আর্কিমিডিস (Archimedes) একজন কালোত্তীর্ণ পদার্থবিজ্ঞানী তথা গণিতবিদ, ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্ভাবক যিনি মূলত ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ‘প্লবতার সূত্র’ আবিষ্কারের জন্য। পদার্থবিদ্যার জগতে ফলিত গণিতের ব্যবহার করা প্রথম পদার্থবিদ হলেন আর্কিমিডিস। ক্লাসিকাল বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ এবং পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিয়াসদের মধ্যে একজন হিসেবে তিনি গণ্য হয়ে থাকেন।
২৮৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে গ্রিসের সিসিলি দ্বীপের প্রাচীন শহর সাইরাকিউসে আর্কিমিডিসের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ফিডিয়াস। আর্কিমিডিস নিজেই তাঁর ‘স্যান্ড রেকনার’ (Sand-Reckoner) গ্রন্থে নিজের বাবাকে জ্যোতির্বিদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর্কিমিডিসের মা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। আর্কিমিডিসের বন্ধু গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী হেরোক্লাইড আর্কিমিডিসের জীবনী গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করলেও দুঃখের বিষয় সেই গ্রন্থ কোনভাবেই পরবর্তীকালে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আর্কিমিডিসের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া না গেলেও তবে জানা যায় যৌবনে তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে পড়াশুনা করেছেন। আর্কিমিডিস ছিলেন গণিতবিদ কনন অব স্যামসের ছাত্র যিনি ছিলেন আবার জ্যামিতির জনক ইউক্লিডের ছাত্র। এছাড়াও তৎকালীন বিভিন্ন গুণী পণ্ডিতদের সান্নিধ্য আর্কিমিডিসকে জ্ঞান আহরণে সাহায্য করেছিল।
আর্কিমিডিসের সময়ে গ্রিস পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় উদ্ভাবনী শক্তিতে ছিল অনেক এগিয়ে। যদিও গ্রিকদের উদ্ভাবনী প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা মেটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সেদিক থেকে আর্কিমিডিস ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। আর্কিমিডিসের সর্বাধিক জনপ্রিয় আবিষ্কার যার জন্য সারা পৃথিবী তাঁকে এক ডাকে চেনে তা হল- ‘প্লবতার সূত্র’ আবিষ্কার। সাইরাকিউসের রাজা হিয়েরোর জন্য লরেল পাতাকৃতি সোনার একটি মুকুট তৈরি করা হয়েছিল। মুকুটটি দেখে রাজা আর্কিমিডিসকে বলেন মুকুটটি না গলিয়ে অন্য কোন উপায়ে জানা সম্ভব কিনা মুকুটটিতে আসল সোনা কতটা আর খাদ কতটা মেশানো আছে। আর্কিমিডিস এই সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন স্নান করতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করেন তিনি বাথটাবের জলে নামা মাত্র বাথটাবের জলের উচ্চতা বেড়ে গেল। তিনি তখন বুঝতে পারেন যে জলের এই ধর্মকে ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহার করা সম্ভব। জল যেহেতু অসংকোচনশীল, তাই জলে মুকুট ডোবালে মুকুট তার আয়তনের সমান পরিমাণ জল অপসারণ করবে। এই অপসারিত জলের পরিমান দিয়ে মুকুটের ভরকে ভাগ করলে মুকুটে সোনার ঘনত্ব পরিমাপ করা সম্ভব। এখন মুকুটে ব্যবহৃত উপাদানে সোনার সাথে অন্য কোন কম ঘনত্বের ধাতু যোগ করা থাকলে তার ঘনত্ব খাঁটি সোনার ঘনত্বের তুলনায় অবশ্যই কম হবে। তাঁর আবিষ্কৃত এই নীতি তরল গতিবিদ্যায় ‘প্লবতার সূত্র’ বা এ নীতিই ‘আর্কিমিডিসের সূত্র’ নামে পরিচিত। জনশ্রুতি প্লবতার এই সূত্র আবিষ্কার করে আর্কিমিডিস এতটাই উত্তেজিত হয়ে গেছিলেন যে তিনি উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় “ইউরেকা” (গ্রিক শব্দ, যার অর্থ – “আমি পেয়েছি”) বলে চিৎকার করে দৌড়তে শুরু করেছিলেন।
