রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা

রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা

অতিপ্রাকৃত শক্তি, ভূত-প্রেত, ডাকিনীবিদ্যায় বিশ্বাস করে ভূত ভেবে মানুষকে খুন করার মত চাঞ্চল্যকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা হয়েছিল এই রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা (Rambahadur Thapa Vs. Orissa Case)। এই ঐতিহাসিক মামলার অধীনে অভিযুক্তরা অতিপ্রাকৃত বস্তুর ভিত্তিতে এবং সত্য না জানার দাবিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছিল। এই মামলাই ভারতের ইতিহাসে সত্যের অজ্ঞতা আর আইনের অজ্ঞতার পার্থক্যের বিচারে অভিযুক্তের শাস্তিবিধানের যাথার্থ্য নির্ণয় করে। সত্যের অজ্ঞতার অজুহাতে অভিযুক্তের শাস্তি মকুবের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিল এই মামলা। সত্যের অজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণ প্রতিরক্ষার আবেদন কীভাবে বিচার্য হতে পারে তার গুরুত্বপূর্ণ নজির তৈরি করেছিল রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা।

১৯৫৯ সালের ৯ নভেম্বর ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের সেশন আদালতে শুরু হয় রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা। এই মামলার মুখ্য অভিযুক্ত ছিলেন জনৈক নেপালি ভৃত্য রামবাহাদুর থাপা। এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন বিচারপতি আর নরসিংহ এবং এস বর্মন। এই মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় সংবিধানের ৩০২, ৩২৪ এবং ৩২৬ নং ধারা আরোপ করা হয়েছিল। পরে যদিও এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে ওড়িশার উচ্চ আদালত।

