গ্যালিলিও গ্যালিলেই একজন বিশ্ববন্দিত ইটালীয় পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক। তাঁকে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনক এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের জনক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
ইটালির পিসা নগরে এক সম্ভ্রান্ত বংশে ১৫৬৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী গ্যালিলিওর জন্ম হয়। তাঁর বাবা ভিনসেঞ্জো গ্যালিলেই গণিতজ্ঞ এবং সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁর মা’র নাম গিউলিয়া আমানাটি । বেশ অল্প বয়স থেকে গ্যালিলিওর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সাধারণ শিক্ষার পর তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার দরুন সেখানেই তাঁকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়। সংসারে আর্থিক অনটনের কারণে তাঁর বাবা চাইতেন গ্যালিলিও ডাক্তার হয়ে তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি করুক৷ কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গ্যালিলিওর ঝোঁক ছিল অন্যদিকে। ডাক্তারি বই পড়ার চাইতে তিনি কলকব্জা নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই বেশি ভালবাসতেন। ১৫৮৯ সালে গ্যালিলিও পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত অধ্যাপনার জন্য নিযুক্ত হন। সেই সময় পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম তৈরি করা হয়েছিল অ্যারিস্টট্লের মতবাদের উপর ভিত্তি করে। ধারণা নির্ভর এইসব মতবাদের সত্যতা সম্পর্কে গ্যালিলিওর ছাত্রাবস্থা থেকেই সন্দেহ ছিল। ফলে অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে প্রায়ই তাঁর যুক্তিতর্ক লেগে যেত। তাঁর ধারালো যুক্তির সামনে সকলেই হিমসিম খেতেন।
এরপর তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হয়ে জ্যামিতি, বলবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৬১০ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন৷ গ্যালিলিওর যখন মাত্র পঁচিশ বছর বয়স তখন তিনি একটি নতুন বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন৷ সেই সময়ে লোকের ধারণা ছিল এবং পণ্ডিতেরাও বিশ্বাস করতেন যে-জিনিস যত ভারী শূন্যে ছেড়ে দিলে সে তত তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়ে। গ্যালিলিও পিসার বিখ্যাত হেলানো মিনার চূড়া থেকে নানারকম জিনিস ফেলে দেখালেন যে একথা মোটেও সত্যি নয়। তিনি প্রমাণ করেন পড়ন্ত বস্তুর গতি বস্তুর ওজনের উপর নির্ভরশীল নয়। সকল বস্তু সমান গতিতে নিচে পড়ে এবং সমান ত্বরণ সৃষ্টি করে। ঠিক এই রকমভাবে কোনো জিনিস কত সেকেন্ডে কতখানি পড়ে, তারও তিনি চমৎকার হিসাব করে ফেললেন অথচ এত বড় আবিষ্কারে লোকে খুশি হল না বরং সকলে গ্যালিলিওর উপর চটে গেল। পণ্ডিতেরা পর্যন্ত গ্যালিলিওর হিসাব প্রমাণ কিছু না দেখে সব আজগুবি বলে উড়িয়ে দিলেন। এত কিছুর ফল স্বরূপ তর্ক বিতর্কে গ্যালিলিওর চাকরী চলে গেল। গ্যালিলিওর তার্কিক স্বভাবের জন্য বারে বারে তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হতেন এবং গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করতেন যদিও সেখানে তাঁর সুনাম ছিল যথেষ্ট।
পাদুয়াতে থাকাকালীন মেরিনা গাম্বা নামে স্থানীয় এক মহিলার সঙ্গে গ্যালিলিওর পরিচয় হয় এবং তাঁরা সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিনটি সন্তান হয়— দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বাবার নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে গ্যালিলিও ছেলের নাম রেখেছিলেন ভিন্সেঞ্জিও। তাঁদের এই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক দশ বছরেরও বেশি অটুট থেকেছিল। সে সময় ইটালিতে এই ধরনের সম্পর্ক অতি সাধারণ ঘটনা ছিল। গ্যালিলিও তাঁর ছেলেমেদের খুবই ভালোবাসতেন। পরবর্তীকালে ছেলেকে তিনি আইনসম্মতভাবে তাঁর উত্তরাধিকারীর স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন।