কেবল সূত্র নয়, যুদ্ধে কার্যকরী সমরাস্ত্র সহ আরও অনেক প্রযুক্তিগত উন্নততর যন্ত্রও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ‘আর্কিমিডিস স্ক্রু’ নামে এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার সাহায্যে নিচের থেকে জল, বালি বা এরকম জিনিস সহজে উপরে তোলা যায়। ‘সাইরাকিউস’ নামক এক বিলাসবহুল বিশাল জাহাজের চুঁইয়ে পড়া জল নির্গমনের জন্য তিনি এই যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্র এখনকার দিনেও ব্যবহার করা হয়। আর্কিমিডিস সাইরাকিউস শহরকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘আর্কিমিডিসের থাবা’ বা’ দ্য ক্ল অফ আর্কিমিডিস’ তৈরি করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে বড় বড় জাহাজকে উল্টে দেওয়া যেত। এছাড়া আয়নার মাধ্যমে সূর্য রশ্মিকে আক্রমণকারী জাহাজের উপর কেন্দ্রীভূত করে তাতে আগুন জ্বালানোর কৌশলও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি হেলিওস্ট্যাট (heliostat) ও সোলার ফার্নেসে ব্যবহার করা হয়।
কেবল যন্ত্র আবিষ্কার নয়, পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্কিমিডিস তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আর্কিমিডিস নিজে লিভার আবিষ্কার না করলেও লিভারের কার্যনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তিনিই প্রথম করেন। প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ আলেকজান্দ্রিয়ার পাপ্পাসের মতানুযায়ী লিভারের মূলনীতি বোঝাতে গিয়ে আর্কিমিডিস নাকি বলেছিলেন, “আমাকে একটা দাঁড়ানোর জায়গা দাও, আমি পৃথিবীকে তুলে সরিয়ে দেব”। গণিতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্যও আর্কিমিডিস সমান বিখ্যাত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককের ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানের জন্য ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস আবিষ্কারের বহু আগেই তিনি প্রুফ অব কন্ট্রাডিকশন নীতি ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। গণিত ও পদার্থবিদ্যার এক আবশ্যক বিষয় হল পাই। গোলকের আয়তন, পরিধি, ব্যাস ইত্যাদির মান নির্ণয় পাই ছাড়া গতি নেই। আর্কিমিডিসই সর্বপ্রথম ‘মেথড অব এক্সসশন’ (Method of Exhaustion) নামক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাই (π) এর প্রায় নির্ভুল মান বের করতে সক্ষম হন। সূচক ব্যবহার করে বড়ো সংখ্যা লেখার পদ্ধতিও তিনি উদ্ভাবন করেন। আর্কিমিডিস বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে তাঁর সমকালীন গণিতবিদদের সেই সমাধান বলতেন কিন্তু সমাধানের কৌশল তিনি কখনোই বলতেন না। তাঁরা যখন এর সমাধান সূত্র বের করার জন্য অনেক কষ্ট করেও কোন সমাধান খুঁজে পেয়ে হয়রান হতেন তখন আর্কিমিডিস বেশ মজা পেতেন। অষ্টাদশ শতকের আগে পর্যন্ত তাঁর গাণিতিক সমস্যার সমাধান কোন বিজ্ঞানী করে উঠতে পারেননি।
১৯০৬ সালে বিজ্ঞানী জোহান হেইবার্গ কনস্টান্টিনোপলে একটি প্যালিম্পসেস্ট(ছাগলের চামড়ায় তৈরি পার্চমেন্ট স্ক্রল যেটিতে আগের লেখা মুছে ফেলা হয় নতুন লেখা লেখবার জন্য) খুঁজে পান। বইটি তেরো শতকে লিখিত খৃস্ট ধর্মের বাণী সম্বলিত পার্চমেন্ট স্ক্রল। এটির আকর্ষণীয় বিষয় হল ধর্মীয় বাণীগুলি সব গাণিতিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে লেখা। বইটিতে আর্কিমিডিসের সাতটি কাজের বিষয় সম্পর্কে জানা যায় যাতে শত শত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ‘দ্য মেথড অব মেকানিক্যাল থিওরেম’ এর বিষয়ে জানা যায়। বইটি তিনি তাঁর বন্ধু এরাটোস্থেনিসকে আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগারে সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্যে লিখেছিলেন। এই বইটি উদ্ধার হওয়ার পর বোঝা যায় আর্কিমিডিস সময়ের থেকে কতখানি এগিয়ে ছিলেন।