বালাসোর জেলার রসগোবিন্দপুর নামের একটি গ্রামে একটি পরিত্যক্ত এরোড্রোম (Aerodrome) ছিল যেখান থেকে বহু মূল্যবান এরোস্ক্র্যাপ (Aeroscrap) সংগ্রহ করা হয়েছিল। ওড়িশার প্রতিরক্ষা বিভাগের গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধীনে এই মূল্যবান এরোস্ক্র্যাপগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল দুজন চৌকিদার দিবাকর এবং গোবিন্দের উপর। অযাচিত কোনও ব্যক্তি এসে যাতে সেগুলি চুরি না করে নিয়ে যেতে পারে সেটাই তাঁদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিল। কলকাতার চ্যাটার্জী ব্রাদার্স কোম্পানির মালিক জগৎবন্ধু চ্যাটার্জী তাঁর এক নেপালি ভৃত্য রামবাহাদুর থাপাকে সঙ্গে নিয়ে ঐ এরোস্ক্র্যাপ কেনার জন্য রসগোবিন্দপুরে আসেন ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাসে। স্থানীয় কৃষ্ণ চন্দ্র পাত্র-র বাড়িতে তাঁরা সেদিন রাত্রে ছিলেন। রসগোবিন্দপুরে একটি চায়ের দোকান ছিল কৃষ্ণ চন্দ্র পাত্রের। যেখানে এরোড্রোমটি ছিল তার চারপাশে কেবলই আদিবাসী গ্রাম ছিল যেখানে মূলত সাঁওতাল এবং মাঝি সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করত। এদের প্রত্যেকেই ভূতে বিশ্বাস করত এবং ঐ পরিত্যক্ত এরোড্রোমটির চারপাশ দিয়েও তারা রাত্রে একা একা যেত না ভৌতিক আবহের জন্য। তাঁদের বিশ্বাস ছিল ঐ অঞ্চলে নিশ্চিত ভূতের উপদ্রব রয়েছে। ঐ এরোড্রোমের কাছাকাছি বহু রাস্তা ছিল যেগুলি দিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া যেত। কিন্তু রাত্রে একা একা কেউই ঐসব রাস্তা দিয়ে যেত না। ১৯৫৮ সালের ২০ মে তেলকুন্দি গ্রামের বাসিন্দা চন্দ্র মাঝি ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রসগোবিন্দপুরের চা-দোকানি কৃষ্ণ চন্দ্র পাত্রের বাড়িতে এসে রাত্রিবাসের অনুরোধ জানায়। রাত তখন ৯টা। এদিকে জগৎবন্ধু চ্যাটার্জী এবং তাঁর নেপালি ভৃত্য রামবাহাদুর উভয়েই ভূতের কথা শুনে ভূত দেখতে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন। মাঝরাত্রে কৃষ্ণ চন্দ্র পাত্রকে জোর করে ভূত দেখার জন্য নিয়ে বেরোন জগৎবন্ধু আর তাদের সাথে নিয়ে যান চন্দ্র মাঝিকেও। প্রথমে তেলকুন্দি গ্রামে চন্দ্র মাঝিকে পৌঁছে দিয়ে রসগোবিন্দপুরে ফিরে এসে তাঁরা ঐ এরোড্রোমের কাছে যান। এরোড্রোমের কাছে ৪ নং ক্যাম্পের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা ৪০০ মিটার দূরে একটা আলোর নড়াচড়া দেখতে পান। খুব জোরে হাওয়া বইছিল, আর তার সঙ্গে আলোটিও সরে সরে যাচ্ছিল, আপাতভাবে দেখে এটিকে আলেয়া বলেই মনে হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁদের মনে হল যে কতগুলি ভূত যেন ঐ আলোর চারপাশে নাচছে আর ভাবামাত্রই তাঁরা সেই আলোর দিকে ছুটে যান। নেপালি ভৃত্য রামবাহাদুর প্রথমে সেখানে পৌঁছান এবং কিছু না ভেবে-চিন্তেই তিনি তাঁর খুরকি দিয়ে এলোপাথারি আঘাত করতে থাকেন সেই অজানা ভূতদের। তার কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এসে পৌঁছান কৃষ্ণ চন্দ্র পাত্র, কিন্তু রামবাহাদুর তা জানতে পারেননি। ফলে অজান্তেই তাঁর খুরকির আঘাতে কৃষ্ণ চন্দ্র গুরুতর আহত হন। ছুরির আঘাতে ভীষণভাবে আহত হয়ে কৃষ্ণ চন্দ্র এবং অন্যান্য আহত মানুষেরা চিৎকার শুরু করে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রামবাহাদুর স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে তাঁর খুরকির আঘাতে আহত কিংবা নিহত ‘ভূত’-এরা আসলে সেই আদিবাসী গ্রামের কয়েকজন সাঁওতাল এবং মাঝি যারা সেদিন রাত্রে হ্যারিকেনের আলোয় এরোড্রোমের কাছে মহুয়া ফুল সংগ্রহ করতে এসেছিল। দেখা যায় রামবাহাদুরের খুরকির আঘাতে গেলহি মাঝিয়ানি মারা যায় এবং আরও দুজন মহিলা গঙ্গা মাঝিয়ানি এবং সাঁউরি মাঝিয়ানি গুরুতরভাবে আহত হন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গেলহি মাঝিয়ানিকে খুন করার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ নং ধারা এবং অন্যান্য দুই মহিলাকে গুরুতরভাবে আহত করার অভিযোগে ৩২৬ নং ধারা এবং সবশেষে কৃষ্ণ চন্দ্র পাত্রকে আহত করার অভিযোগে রামবাহাদুরের বিরুদ্ধে ৩২৪ নং ধারায় মামলা দায়ের করা হয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ময়ূরভঞ্জের সেশন আদালতে প্রথমে অভিযুক্ত রামবাহাদুরের সপক্ষে বিচারপতি রায় দেন যে অভিযুক্ত রামবাহাদুর সত্যের অজ্ঞতার কারণে এই কাজগুলি করেছেন এবং ভূত ভেবে আক্রমণ করার অজুহাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৭৯ নং ধারায় তাঁকে বেকসুর খালাস দেন। তবে এর বিরুদ্ধে আরেকটি মতও ওঠে আদালতে যেখানে বলা হয় যে অভিযুক্ত রামবাহাদুর ভূত ভেবেই সেই নিরপরাধ মাঝিয়ানিদের উপর আঘাত করেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি একইসঙ্গে যত্ন ও মনোযোগ সহকারে ঘটনাস্থলে আচরণ করেননি। ফলে এই অভিযোগের ভিত্তিতে ৩০৪ নং এবং ৩৩৬ নং ধারার অধীনে তাঁকে অভিযুক্ত করা উচিত। ফলে রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা মূলত তিনটি প্রশ্নকে সামনে তুলে আনে –

