কার্বন ডেটিং ।। রেডিও কার্বন ডেটিং

কার্বন ডেটিং ।। রেডিও কার্বন ডেটিং

বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স নির্ণয় করার সবথেকে বিখ্যাত এবং সুপরিচিত পদ্ধতি হল রেডিও কার্বন ডেটিং বা সংক্ষেপে কার্বন ডেটিং (Radio Carbon Dating)। জীবাশ্ম, মানুষের বা প্রাণীর কঙ্কাল কিংবা প্রাচীন সৌধ, ভগ্নাবশেষ ইত্যাদি ঠিক কত বছরের পুরনো তা নির্ণয় করা যায় এই পদ্ধতিতে। শুধু মৃত জীবদেহই নয়, কাঠ, কাপড় ইত্যাদিরও বয়স জানা সম্ভব এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। গাছের বর্ষরেখা, হ্রদ বা মহাসাগরের নীচে সঞ্চিত অধঃক্ষেপ, প্রবাল এবং স্ট্যালাগমাইট শিলা ইত্যাদির অস্তিত্ব থেকে রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যেই আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার কিংবা ৫৫ হাজার বছর আগের ঘটনার সম্ভাব্য ধারণা পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এভাবেই ইতিহাসের নানা ঘটনার সংযোগসূত্র স্থাপন করে থাকেন। কার্বন ডেটিং বা রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতিটি ঠিক কীরকম চলুন জেনে নেওয়া যাক।

আসলে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত যে কোনও জৈব বস্তুতে কার্বনের তিনটি আইসোটোপের মধ্যে সর্বাধিক কার্বন-১৪ (14C) অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। কার্বনের এই আইসোটোপটি একটি মৃদু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ, তাই একে রেডিও কার্বনও বলা হয়। যে কোনও নিদর্শনের মধ্যে রেডিও কার্বনের পরিমাণ নির্ণয় করার মাধ্যমে যেভাবে সেই নিদর্শনের বয়স জানা যায়, সংক্ষেপে সেই প্রক্রিয়াকেই রেডিও কার্বন ডেটিং বলা হয়। যে কোনও জৈব পদার্থে এই আইসোটোপটি পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রকৃতিতে কার্বনের আরও দুটি আইসোটোপ পাওয়া যায় – কার্বন-১২ (12C) ও কার্বন-১৩ (13C)। কিন্তু এগুলি তেজস্ক্রিয় নয়, স্থিতিশীল। এখন কার্বন-১৪ আইসোটোপটি তেজস্ক্রিয় হওয়ার কারণে এর ক্ষয় হয়। যে সময় কোনও পদার্থে উপস্থিত কার্বন-১৪’র পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যায়, তাকে অর্ধায়ু বলা হয়। C-14 আইসোটোপের অর্ধায়ু হল ৫৭৩০ বছর। ফলে বায়ুমণ্ডলে এর ঘনত্ব কমতে হাজার বছর সময় লাগতে পারে বলেই বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করেন। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের উচ্চ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার এবং ট্রপোস্ফিয়ার স্তরে বিভিন্ন মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে থাকা নিউট্রন কণার আঘাতে নাইট্রোজেন-১৪ (N-14) মৌলটি পরিণত হয় কার্বন-১৪ মৌলে। এর ফলে প্রকৃতিতে কার্বন-১৪ আইসোটোপের পরিমাণ সেভাবে কখনই একেবারে শূন্য হয়ে যায় না। রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মূল ভিত্তি খুবই সহজ। তত্ত্বানুসারে সমস্ত জীব বায়ুমণ্ডল থেকে এবং তাদের চারপাশের খাদ্য উৎস থেকে কার্বন শোষণ করে। এই কার্বনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু পরিমাণ তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ উপস্থিত থাকে। যখন কোনও গাছ বা জীব-জন্তু মারা যায়, তারা কার্বন শোষণ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাদের শরীরে সঞ্চিত তেজস্ক্রিয় কার্বন-১৪ তখনও ক্ষয়ীভূত হতে থাকে। কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই সব জীব বা গাছের শরীরে অবশিষ্ট কার্বন-১৪’র পরিমাণ নির্ণয় করে বলা যেতে পারে যে ঠিক কবে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এই সাধারণ নিয়মের মধ্যে ধরে নেওয়া হয় যে, পরিবেশে কার্বন-১৪ আইসোটোপের পরিমাণ সময় ও স্থানভেদে ধ্রুবক থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরে গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে নানা কারণে প্রকৃতিতে কোনওভাবেই কার্বন-১৪ আইসোটোপের পরিমাণ স্থির থাকে না। নিম্নলিখিত সূত্রানুসারে তেজস্ক্রিয় কার্বন আইসোটোপের ক্ষয় নির্ণয় করা হয় –