তাঁর আবিষ্কারগুলির মধ্যে গোলকের আয়তন নির্ণয় একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। তাঁর নির্ণয় করার পদ্ধতি অনেকটা ক্যালকুলাসের মতোই। আর্কিমিডিস নিজেও তাঁর এই আবিষ্কারকে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলে মানতেন, তাই তিনি এটিকে নিজের সমাধিতে খোদাই করে দিতে বলেগেছিলেন। আর্কিমিডিসের গতি সম্বন্ধীয় প্রায় সব কাজই হারিয়ে গেছে। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাই গ্যালিলিও ও নিউটনের মত বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
আর্কিমিডিসের অধিকাংশ কাজ বিজ্ঞানী ইউক্লিডের মতোই সংরক্ষণ হয়নি। অন্যান্য জায়গা থেকে তাঁর সাতটা গবেষণাপত্রের কথা জানা যায়। আর্কিমিডিস তাঁর লেখালেখির জন্য তৎকালীন সাইরাকিউসের আঞ্চলিক ভাষা ডারিক গ্রিক ব্যবহার করেন। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র “অন দ্য ইকুইলিব্রিয়াম অফ প্লেইনস” (On the Equilibrium of Planes) দুই খন্ডে লিখিত। প্রথম খন্ডে পনেরোটি উপপাদ্য আর সাতটি অণুসিদ্ধান্ত রয়েছে, দ্বিতীয় খন্ডে দশটি উপপাদ্য পাওয়া যায়। তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাপত্র “অন দ্য মেজারমেন্ট অফ আ সার্কেল” (On the Measurement of a Circle) কনন অব স্যামসের (Conon of Samos) এর ছাত্র ডোসিথিয়াস অফ পেলুসিয়ামের (Dositheus of Pelusium) সাথে যৌথভাবে লিখিত যাতে তিনটি উপপাদ্য রয়েছে। “অন স্পাইরালস “(On Spirals)” তাঁর লেখা তৃতীয় গবেষণাপত্র যাতে আঠাশটি উপপাদ্য রয়েছে। এই কাজটিও ডোসিথিয়াসকে উদ্দেশ্য করে লেখা। “অন দ্য স্ফীয়ার এ্যাণ্ড দ্য সিলিন্ডার” (On the Sphere and the Cylinder) (দুই খন্ড) তাঁর চতুর্থ গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্রে আর্কিমিডিস সমান উচ্চতা এবং ব্যাস বিশিষ্ট গোলক এবং সিলিন্ডারের মধ্যবর্তী সম্পর্ক প্রকাশ করেন। “অন কোনয়েডস এ্যাণ্ড স্ফেরোয়েডস” (On Conoids and Spheroids) তাঁর পঞ্চম গবেষণাপত্র যেখানে বত্রিশটি উপপাদ্য সংকলিত হয়েছে। এতে আর্কিমিডিস কোণক, গোলক এবং পরাবৃত্তিক গোলকের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল এবং আয়তন পরিমাপ করেছেন। “অন ফ্লোটিং বডিজ” (On Floating Bodies) তাঁর ষষ্ঠ গবেষণাপত্র (দুই খন্ড)। প্রথম খন্ডে আর্কিমিডিস প্রবাহী পদার্থের সাম্যাবস্থার সূত্র ব্যাখ্যা করেন এবং প্রমাণ করেন যে জল একটি ভারকেন্দ্রের চারপাশে গোলকীয় আকার ধারণ করে। “দ্য কোয়াড্রেচার অফ প্যারাবোলা” (The Quadrature of the Parabola) তাঁর সপ্তম গবেষণাপত্র। চব্বিশটি উপপাদ্য সংবলিত এই রচনায় আর্কিমিডিস দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রমাণ করেন যে একটি পরাবৃত্ত এবং একটি সরলরেখা দ্বারা আবদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল সমান ভূমি ও উচ্চতাবিশিষ্ট ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলের ৪/৩ গুণ। এই প্রমাণের জন্য তিনি একটি জ্যামিতিক ধারার অসীম পর্যন্ত যোগফল নির্ণয় করেন।
আর্কিমিডিসের ২১২ খ্রিস্ট পূর্বে সাইরাকিউজে ৭৫ বছর বয়সে গবেষণারত অবস্থায় এক রোমান সেনার হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ কথা ছিল ” আমার গোলকগুলিকে বিরক্ত কোরো না”।