গ্যালিলিওর প্রসঙ্গ এলেই দূরবীক্ষণের আবিষ্কারের কথা আসে। হল্যান্ডের এক চশমাওয়ালা দুটো কাঁচ নিয়ে আন্দাজে পরীক্ষা করিতে গিয়ে দৈবাৎ একটা দূরবীক্ষণ বানিয়ে ফেলেছিলেন। এই সংবাদ ক্রমে ইটালি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে গ্যালিলিওর কানেও যায়। তিনি যন্ত্রটি নিজে তৈরি করলেন ৷ এইভাবে তৈরি হল দূরবীক্ষণ যন্ত্র।দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে জ্যোতিষ্কদের প্রথম পর্যবেক্ষণের ফল ‘সাইডরিয়াস নানসিয়াস’ বা ‘নক্ষত্র থেকে সংবাদবাহক’ গ্রন্থে লিপিবব্ধ করেন তিনি (১৬১০ খ্রীষ্টাব্দ)। চাঁদের পৃষ্ঠের খাদ, ছোট-বড় অনেক দাগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।
১৬১০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গ্যালিলিও সৌরকলঙ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। প্রায় একই সময়ে ইংল্যান্ডে হ্যারিয়ট, হল্যান্ডে জন ফ্যাব্রিসিয়াস এবং জার্মানিতে জেসুইট শিনারও স্বাধীনভাবে সৌরকলঙ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন৷ যদিও শেষ পর্যন্ত আবিষ্কারকের শিরোপা গ্যালিলিওই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি কিছু বিসমতারা (Variable Star) এবং কয়েকটি নীহারিকাও আবিষ্কার করেছিলেন।বৃহষ্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার এবং শনির বলয়ের কথাও দূরবীনের সাহায্যে সামনে আসে৷ তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,’ দ্য লিটল ব্যালেন্স ‘(The Little Balance ১৫৮৬), ‘ অন মোসন্ ‘ ( On Motion-১৯৫০), ‘ দ্য স্টারি মেসেনজার ‘( The Starry Messenger),’ লেটার টু দ্য গ্রান্ড ডাচেস ক্রিসটিনা'( Letter to the Grand Duchess Christina) প্রভৃতি।
গ্যালিলিওর শত্রুর অভাব ছিল না। গ্যালিলিওর ‘ডায়ালগ’ বইটি প্রকাশিত হবার পর শত্রুরা বিতর্ক শুরু করে দেয়। তারা বলেন যে ‘ডায়ালগ’ বইতে কোপারনিকাসকে সমর্থন করে গ্যালিলিও বাইবেলের অবমাননা করেছেন। সূর্য পৃথিবীর চারিপাশে ঘুরছে এই মতটিই তখন সকলের দ্বারা সমর্থিত ছিল৷ সূর্য স্থির এবং পৃথিবী তার চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে এমন মতবাদকে সমর্থন করায় ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এনে ইনকুইজিশনের আদালত থেকে গ্যালিলিওর নামে সমন পাঠানো হয়। প্রথমে এমন অভিযোগে গ্যালিলিও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। কারণ বইটি ছেপে বের করার আগে তিনি সরকারি দপ্তরে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় স্বয়ং পোপ বইটির প্রশংসা করে ভূমিকাটি নিজেই লিখে দিয়েছিলেন। ধর্ম বিচার সভায় গ্যালিলিওকে বলা হয় তাঁর বলা কথাগুলি যেন তিনি ফিরিয়ে নেন- না হলে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে । গ্যালিলিওর বয়স তখন প্রায় ৭০ বৎসর। বৃদ্ধ গ্যালিলিও অনেক অত্যাচারের পর তাঁর কথা ফিরিয়ে নিলেন ৷
তাঁর শেষ জীবন কেটেছে খুবই কষ্টের সঙ্গে। নিজের জীবনের উপার্জিত সমস্ত সত্যকে অস্বীকার করে গৃহবন্দী অবস্থায় তিনি বাকি জীবনটা কাটিয়েছিলেন৷ সারাজীবন যে সত্যের সাধনা করলেন তা প্রচার করতে না পারার কষ্ট ক্ষোভ তাঁকে প্রতি নিয়ত তিলে তিলে শেষ করে দিত৷ গৃহবন্দী থাকাকালীন ইংরেজ কবি জন মিলটনও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মহান বিজ্ঞানীর কথা পরবর্তীকালে তাঁর নানা কাব্যে ও রচনায় উল্লেখ করেছেন। অন্ধত্ব ও অসুস্থতা ছিল তাঁর শেষ জীবনের সঙ্গী । গৃহবন্দী অবস্থায় আট বছরের মাথায় ৭৭ বছর বয়সে ইতালীর ফ্লোরেন্সের নিকটে আর্সেট্রি নামক স্থানে ১৬৪২ সালের ৮ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান বিজ্ঞানী।
তথ্যসূত্র
- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Galileo_Galilei
- https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%93_%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%87
- http://sukumarray.freehostia.com/view.php?cat_id=4&article_id=212
- https://bijnan-o-bijnani.co.in/2019/10/01/galileo-%E0%A6%85%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B
- https://roar.media/bangla/main/biography/church-versus-science-eventful-life-of-galileo/
7 comments