিয়ালদহ – রানাঘাট রেলপথের একটি রেলওয়ে স্টেশন হল হালিশহর।
এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে- হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত ক্রেগ পার্ক, রামপ্রসাদ সেনের বাড়ি অন্যতম। ক্রেগ পার্ক থেকে হাঁটা পথে দশ মিনিট দূরে রামপ্রসাদের বাড়ি। রামপ্রসাদের স্মৃতি বিজড়িত সামগ্রী নিয়ে গড়ে উঠছে একটি মিউজিয়াম। এছাড়া রথতলা মন্দির বা শ্রী কৃষ্ণ জীউ মন্দির এখানকার অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। অধুনা হালিশহরের সবথেকে বড় আকর্ষণ মাঝ গঙ্গায় জেগে ওঠা চরে গড়ে ওঠা সবুজ দ্বীপ।
3 comments