N = N0eλt

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এখানে N0 হল মৃত্যুর সময় কোনও উপাদানের মধ্যে অবস্থিত কার্বন-১৪ আইসোটোপের পরমাণু সংখ্যা এবং N হল বর্তমানে বা t সময় পরে ঐ উপাদানে উপস্থিত কার্বন-১৪ আইসোটোপের পরমাণু সংখ্যা। আর ‘ল্যামডা’ ( λ ) হল একটি ধ্রুবক। এই সমীকরণ থেকে N-এর মান পাওয়ার পরে বয়স নির্ণয়ের জন্য একটি চূড়ান্ত সমীকরণ কাজে লাগানো হয়। তা হল –

t = ln (N0 / N). t(1/2)

এই সমীকরণে t(1/2) -এর মান হল আইসোটোপের অর্ধায়ু অর্থাৎ ৫৭৩০ বছর। ফলে একটা বিষয় স্পষ্ট যে কোনও উপাদান বা গাছ বা পাথর কত পুরনো তা নির্ণয়ের জন্য ঐ উপাদানে বর্তমানে প্রাপ্ত কার্বন-১৪ পরমাণুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর সময় উপস্থিত পরমাণুর সংখ্যার একটি অনুপাত খুবই জরুরি।

আমেরিকান পদার্থবিদ উইলার্ড এফ লিব্বি ১৯৪৬ সালে এই রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সময়তেই এই আবিষ্কার করে ফেলেন তিনি। তিনি বলেন যে, এই বিশ্বে মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে নিরন্তর তেজস্ক্রিয় কার্বন তৈরি হচ্ছে এবং তা বাতাসের অক্সিজেনের সহায়তায় তেজস্ক্রিয় কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত হয় এবং এই কার্বন ডাই অক্সাইড যখন সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে উদ্ভিদ দেহে যায়, তা সঞ্চিত থাকে। পরে প্রাণীরা সেই উদ্ভিদ খেয়ে ফেললে তা তখন প্রাণীদের শরীরেও সংবাহিত হয়। জীবিত থাকাকালীন কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদ নিরন্তর এই তেজস্ক্রিয় কার্বন শোষণ করতে থাকে। তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী লিব্বি ১৯৬০ সালে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তীকালে একেবারে আধুনিক পদ্ধতিতে যেভাবে রেডিও কার্বন ডেটিং করা হয়, তার নাম ‘এ এম এস’ (AMS) বা অ্যা অ্যাক্সিলারেটর মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি (Accelerator Mass Spectrometry)। কার্বন ১৪ পরমাণু থেকে বিটা-রশ্মি বিকিরণের মাত্রা পরিমাপ করার মাধ্যমে ক্ষয় নির্ণয় করা হয় এই যন্ত্রের সাহায্যে এবং এই যন্ত্রের সাহায্যে কোনও উপাদানে একত্রে কার্বন ১৪ ও কার্বন ১২ পরমাণুর পরিমাণ মাপা হয়। কার্বন ডেটিং পদ্ধতির নিরন্তর বিবর্তন প্রত্নতত্ত্বের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। কয়লা, শামুকের খোল, কাঠ, খড়কুটো, হাড়, বীজ, চামড়া, হ্রদের পলি, মাটি, চুল, মাটির তৈরি জিনিসপত্র, দেওয়ালচিত্র, রক্তের অবশেষ ইত্যাদি যে কোনও উপাদান থেকেই বর্তমানে অতি সহজে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সেই উপাদানটি ঠিক কত পুরনো তা নির্ণয় করে ফেলা সম্ভব। এর ফলেই প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন গবেষণা সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে।   

আপনার মতামত জানান