  • অভিযুক্ত রামবাহাদুরকে প্রকৃতই দণ্ডবিধির ৭৯ নং ধারা অনুসারে খালাস দেওয়া যেতে পারে কিনা?
  • অভিযুক্তের কাজটিকে সরল বিশ্বাসের (Good Faith) অধীনে রাখা যায় কিনা?
  • সেশন আদালতে অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেওয়ার রায় যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়বিচার ছিল কিনা?

ভারতীয় দণ্ডবিধির ৭৯ নং ধারায় বলা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তি বাধ্য হয়ে বা সত্য না জেনে কিংবা সরল বিশ্বাসের বশে যে কাজই করে থাকুক না কেন, তা যদি সত্যের অজ্ঞতার কারণে হয়, আইনের অজ্ঞতার কোনও জায়গা যদি অভিযুক্তের ক্ষেত্রে না দেখা যায় এবং সরল বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকলে তার অপরাধ মার্জনীয়। অন্যদিকে দণ্ডবিধির ৫২ নং ধারায় বলা হয়েছে যে কাজ যথাযথ মনোযোগ ও যত্ন ছাড়া করা হয় তা কখনই সরল বিশ্বাসের অধীনে পড়ে না। তবে যথাযথ যত্ন ও মনোযোগের মাত্রা একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকমের হতে পারে। এই ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে আলো দেখে রামবাহাদুরের মনে হয়েছিল যে সেখানে ভূত রয়েছে এবং এই পরিস্থিতিতে মনোযোগ ও যত্নসহকারে টর্চ ফেলে তিনি সেই আলোর চারপাশে কারা ছিল তা নিজেই যাচাই করতে পারতেন, কিন্তু তার মনে চেপে বসেছিল ঐ অঞ্চলে ভূতের বাস জাতীয় সরল বিশ্বাস। সেই ধারণা থেকেই সত্যের অজ্ঞতার কারণে রামবাহাদুর এই কাজ করতে বাধ্য হয়। ভয় এবং উত্তেজনার বশেই যে রামবাহাদুর খুরকি চালিয়েছিলেন তা তাঁর সরল বিশ্বাসকেই প্রমাণ করে। এই মামলার মতই ‘ওয়ারিয়াম সিং বনাম সম্রাট’ এবং ‘বন্দা কুই বনাম সম্রাট’ মামলা দুটিতেও ৭৯ নং ধারার অধীনে ভূত সন্দেহে মানুষকে হত্যা করার ঘটনায় অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। রামবাহাদুর থাপা বনাম ওড়িশা মামলা আলোচনায় এই দুটি মামলার কথাও উঠে আসে ওড়িশা উচ্চ আদালতে। ওড়িশা উচ্চ আদালত সেশন আদালতের রায়কেই সমর্থন জানায় এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ৭৯ নং ধারার অধীনে রামবাহাদুর থাপাকে বেকসুর খালাস দেওয়ার রায় বহাল রাখে।

এই মামলাকে কেন্দ্র করে সরল বিশ্বাস এবং যথাযথ যত্ন ও মনোযোগের ধারণাটির বিস্তৃত ব্যাখ্যা ভারতের ফৌজদারি আইন এবং বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করেছিল।

আপনার মতামত জানান