রাসসুন্দরী দেবী (Rassundari Devi) একজন বাঙালি লেখিকা যিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী লেখার জন্য। সাতষট্টি বছর বয়সে ‘আমার জীবন’ নামে তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশ করার পর অষ্টআশি বছর বয়সে সেই আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত করেন রাসসুন্দরী দেবী। উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যেখানে নারীশিক্ষা প্রায় অসম্ভব ঘটনা ছিল সেখানে নিজের চেষ্টায় বই পড়া শেখেন তিনি। পাঠশালায় বাড়ির ছেলেদের শিক্ষাগ্রহণের সময় আড়াল থেকে পড়া শুনে শুনে অক্ষরজ্ঞান লাভ করেছিলেন তিনি। সেই অক্ষরজ্ঞান লাভের পরে রান্নাঘরের মেঝেতে আঁক কাটতে কাটতে বর্ণ লেখাও রপ্ত করে ফেলেন তিনি গভীর অধ্যবসায়ে। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বাংলার উনিশ শতকের সমাজের ইতিহাসে রাসসুন্দরী দেবীর লেখা ‘আমার জীবন’ নামের প্রথম আত্মজীবনীটি এক নারীর সংগ্রাম এবং শিক্ষিত হয়ে ওঠার পিছনে নিরলস অধ্যবসায়ের পরিচায়ক।
১৮০৯ সালে বাংলাদেশের পাবনা জেলার পোতাজিয়া গ্রামে রাসসুন্দরী দাসীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা পদ্মলোচন রায় রাসসুন্দরীর বাল্যকালেই মারা গিয়েছিলেন। এত ছোট বয়সে বাবার মৃত্যুর কারণে বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাই গড়ে ওঠেনি। মা এবং পরিবারের অন্যান্যদের মাঝেই বড় হয়েছেন তিনি।
প্রথাগত কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হননি রাসসুন্দরী দেবী। তৎকালীন সমাজে নারীর শিক্ষিত হওয়াটাই ছিল অপরাধের। মেয়েদের পাঠগ্রহণ বা পাঠশালায় বসতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। কিন্তু তবু তাঁর পরিবারের মানুষদের উদারতার কারণে মাত্র আট বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তাঁর প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। রান্নাবাটি, পুতুলখেলার বয়সে পাঠশালায় রাসসুন্দরীকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন তাঁর অভিভাবকেরা। সেখানে এক বিদেশি শিক্ষিকার পাশে বসে বাড়ির অন্য ছেলেদের সঙ্গে একসাথে পাঠগ্রহণ করতেন রাসসুন্দরী। ছেলেদের পড়া শুনে শুনেই বাংলা বর্ণমালা শিখে ফেলেন তিনি। এমনকি শুনে শুনে অল্প-স্বল্প পার্সি ভাষাও রপ্ত করে ফেলেন রাসসুন্দরী। হঠাৎ একদিন বাহির বাড়িতে আগুন লেগে সব ছারখার হয়ে যায়, পুড়ে যায় রাসসুন্দরীর স্বপ্নের পাঠশালাটিও। আগুন লাগার ভয়ে নদীর তীর পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর পড়াশোনার সমাপ্তি।
বারো বছর বয়সে খিড়কি ঘাটে আসা মহিলাদের থেকে জানতে পারেন যে তাঁর পরিবারের লোকেরা তাঁর বিয়ের আয়োজন করছেন। তৎকালীন বাংলায় মেয়েকে বিয়ের কথা জানানোর রীতি প্রচলিত ছিল না। নয় বছর বয়সে গৌরীদান আর তেরো বছর বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার রীতি এবং অভ্যাসই সমাজে প্রচলিত ছিল। বারো বছর বয়সেই রাসসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয় ফরিদপুর জেলার রামদিয়া গ্রামের সীতানাথ সরকারের সঙ্গে এবং শ্বশুরবাড়িতে এসে মা-হারা রাসসুন্দরী শাশুড়ি মাকেই নিজের মায়ের স্থান দেন এবং তাঁকেই নতুন মা হিসেবে স্বীকার করে নেন। শ্বশুরবাড়িতে আটজন দাসী থাকার কারণে সেভাবে প্রথম দুই বছর কোনো কাজই করতে হয়নি রাসসুন্দরীকে। মাটি দিয়ে বিড়াল, সাপ, কুকুর, শিয়াল ইত্যাদি বানিয়ে মজা করতে করতেই দিন অতিবাহিত করতেন তিনি। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বাধ্য হয়েই আবক্ষ ঘোমটা টেনে সব কাজ করতে হত তাঁকে। বাইরের লোক তো বটেই, এমনকি নিজের স্বামীর সামনেও ঘোমটা সরানো অপরাধ ছিল। কিন্তু বিয়ের প্রথম দুই বছর পরেই তাঁর শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর তখন থেকেই গৃহদেবতার সেবা, ভোগ রান্না, অতিথি-সৎকার, রান্না ইত্যাদি সব কাজ তাঁকে একা হাতে করতে হত। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে প্রায়দিনই অনেক রাত পর্যন্ত তাঁকে কাজ করতে হত। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি জানিয়েছেন এই বিবাহ নামক বিষয়টিকে তাঁর একটি খাঁচা বলেই মনে হত। বাল্যকালের স্বাধীনতার জীবন শেষ করে পালকি আর নৌকায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তেতাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত রাসসুন্দরী দেবী মোট বারোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর পুত্র ও কন্যাদের নাম যথাক্রমে বিপিনবিহারী, পুলিনবিহারী, রামসুন্দরী, প্যারীলাল, রাধানাথ, দ্বারকানাথ, চন্দ্রনাথ, কিশোরীলাল, প্রতাপচন্দ্র, শ্যামসুন্দরী এবং মুকুন্দলাল। এর মধ্যে তেইশ বছর বয়সে তাঁর একটি পুত্রসন্তান হলেও গর্ভাবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। সন্তানাদির দেখাশোনার পাশাপাশি সর্বক্ষণ তাঁর মনের মধ্যে বই পড়ার এক অদম্য বাসনা উছলে উঠতো। লেখাপড়া শেখার জন্য রাসসুন্দরীর যে আগ্রহ, যে প্রবল ইচ্ছা তা সেকালে নারীদের মধ্যে খুব একটা দেখা যেত না। কিন্তু সাংসারিক দায়-দায়িত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন তিনি ক্রমশ। সারাদিনের কাজের শেষে তাঁর স্বামীর কাছে এসে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন রাসসুন্দরী। বেশিরভাগ দিনই অনেক রাতে কাছারিবাড়ি থেকে কাজ সেরে ফিরতেন তাঁর স্বামী আর রাসসুন্দরী তাঁর অপেক্ষায় খেতেন না। কিন্তু সংসারের কেউই সে খবর রাখতেন না। রামদিয়া গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে তাঁর স্বামীর ‘জয়হরি’ নামে একটি ঘোড়া ছিল। বাড়ির চাকরেরা রাসসুন্দরীর বড় ছেলেকে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে ঘুরিয়ে বেড়াতেন। কিন্তু লজ্জাশীলা রাসসুন্দরী বাইরের উঠোনে সেই ঘোড়ার সামনে যেতে সংকোচ করতেন। এমনকি সেই জয়হরি নামের ঘোড়া বাইরের উঠোনে ছড়িয়ে রাখা ধান খেয়ে গেলেও তাকে বিরত করতে যেতে লজ্জা পেতেন তিনি। তাঁর মনে সর্বদাই এক ভয় হতো স্বামীর ঘোড়াকে তিনি কীভাবে বিরত করতে পারেন! বিয়ের পরে তাঁর মনে হয়েছিল বিদ্যাহীন জীবন আসলে পশুর মতো। আর তাই বই পড়ার আগ্রহে বাড়িতে থাকা চৈতন্যভাগবতের পুঁথি সংগ্রহ করেন তিনি, তাও নিজে সেটি সংগ্রহ করার বদলে ভয়ে ভয়ে বড় ছেলে বিপিনবিহারীকে বলে সেই পুঁথি নিয়ে আসতে সক্ষম হন রাসসুন্দরী। সেই চৈতন্যভাগবতের একটি পাতা খুলে রান্নাঘরের এককোণে লুকিয়ে রাখেন তিনি আর একইসঙ্গে সেখানে লুকিয়ে রাখেন বড় ছেলের লেখা তালপাতা। বাড়ির ছেলেরা পাঠশালায় পড়ত আর সেই পড়া আড়াল থেকে শুনে শুনে জ্ঞান অর্জন করতে লাগলেন রাসসুন্দরী। সংসারের কাজ সেরে অবসর পেলেই সেই চৈতন্যভাগবতের পুঁথি নিয়ে বসে পড়তেন তিনি। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর তিন ননদ রাসসুন্দরীর পড়ার আগ্রহের কথা জেনে বেশ সাহায্য করেছিলেন তাঁকে। ক্রমে পড়তে শিখলেন রাসসুন্দরী। কিন্তু লেখা শেখার জন্য যে কলম, দোয়াত, পাতার আয়োজন নিয়ে বসতে হয় সেই অবকাশ ছিল না তাঁর। শাশুড়ির মৃত্যুর পরে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব যেমন বেড়েছিল রাসসুন্দরীর তেমনি সকলের কাছে তিনি বাড়ির কর্তা ঠাকুরানী হয়ে উঠেছিলেন। শুধুই চৈতন্যভাগবত নয়, ক্রমে ক্রমে আঠারো পর্বের চৈতন্যচরিতামৃত, জৈমিনিভারত, গোবিন্দলীলামৃত, বিদগ্ধমাধব, প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, বাল্মীকি-পুরাণ সমস্ত বইই পড়ে ফেললেন রাসসুন্দরী দেবী। কিন্তু বাড়িতে যে বাল্মীকি-পুরাণ ছিল তাতে শুধু আদিকাণ্ড ছিল, সাতটি কাণ্ড ছিল না। ফলে আদিকাণ্ড পড়ে আরো সবটা পড়তে প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলেন রাসসুন্দরী। কিন্তু বাড়িতে সে বই না থাকায় তাঁর ছেলে দ্বারকানাথ কলেজ থেকে বাড়িতে এলে তাঁকে বই আনার কথা জানালেন তিনি। বহুদিন পরে তাঁর ছেলে সেই বাল্মীকি-পুরাণ বাড়িতে পাঠায় কিন্তু সে বইয়ের লেখার হরফ এত ছোট ছিল যে রাসসুন্দরী বই হাতে পেয়েও তা পড়তে পারলেন না। তাঁর ছেলে কিশোরীলাল তাঁকে চিঠির উত্তর দেওয়া শেখাতে লেখার সব সরঞ্জাম কিনে অভ্যাস করতে বলেন। একদিন সীতানাথ সরকার অর্থাৎ রাসসুন্দরীর স্বামীর সান্নিপাতিক জ্বর হলে রাসসুন্দরী তাঁকে ছেলে দ্বারকানাথের কাছে কাঁঠালপোতায় নিয়ে যান। কাঁঠালপোতায় থাকাকালীনই কিছু অক্ষর নিজে হাতে লেখা শেখেন রাসসুন্দরী দেবী। ১৮৬৮ সালে মাঘী শিবচতুর্দশীর দিন রাসসুন্দরী দেবীর স্বামী সীতানাথ সরকারের মৃত্যু হলে বৈধব্য যন্ত্রণা গ্রাস করে তাঁকে। ইতিমধ্যে তাঁর তিন ছেলে ও ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
শোনা যায়, রাসসুন্দরীর শ্বশুরবাড়িতে অর্থাৎ রামদিয়া গ্রামে বিখ্যাত সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসু আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন একবার। বাড়িতে মদনগোপালের মূর্তি স্থাপিত ছিল, নিত্যদিন তাঁর পূজায় নিমগ্ন থাকতেন রাসসুন্দরী।
তাঁর জীবনের সমস্ত কথাই জানা যায় তাঁর আত্মজীবনী থেকে। ‘আমার জীবন’ নামে সেই আত্মজীবনী দুটি খন্ডে প্রকাশ করেছিলেন রাসসুন্দরী দেবী । সাতষট্টি বছর বয়সে ১৮৭৬ সালে প্রথম খণ্ডটি এবং আটাশি বছর বয়সে দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশ করেন তিনি। ঠাকুর পরিবারের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সাহিত্য-সমালোচক দীনেশচন্দ্র সেন রাসসুন্দরীর আত্মজীবনীর প্রস্তাবনা রচনা করেছিলেন। রাসসুন্দরীই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীকার। তাঁর ‘আমার জীবন’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে মোট ষোলোটি অধ্যায় আছে যেগুলির প্রতিটির শুরুতে একটি করে কবিতা রচনা করেছেন রাসসুন্দরী দেবী । ঐ বইতেই তিনি জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে বারবারই পরমেশ্বর, দীননাথ প্রমুখের কথা বলেছেন যা তাঁর আধ্যাত্মিক মনের পরিচয় দেয়। পরবর্তীকালে তাঁর নাতনি সরলাবালা সরকার ‘আমার ঠাকুরমা’ নামে একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছিলেন রাসসুন্দরী দেবীকে কেন্দ্র করে। সেই লেখা থেকেও তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারা যায়।
১৮৯৯ সালে রাসসুন্দরী দেবীর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- ‘আমার জীবন’,রাসসুন্দরী দাসী,বারিদবরণ ঘোষ (সম্পা:), ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অফ ইণ্ডিয়া, তৃতীয় সং, ২০১৭, পৃষ্ঠা xiv-xxv, ৯, ১৬, ৩৪, ৪২, ৪৬, ৫১, ৫২
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.risingbd.com/
- https://www.bongodorshon.com/
- https://blog.mukto-mona.com/
One comment