পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সমাজে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও সমাজ সংস্কারের প্রাণপুরুষ হলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (Chaitanya Mahaprabhu)। তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঐক্য এবং সংহতি এনেছিলেন।
১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপ ধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জগন্নাথ মিশ্র ও মায়ের নাম শচীদেবী। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশের শ্রীহট্টের আদি বাসিন্দা। বাবা জগন্নাথ মিশ্র বেদ ও সংস্কৃত শাস্ত্র চর্চা ও প্রসারের উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে বসবাস শুরু করেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আসল নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র। নিম গাছের নীচে জন্মেছিলেন বলে তাঁর মা তাঁকে আদর করে ‘নিমাই’ বলে ডাকতেন। নিমাইয়ের দাদা বিশ্বরূপ মিশ্র সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। এক ছেলে আগেই সংসার ত্যাগী হয়েছে। শচীদেবী তাই চাইতেন তাঁর আদরের ‘নিমাই’ সংসারি হোক। নবদ্বীপের বাসিন্দা দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর সাথে নিমাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
নিমাইয়ের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় গঙ্গাদাস পন্ডিতের পাঠশালায়। পাঠশালায় পড়ার সাথে সাথে বাবার কাছে বাড়িতে সংস্কৃত চর্চা করতেন তিনি। সংস্কৃতে জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছোট বয়স থেকেই তিনি সংস্কৃত গ্রন্থ পাঠ, ব্যাকরণ শাস্ত্র, সংস্কৃত শ্লোক, পুঁথি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। হরিনাম কীর্তন ও বৈষ্ণব ধর্মেও তাঁর ছোট থেকেই আলাদা উৎসাহ বা টান ছিল। নবদ্বীপে আয়োজিত এক সংস্কৃত তর্কযুদ্ধে দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশবকাশ্মীরকে তিনি তর্কে পরাজিত করলে তাঁর নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কুড়ি বছর বয়সে নিমাই নবদ্বীপের বাড়িতে টোল স্থাপন করে সংস্কৃত ও ব্যাকরণের অধ্যাপনা শুরু করেন।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই নিমাই তাঁর পৈত্রিক ভিটে শ্রীহট্টে যান। এর মাঝেই সাপের কামড়ে লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হলে শচীদেবী নিমাইয়ের দ্বিতীয়বার বিবাহ দেন বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে। প্রথম স্ত্রীর পিন্ডদান করার জন্যে গয়ায় গিয়ে সেখানে নিমাইয়ের সাথে তাঁর মন্ত্র গুরু স্বামী ঈশ্বরপুরীর দেখা হয় এবং শ্রীচৈতন্য তাঁর কাছে গোপালরাজ মহামন্ত্রে দীক্ষিত হন। গুরুমন্ত্র লাভের পর নিমাইয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। টোলের অধ্যাপনা ছেড়ে নিমাই কৃষ্ণনাম ভজন শুরু করেন ও তাঁর মধ্যে কৃষ্ণভাবের এক আবেশ প্রকাশিত হয়। মাত্র ২৪ বছর বয়সে সংসার জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসী কেশব ভারতীর কাছে নিমাই সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস নেওয়ার পর নিমাই নাম পরিবর্তিত হয়ে তাঁর নাম হয় শ্রীচৈতন্য। খোল-করতাল সহকারে শ্রীচৈতন্য তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণপ্রেম প্রচার করতেন। এইভাবে শ্রীচৈতন্য নদীয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক দক্ষ নেতায় পরিণত হন। নবদ্বীপের অনেক মুসলমান শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণপ্রেমে আকুল হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে তাঁর প্রধান সেনাপতিরা ছিলেন নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীনিবাস, হরিদাস প্রমুখরা। এঁদের মধ্যে অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে শ্রীচৈতন্যের দুই অঙ্গ বলে মনে করা হয়। এঁদের দুইজনকে আলাদা আলাদা জায়গায় প্রচারের কাজে নিযুক্ত করে শ্রীচৈতন্য বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী নানা তীর্থস্থানে কৃষ্ণপ্রেম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন।
শ্রীচৈতন্য গবেষকদের মতে শ্রীচৈতন্য জীবনের শেষ আঠারো বছর, আবার কারো মতে চব্বিশ বছর উড়িষ্যার পুরীধামে অতিবাহিত করেন। উড়িষ্যার সূর্যবংশীয় রাজা প্রতাপরুদ্র শ্রীচৈতন্যকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার বলে মনে করতেন। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি কৃষ্ণভক্তিভাবে উদাস ও ভাবসমাধিস্থ থাকতেন। কারোর মতে কৃষ্ণপ্রেমে আপ্লুত হয়ে তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অন্তরেই বিলীন হয়ে যান। আবার কারোর মতে শ্রীকৃষ্ণ যমুনার জলে গোপীদের সাথে লীলাসাধন করছে এই দৃশ্য কল্পনা করে শ্রীচৈতন্য সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে কৃষ্ণপ্রেমে বিলীন হয়ে যান। শ্রীচৈতন্যের তথা নিমাইয়ের ১৫৩৩ সালের ১৪ জুন মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে আষাঢ় মাসে পুরীধামে মৃত্যু হয়। শ্রীচৈতন্যের ভাবধারা প্রসারিত করতে সম্প্রতি কলকাতার বাগবাজারে ১৬,০০০ বর্গফুট জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশ্বের প্রথম শ্রীচৈতন্য সংগ্রহশালা ।
মহাপ্রভুর জিবনি বিস্তারিত জানাতে চাই, দয়া করে লিখবেন